করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই বিচারাঙ্গন ছিলো সক্রিয়। এ সময় সরকারের প্রশাসনকে নানা ধরনের নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। কোডিভ আক্রান্ত মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় দেশীয় সক্ষমতার মাত্রাও নির্ণীত হয় আদালতের ধারাাহিক নির্দেশনায়। কোডিভ-১৯ এর আক্রমণে গোটা বিশ্ব যেখানে স্তব্ধ হয়ে যায়-তখন সক্রিয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সোচ্চার ভ‚মিকা নেয় আদালত। করোনা দ্রুত সংক্রমিত হতে থাকলে কিছুদিন বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকে। তবে বিচারিক প্রক্রিয়া চালু রাখতে সাহসী এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ স্বরূপ অধীনস্থ আদালতগুলোতে ‘ভার্চুয়াল বেঞ্চ’ চালু করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। করোনা আক্রান্ত হয়ে বিচারক, আইনজীবী, আদালতসহায়ক বহু কর্মকর্তা-কর্মচারি ইন্তেকাল করেন। ২০২০ সাল বিচার বিভাগের জন্য বিষাদ ও শোকাবহ।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, করোনা সংক্রমণ কেন্দ্রিক বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দিয়ে করোনা কালের ২০২০ সাল জুড়েই বিশেষভাবে আলোচনায় ছিলো বিচারাঙ্গণ। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকায় রাজনৈতিক মামলার বাড়তি চাপ ছিলো না আদালতে। বরং দায়েরকৃত নতুন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির নজির স্থাপন হয় বিদায়ী বিছর। ছিল সাহেদ-পাপিয়া, পায়েল হত্যা, সিপিবির মামলা, মজনুর ধর্ষণ মামলা, ঢাকার মেয়রপ্রার্থী ইশরাক হোসেনের মামলার রায় ছিলো উল্লেখ যোগ্য। সাহেদ, সাবরিনা, শারমিন জাহান গ্রেফতারের সময় সরগমম ছিল আদালতপাড়া। বছরের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ইস্যুতে উত্তাপ বিস্তার লাভ করে আদালতপাড়ায়। এ বছর নির্বাহী আদেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলা খারিজ করে দেন আদালত। জুনায়েদ বাবুনগরী, মামুনুল হক, মুফতি ফয়জুল করিমের মামলা তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। তবে করোনার প্রভাবে ব্লগার অভিজিত রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, কাকরাইলে মা-ছেলে হত্যা মামলার বিচার বিলম্বিত হয়। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার, জিকে শামীমের বিচার, ঘুষ গ্রহণ মামলায় পুলিশের ডিআইজি এবং দুদক পরিচালকের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয় এ বছর। এছাড়া ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী নাইমুল আবরার রাহাতের অপমৃত্যুর মামলায় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানসহ ৯ জনেরও বিচার শুরু হয়।
ঘুষ গ্রহণ ও মানিলন্ডারিং আইনের মামলায় বরখাস্ত সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) পার্থ গোপালের বিচার শুরু হয় এ বছরই।
বরগুনা রিফাত হত্যা মামলার রায় হয় এ বছর। এ মামলায় প্রধান সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ৬ জনের মৃত্যুদন্ড হয়। চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায় হয় ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এ ঘটনা উত্তাপ ছড়ায় বিচারিক আদালতে। উচ্চ আদালতে দুর্নীতি দমন কমিশনের ভুল চার্জশিটে বিনা অপরাধে তিন বছর কারাভোগকারী পাটকল শ্রমিক জাহালমকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ হয়। হাইকোর্টে জিকে শামীমের জামিন মঞ্জুর হয়। পরবর্তী জামিন আদেশ জামিন বাতিল করা হয়। পরে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে এই জামিন মঞ্জুরের পেছনে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জান্নাতুল ফেরদৌস রূপার সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। রূপার বিরুদ্ধেও দুদক অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
চেক ডিজঅনার মামলার বিষয়ে যুগান্তকারী রায় দেন হাইকোর্ট। এ রায় অনুযায়ী এনআই অ্যাক্টের মামলার আপিলের জন্য হাইকোর্টে যেতে হবে না ভুক্তভোগীদের। যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে দায়রা জজ আদালতেই। বৈষম্য নিরসনকল্পে এ আদেশ দেন হাইকোর্ট। পৃথক তিনটি রিটের শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। এ রায়ের ফলে নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস আইনের অধীন ১৩৮ ধারার চেকের মামলার বিচার, আপিল এবং রিভিশনের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন যাবত চলে আসা বৈষম্যমূলক বিধানের অবসান ঘটে। বছরের শেষ দিকে অর্থ পাচার মামলায় কুয়েত কারাগারে থাকা কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম এমপি, তার মেয়ে এবং বোনকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
এদিকে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে নিয়মিত আদালত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর আগেই সম্ভাব্য করোনা সংক্রমন রোধে নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। পরে সারাদেশে করোনা সংক্রমিত হওয়ার পর এটিকে কেন্দ্র করে উচ্চ আদালত বেশকিছু আদেশ-নির্দেশ দেন। বলা চলে, এ সময় সরকারি প্রশাসনের বিভিন্ন শাখাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, অদক্ষতা, অনিয়ম-দুর্নীতি উদঘাটিত হয় উচ্চ আদালতেরই নির্দেশে। দেশবাসীর দৃষ্টি তখন ছিলো আদালতের দিকেই। করোনাকালে রোগীদের চিকিৎসা না দিয়ে ফেরত পাঠানোর ঘটনায় দায়ের হওয়ার রিটের প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৫ জুন হাসপাতাল-ক্লিনিকের জন্য অনুসরণীয় ১০ দফা নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।
করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে রাজধানীতে লকডাউন ঘোষণা ও চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ফ্রো-নেজাল অক্সিজেন ক্যানোলা সংগ্রহের নির্দেশনা চেয়ে দাখিল করা রিটের ভিত্তিতে ১৪ জুন নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশে’র প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আলোচিত এ রিটটি করেন।
করোনা সংক্রমণে ভীত সন্ত্রস্ত অধিকাংশ পেশাজীবীই গৃহে অবস্থান করেন। কিন্তু এ সময়ে মিটিং-মিছিল অব্যাহত ছিলো বিচারাঙ্গনে। আইনজীবীদের একটি অংশ ‘অবিলম্বে আদালত খুলে দেয়া’র দাবিতে মিছিল করেন। আইনজীবীদের আর্থিক সঙ্কট বিবেচনা করে মানবিক কারণে বিশেষ ব্যবস্থায় আদালত খুলে দেয়ার পক্ষে অবস্থান নেয় সুপ্রিম কোর্ট বারসহ বিভিন্ন আইনজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তারা সংবাদ সম্মেলন এবং বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরে
২০২০ সালের ৯ মে ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ-২০২০’ জারি হয়। এই সংশোধনের মাধ্যমে ব্যবস্থায় দেশের বিচার ব্যবস্থা ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করে এ বছরই। এই সংশোধনীর পর ভাচুয়াল ব্যবস্থায় আদালত খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আইনজীবীদের একটি অংশ এ সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করেন। রিট হয়। কোনো কোনো বারে অনুষ্ঠিত হয় বিক্ষোভ মিছিল। প্রণোদনা, সহজ শর্তে ঋণের দাবিতেও অনুষ্ঠিত হয় বিক্ষোভ মিছিল। করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুপ্রিমকোর্ট বারসহ সারাদেশে দুই শতাধিক আইনজীবী ইন্তেকাল করেন। বিচারক ইন্তেকাল করেন দু’জন। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও ইন্তেকাল করেন করোনায়। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট এএম আমিনউদ্দিনকে অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এ ঘটনার পর দুই অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল পদত্যাগ করেন। সব মিছিলে ২০২০ সালের প্রায় পুরোটা চুড়ে আলোচনায় ছিলো বিচার বিভাগ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন