সম্পর্ক জোরদারের বার্তা নিয়ে ঝটিকা সফরে প্রথমবারের মতো ঢাকা আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রস্তাব নিয়ে অক্টোবরে আসছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। আর দোদুল্যমান সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে আসছেন পাকিস্তানী পররাষ্ট্র সচিব আইজাজ আহমেদ চৌধুরী। গণচীন বিশাল আকারের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। আর পাকিস্তান চাচ্ছে বাংলাদেশের সাথে তিক্ততা কাটিয়ে সম্পর্কের স্থিতাবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠা। কোনো দেশে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর ওই দেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ও গুরুত্ব তুলে ধরে। বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ‘আকসা’ বা ‘অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট’ চুক্তি করতে চায়। এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি চুক্তি। প্রস্তাবিত এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ‘গাইডেড মিসাইল’সহ বেশ কয়েক ধরনের আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রা বিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন কার্যকলাপ সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। এর ফলে মার্কিন বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতিরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার অনলাইনে ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি গাড়তে চায়। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত খবর মোতাবেক, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশ সফরকে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সফলতা হিসেবেই দেখছে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি সূত্র। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে নানা কারণে। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন যে বিশাল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলছে তা মূলত তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। ইনকিলাবের ওই খবর মোতাবেক, চীনের এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা ও চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এই অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে, যাতে বাংলাদেশকে অন্যতম পার্টনার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে, বাংলাদেশ সফরে এসে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করতে পারেন প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। চীনের সহযোগিতায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। টানেল নির্মাণে খরচ পড়বে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চীন দেবে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি খরচ বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। চীনা প্রেসিডেন্টের টানেল উদ্বোধনের বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরের সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চীন দীর্ঘদিন ধরেই আগ্রহ ব্যক্ত করে আসছে। চীনের প্রেসিডেন্টের আসন্ন বাংলাদেশ সফরকালে গভীর সমুদ্রবন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে থাকছে। ঢাকাস্থ চীনা রাষ্ট্রদূত মা মিং ছিয়াং চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশে চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে চারশ’ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হবে। সেখানে দুই থেকে আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। সাম্প্রতিক বছরে সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিটে কিছু সামরিক সরঞ্জাম রাশিয়া থেকে আমদানি করা হলেও চীনই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের শীর্ষ দেশ। নৌবাহিনীর জন্য আগামীতেও সাবমেরিন আসবে চীন থেকে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অচলাবস্থা নিরসনে ৩১ আগস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক। আগামী নভেম্বরে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশগ্রহণ বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে বলে জানা যায়। উভয় দেশই বেলুচিস্তান ইস্যুতে আর কোনো উচ্চবাচ্য না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, ইস্যুটি নিয়ে আরও পানি ঘোলা হলে তাতে দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আসন্ন বৈঠকে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এটি বাংলাদেশ সরকারের কৃতিত্ব যে, আগামী ২ মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশে এমন ৩ জন বিদেশী মেহমান আসছেন যারা বাংলাদেশের পটভূমিতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জন কেরি শুধুমাত্র মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রীই নন, তিনি মার্কিন রাজনীতি এবং প্রশাসনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। ইতোপূর্বে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। যতদূর মনে পড়ে, বাংলাদেশে ৩ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সফর করেছেন। এরা হলেন, বঙ্গবন্ধুর আমলে ড. হেনরি কিসিঞ্জার এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে প্রথমে হিলারি ক্লিনটন এবং ২৯ তারিখে আসছেন জন কেরি। গণচীনের প্রেসিডেন্টের আসন্ন বাংলাদেশ সফর অসাধারণ গুরুত্ববহ। কারণ, গণচীন এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তি। যখন চীন কোনো দেশকে অর্থনৈতিক সাহায্য করে তখন শত শত কোটি নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ এবং অনুদান প্রদান করে। ভৌগোলিক আয়তনের দিক দিয়ে পৃথিবীর ৪টি বড় দেশের মধ্যে চীন অন্যতম। জনসংখ্যার দিক দিয়ে গণচীন ১ নম্বরে। সামরিক শক্তির দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের পরেই চীনের স্থান। এ উপমহাদেশে পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান উভয়ের স্বার্থেই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন। আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিম-লে তাই এই ৩টি দেশের রাষ্ট্র নেতাদের বাংলাদেশ সফর গুরুত্বপূর্ণ। এসব সফরের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ বাস্তবায়নে দক্ষতার সাথে কাজ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ জন্য অকুণ্ঠ ধন্যবাদ তাদের প্রাপ্য।
এই ৩টি সফর বাংলাদেশের সামনে বহুমুখী সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণ একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। এটি কোনো অলীক স্বপ্ন নয় বা কোনো কষ্ট কল্পনাও নয়। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের ভবিষ্যত অমিত সম্ভাবনাময় বলে দেশী এবং বিদেশী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। সেই সাথে রয়েছে বাংলাদেশের অসাধারণ কৌশলগত গুরুত্ব। তবে বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে শুধুমাত্র সম্ভাবনা থাকলেই সেই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ লাভ করে না। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে প্রাপ্ত প্রতিটি সুযোগের সদ্ব্যব্যবহার করতে হয়। সেই সুযোগ বার বার আসে না। অনেক দিন পর তেমন একটি বিরল সুযোগ বাংলাদেশের সামনে হাজির হয়েছে। এই সুযোগ আমরা হেলায় হারাতে পারি না। স্বপ্নময় যে সম্ভাবনা আসন্ন এই ৩টি সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তার পূর্ণ সুযোগ আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে। আরেকটি কারণে এসব সফর অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ। আজ বাংলাদেশ ভারতের সর্বগ্রাসী প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানে ভারতের প্রবল উপস্থিতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ইন্দো সেন্ট্রিক বা ভারত নির্ভর করে তুলেছে। এখন পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি যেভাবে প্রবল আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে, পথিবীর অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি গণচীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে এবং উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ পাকিস্তান যেভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার আগ্রহ দেখাচ্ছে, তার ফলে যদি আমরা এই ৩টি দেশের আগ্রহের প্রতি দক্ষতার সাথে সাড়া দিতে পারি তাহলে বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক তথা ভারত নির্ভর পররাষ্ট্র নীতির আর্বত থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন