শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

জটিল হিজড়া ও সাবালক-নাবালক প্রসঙ্গ

মুফতী মোঃ আবদুল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০৩ এএম

সাবালক পূর্ববর্তী অবস্থা

যেক্ষেত্রে তার পুরুষ ও নারী উভয়সুলভ গুপ্তাঙ্গ থাকে সেক্ষেত্রে বিবেচনা করা হবে সে কোন্টি দ্বারা প্রস্রাব করে? যদি পুরুষাঙ্গ দ্বারা পেশাব করে তা হলে তাকে ছেলে বলে গণ্য করা হবে। আর যদি নারীসুলভ গুপ্তাঙ্গ দ্বারা পেশাব করে তা হলে তাকে মেয়ে বলে গণ্য করা হবে। কেননা, তেমন পরিস্থিতিতে এটাই দলীলস্বরূপ ধর্তব্য হবে যে, ‘যা দ্বারা পেশাব নির্গত হচ্ছে তা-ই মূল অঙ্গ, অন্যটি রোগ-সমস্যা’।

“আর যেক্ষেত্রে পুরুষ-নারী কোনো সুলভ অঙ্গই না থাকে; কেবল ছিদ্র দ্বারা পেশাব করে থাকে। পুরুষ বা নারী হিসাবে চিহ্ণিত করার মতো অপর কোনো চিহ্ণ প্রকাশ না পায় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হিজড়াকে ‘খুনছা-মুশকিল’ বা ‘জটিল হিজড়া’ বলা হয়। এমন সমস্যা সাধারণত ছোট বয়সের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে; যা বয়-সন্ধিকালে আর অবশিষ্ট থাকে না” (আল-মুসতালাহাত ওয়াল-আলফাযুল ফিকহিয়্যা: খ-২,পৃ-৫৯, মিসর)।

সাবালক পরবর্তী অবস্থা
অবশ্য যখন সাবালক হয়ে যায় তখন অপরাপর নিদর্শন দ্বারা উক্ত জটিলতা দূরীভুত হয়ে যায়। সেসব নিদর্শন হচ্ছে, হয়তো তার দাড়ি-মোচ ইত্যাদি গজাবে; সুতরাং তখন তাকে পুরুষ বলা হবে; কিংবা তার স্তন বড় হবে তখন তাকে নারী বলা হবে।

‘সিরাজিয়্যা’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে,“যদি নারীদের অনুরূপ তার স্তন প্রকাশ পায় বা তার মাসিক হয় বা তার সঙ্গে সহবাস করা যায়, তা হলে সে নারী বলে গণ্য হবে” (প্রাগুক্ত:পৃ-৬০)। অর্থাৎ নারী বা পুরুষ এ দু’শ্রেণির কোনো একটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে; জটিল আর থাকবে না।

তারপরও, বাহ্যিকভাবে আমাদের উপরিউক্ত আলোচনার প্রতি লক্ষ করলে বোঝা যায়, বাস্তবে হিজড়াদের তিনটি শ্রেণি বিদ্যমান; হোক তা প্রাথমিক বিবেচনায়: ১) পুরুষ হিজড়া, ২) নারী হিজড়া ও ৩) জটিল হিজড়া।

আরব-অনারব দেশে দেশে হানাফী মাযহাহের সর্বাধিক প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য আইনী গ্রন্থ ‘আদদুরুল মুখতার+শামী’-তে কি রয়েছে, তা এ পর্যায়ে লক্ষ করি:-

শায়খ আল্লামা ইবনু আবেদীন র. বলছেন: ‘জেনে রাখুন! নিশ্চিয় মহান আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টি আদম-সন্তানদের নারী ও পুরুষ দু’ভাগে সৃষ্টি করেছেন, যেমন তিনি নিজেই বলছেন: “যিনি তাদের দু’জন হতে বহু নর ও নারী ছড়িয়ে দেন” (নিসা : ০১)।

মহান আল্লাহ্ আরও বলেন: “তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন” (শূরা : ৪৯)। আর তিনি এদের প্রত্যেকের বিধি-বিধান স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন; অথচ যে একই সঙ্গে নর ও নারী, তার ব্যাপারে কোন পৃথক বিধান বয়ান করেননি। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, একজন লোকের মধ্যে একই সঙ্গে নারী ও পুরুষ হওয়ার বিশেষণ একত্র হতে পারে না। আর এমন বৈপরিত্ব হয়ই বা কী করে? (শামী: খ-১০, পৃ-৪৪৬, যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত + গায়াতুল-আওতার: খ-৪, পৃ-৪৯৫; এইচ. এম. সাঈদ কোং, করাচী/আল-বাহরুর রায়িক: খ-৮, পৃ-৩৩৪; যাকারিয়া বুক ডিপো, ইউ. পি. ভারত)। “অর্থাৎ তিনি পুরুষ নারী ও তাদের উভয়শ্রেণির বিধি-বিধানই বর্ণনা করেছেন। অথচ হিজড়াদের বিষয়ে তেমন প্রত্যক্ষ ও পৃথক কিছু বয়ান করেননি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, একজন মানুষ একই সঙ্গে নারী-পুরুষ বিপরীতমুখী উভয় গুণে-বিশেষণে অভিহিত হতে পারে না। তার মাঝে নারী বা পুরুষ সুলভ তথা তেমনটির পরিচায়ক কোনো চিহ্ণ-সংকেত অবশ্যই থাকবে। যদিও তা কখনও কখনও চিহ্ণিত করতে প্রাথমিক পর্যায়ে সংশয় হতে পারে” (প্রাগুক্ত)।

“আর যদি এমন হয় যে, তার কোনো নিদর্শনই প্রকাশ না পায় কিংবা নিদর্শনগুলো পরস্পর বৈপরিত্ব বহন করে, সেক্ষেত্রে পুরুষ বা নারী কোনো একদিক প্রাধান্য দিতে না পারায় তাকে বলা হবে জটিল হিজড়া... (কেবল তখনই সাময়িকভাবে) সব বিধি-বিধানে তার বেলায় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গৃহীত হবে” (শামী: খ-১০, পৃ-৪৪৬, যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত + আল-বাহরুর রায়িক: খ-৮, পৃ-৩৩৪; যাকারিয়া বুক ডিপো, ইউ. পি. ভারত)।

আধুনিক গবেষণা মতে, বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে (২০০০খ্রি. মোতাবেক ১৪২০হি.) বায়রুত ও দামেশক থেকে একযোগে প্রকাশিত, হানাফী মাযহাবকে নতুন আঙ্গিকে সাজানো-গোছানো গ্রন্থ ‘আল-ফিকহুল হানাফী ফী ছাওবিহিল-জাদীদ’ গ্রন্থটির দ্বিতীয় খন্ড, ২৭২ পৃষ্ঠায় বিজ্ঞ আলেম ও ফকীহ্ গ্রন্থকার আল্লামা আবদুল হামিদ মাহমূদ তুহমান ‘জটিল হিজড়া’ প্রসঙ্গে লিখেছেন-

“যদি আদতেই তার কোনো নিদর্শন প্রকাশ না পায় অথবা নিদর্শনগুলোর মধ্যে বৈপরিত্য দেখা যায়, তা হলে সে হবে ‘খুনছা মুশকিল’ তথা জটিল হিজড়া। আর সাবালক হওয়ার পর তেমন জটিল হিজড়া বাস্তবে অনেক কমই পাওয়া যায়। বিশেষ করে আমাদের বর্তমান সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যাওয়ার কারণে এটি বর্তমানে একেবারে সহজ যে, তাঁরা এক্সরে, বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং তার অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ও ব্যতিক্রমী অঙ্গটি অপারেশনের দ্বারা কেটে ফেলতে পারেনগ্ধ (‘আল-ফিকহুল হানাফী ফী ছাওবিহিল-জাদীদ’, দ্বিতীয় খন্ড, ২৭২ পৃষ্ঠা, দিমাশক/কাহেরা, মিসর)। সুতরাং জটিলতা আর থাকলো কই?

মোটকথা শরীয়া আইনের উপরিউক্ত সবগুলো আকরগ্রন্থের ভাষ্য থেকেই দু’টি বিষয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে: ১। মানব জাতির হিজড়া নামে পরিচিত যে ক্ষুদ্র অংশটিকে বর্তমানে আমরা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসাবে জানি, তাদেরকে ১) নারী, ২) পুরুষ ও ৩। নারীও নয় পুরুষও নয় -এমন তিনটি শ্রেণিতে বিভাজন করা যাবে না; যদিও প্রাথমিক অনুসন্ধানে বাহ্যিকভাবে তেমনটি মনে হয়; কিন্তু প্রান্তিক বিবেচনায় তারা নারী বা পুরুষ যে-কোনো এক শ্রেণিতে পরিগণিত হয়ে যাবে। আর সাবালক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যেহেতু কারও কারও বেলায় সংশয় থাকায় তাকে নারী বা পুরুষ কোনো একদিকে গণ্য করা যাচ্ছে না; সে কারণে এবং কেবল তাদের প্রয়োজনে সতর্কতা অবলম্বনের স্বার্থে সাময়িক বিবেচনা হিসাবে পৃথক কিছু বিধি-বিধান আলোচিত হয়েছে -যে সব বিধি-বিধান সব হিজড়া’র ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না।

২। আমাদের ভাষায় যাদেরকে আমরা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বলছি, তারা মূলত তৃতীয় লিঙ্গ নয়। কেননা তাদের একটা বড় অংশ আলোচিত ভাষ্য ও বিধান মতে হয়তো আমাদের অনুরূপ পুরুষের কাতারে অথবা নারীদের কাতারে অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাচ্ছে; আরও একটা সংখ্যা সাবালক হওয়ার পর পুরুষ বা নারীর কাতারে চলে যাচ্ছে। বাকী অত্যন্ত নগণ্য একটা সংখ্যাও প্রয়োজনীয় চিকিৎসান্তে পুরুষ বা নারীর কাতারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। সুতরাং ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ আর অবশিষ্ট থাকলো কোথায়? (চলবে)

লেখক : মুফতী ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বায়তুল মোকাররম, ঢাকা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন