শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

দশ মাসেই করোনা ভ্যাকসিন

চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিস্ময়কর সাফল্য

মুহাম্মদ সানাউল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:১০ এএম

আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের পরীক্ষা করার জন্য, কখনো গুনাহ ক্ষমা করে দেয়ার জন্য রোগ দিয়ে থাকেন। বান্দা এসময় আল্লাহর দরবারে আরোগ্যের জন্য দোয়া করে। তিনি তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করে শেফা দান করেন। হায়াত না থাকলে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নেন। কখনো কখনো কোন প্রকার ওষুধ বা প্রতিষেধক ব্যবহার ছাড়াই রোগ নিরাময় হয় আবার কখনো আল্লাহ তা‘আলা কোন ওষুধ ব্যবহার করিয়ে রোগ আরোগ্য করেন। মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা এমন কোন রোগ পৃথিবীতে অবতীর্ণ করেননি যার ওষুধ দেননি। (সহীহুল বুখারী : ৫৬৭৮)
পৃথিবীতে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। কোনো কোনো রোগ সহজে নিরাময়যোগ্য, কোনোটা আবার এখনো ওষুধ সহজলভ্য না হওয়ায় অনিরাময়যোগ্য। ইতিহাসের পাতায় এমন অনেক রোগের নাম রয়েছে যার অস্তিত্ব বর্তমানে না থাকলেও অতীতে লাখ লাখ মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আবার তার প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হওয়ার পর তার মাধ্যমে নিরাময়ও হয়েছে। কলেরা, গুটিবসন্তের মতো রোগগুলো থেকে পৃথিবী এখন মুক্ত। পোলিও, ধনুষ্টংকর, যক্ষা, হুপিং কাশি, হাম, রুবেলা এসব রোগের প্রতিষেধক হিসেবে প্রতি বছর কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। ফলে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এসব রোগ। প্রাণঘাতী রোগের কাতারে সবশেষ সংযোজন করোনাভাইরাস।
নতুন ভাইরাসকে বলা হচ্ছে সার্স-কোভ-২। পুরো নাম সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস-২। নাম অনেক বড় হলেও ভাইরাসটি কিন্তু অতি ক্ষুদ্র। এর দৈর্ঘ্য মাত্র ১২০ ন্যানোমিটার অর্থাৎ ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ। সহজভাবে বলা যায়, একটি আলপিনের ডগায় ১০ কোটি এ ভাইরাস কণা অনায়াসে স্থান করে নিতে পারে। এর থেকে মাত্র কয়েক শ’ ভাইরাস কণা সংক্রমিত করতে যথেষ্ট। আর একবার সংক্রমিত হলে এবং রোগের লক্ষণ দেখা দিলে ওই রোগকেই বলা হয় ‘কোভিড-১৯’।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হলেও প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় ২০২০-এর ৯ জানুয়ারি। ঘোষণা করা হয় ১১ জানুয়ারি। চীনের বাইরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন থাইল্যান্ডে গত ১১ জানুয়ারি। তবে থাইল্যান্ড কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করায় সেখানে করোনাভাইরাস থাবা তেমন বিস্তার করতে পারেনি। করোনায় চীনের বাইরে প্রথম কোনো রোগী মারা যান ফিলিপাইনে গত ২ ফেব্রুয়ারি। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৩০ জানুয়ারি বিশ্বে স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করে। ১১ ফেব্রুয়ারি করোনাভাইরাস থেকে রোগের নামকরণ করা হয় ‘কোভিড-১৯’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১ মার্চ করোনাভাইরাসকে ‘বৈশ্বিক মহামারি’ ঘোষণা করে।
ক্রমেই যখন পৃথিবীময় করোনাভাইরাসে সংক্রমণের খবর ছড়িয়ে পড়ে, দেখা দেয় আতঙ্ক। একই সাথে এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের বিয়ষটিও মাথায় আসে। শুধু মাথায় আসাই নয়, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রস্তাব আসতেই সবার আগে অর্থ নিয়ে এগিয়ে আসেন পৃথিবীর সেরা ধনীদের অন্যতম মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে তাৎক্ষণিক ১৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ঘোষণা দেন প্রয়োজনে তা ২৫০ মিলিয়নে উন্নীত করা হবে। একসময় এও ঘোষণা দেন যে, করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির গবেষণায় যা খরচ হবে তার পুরোটায় দেবেন বিল গেটস। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি ডলার উদার হস্তে দিয়েছেন বিভিন্ন ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের। উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে চলেছে। এটি বর্তমানে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দাতব্য সংস্থা। সংস্থাটি এখন পর্যন্ত ৫০ বিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করেছে দাতব্য কাজে।
উদার হস্তে অর্থ বিলিয়ে দেয়ার পাশাপাশি তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, একটি ভ্যাকসিনের সাথে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। কোন বুর্জোয়া কোম্পানির হাতে গিয়ে তা যেন ব্যবসার উপাদানে পরিণত না হয়। সম্পূর্ণ দাতব্য চিন্তার মাধ্যমে একটি ভ্যাকসিন উৎপাদিত হলে তা পৃথিবীর সব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বল্পমূল্যে এমনকি বিনামূল্যে বিতরণের ব্যবস্থা করা সহজ হবে। তিনি এর জন্য উদার হস্তে অর্থ বিনিয়োগের কথাও জানান। তবে হতাশার খবর হল, টিকা কার্যকরভাবে আবিষ্কৃত হবার আগেই পৃথিবীর ধনী দেশগুলো তাদের চাহিদার দ্বিগুণ, তিনগুণ এমনকি চারগুণ পর্যন্ত টিকা কিনে ফেলেছে।
পৃথিবীতে বর্তমানে ১২০টিরও বেশি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ চলছে। এসবের মধ্যে অনেক ভ্যাকসিন মানুষের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে। ফাইজার ও বায়োএনটেকের তৈরি করা টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। মডার্নার টিকা ৯৪ শতাংশ এবং অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ৭০ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত। জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা নিয়েও বিজ্ঞানীরা আশাবাদী।
২০২০ সালে করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হয়েছে অভাবনীয়। একটি ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরিতে সময় লাগে ১৮ মাস থেকে ১০ বছর পর্যন্ত। বহু বছর যাবত প্রচেষ্টা চালালেও এইডস রোগের টিকা এখনো উদ্ভাবিত হয়নি। অথচ অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক বিষয় হচ্ছে, ২০২০ সালে মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই করোনাভাইরাসের একাধিক টিকা তৈরি এবং মানবদেহে তার প্রয়োগও শুরু হয়ে গেছে। ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার তৈরি দু’টি টিকা অনুমোদিত হয়েছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাও অনুমোদিত হতে যাচ্ছে। রাশিয়া তাদের স্পুটনিক-ভি টিকা অনুমোদন করে সে দেশের মানুষের দেহে পুশ করছে। চীনও তাদের সিনোভ্যাক টিকার অনুমোদন সহসাই করতে যাচ্ছে।
আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সউদী আরব, আরব আমিরাতসহ অনেকগুলো দেশ ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করেছে। ভারতে টিকার অনুমোদন দেয়া হলে কীভাবে চলবে করোনার প্রতিষেধক দেয়ার প্রক্রিয়া, সরবরাহ, মজুত করা থেকে টিকাদান, তা নিখুঁত করতে চার রাজ্যে হয়েছে টিকাকরণ পদ্ধতির মহড়া। রাজ্য চারটি হল অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব, আসাম এবং গুজরাত। মহড়ার আগে ২৩৬০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অক্সফোর্ডের টিকা অনুমোদনের জন্য ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে দেশটির সেরাম ইনস্টিটিউট। অনুমোদিত হওয়ার সাথে সাথে ভারতে ব্যাপকভাবে টিকা প্রয়োগ শুরু হবে। এর কয়েক দিনের মধ্যে পাবে বলে আশায় বুক বেঁধে আছে বাংলাদেশের জনগণ। কারণ, বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি রয়েছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন