পদ্মাসেতু এখন আর স্বপ্ন নয়। পদ্মা নদীর ওপর পুরো পদ্মাসেতু দৃশ্যমান হবার মধ্য দিয়ে এটি এখন বাস্তবেই অস্তিত্ব লাভ করেছে। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ১২ এবং ১৩ নম্বর পিলারের ওপর সর্বশেষ স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে সবকটি পিলারের ওপর সবকটি স্প্যান বসানো শেষ হয় এবং ফলে পুরো পদ্মাসেতুই এখন দৃশ্যমান। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের অনেক বড় অর্জন, অনেক বড় সফলতা এবং অত্যন্ত গৌরবজনক একটি বিষয়। এই অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন এবং অগ্রগতির নতুন যুগে প্রবেশের দারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ আজ নতুন এক পরিচয়ে পরিচিত হয়েছে। যে পরিচয় সম্মানের, গৌরবের, সফলতার এবং সক্ষমতার। পদ্মাসেতু চালু হলে তা যে কেবল এই সেতুর আশেপাশের জনগণের জীবনমানকে এগিয়ে নেবে তা নয়, বরং এটা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পুরো বাংলাদেশের মানুষের জীবনকেই এগিয়ে নেবে। পুরো দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে পদ্মাসেতু হবে একটি নতুন মাইলফলক। এ ধরনের মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ। তার অসামান্য উদ্যোগ, অসীম সাহস এবং ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা বাংলাদেশের জন্য আজ এই সফলতা, অর্জন এবং গৌরব বয়ে এনেছে।
পদ্মাসেতু আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। ১৯৯৮-৯৯ সালে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ পদ্মাসেতুর প্রাথমিক ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়। পরবর্তীতে ২০০৩-২০০৫ সালে জাইকা এর ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করে। ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার একনেকের বৈঠকে পদ্মাসেতু নির্মাণের জন্য ১০১৬১ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করে। তবে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন হয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পদ্মাসেতু নির্মাণের সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আর পদ্মাসেতু নির্মাণের পথ কখনোই সহজ ছিল না, বরং তা ছিল সব সময় একটি কঠিন পথ। কিন্তু সকল ধরনের বাধা, সমস্যা এবং প্রতিকূলতাকে জয় করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পদ্মাসেতু আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এত বড় প্রজেক্টের অর্থায়ন ছিল বরাবরই একটি বড় সমস্যা। শুরুতে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও আইডিবি পদ্মাসেতু নির্মাণে আগ্রহ এবং প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেও, শেষে তারা তা প্রত্যাহার করে নেয়। ২০১১ সালের জুলাই মাসে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ দাঁড় করায় এবং অনেক কিচ্ছা কাহিনীর জন্ম দিয়ে ২০১২ সালের ৩০ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মাসেতু নির্মাণে অর্থায়ন না করার কথা ঘোষণা করে। এভাবে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতু নির্মাণে অর্থায়ন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তীতে অন্যান্য আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠান এবং দাতা সংস্থাও পদ্মাসেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়। এটি ছিল পদ্মাসেতু নির্মাণে সবচেয়ে বড় বাধা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থার কাছে মাথা নত করেননি, তিনি বরং এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
পদ্মা একটি অত্যন্ত গতিশীল নদী এবং এর গতিপথ বেশ আঁকাবাঁকা। পদ্মা তার দুই তীরের জনপদকে কেবল ভেঙ্গেই চলেছে এবং সেই জনপদকে সব সময় নদী গর্ভে বিলীন করেছে। তাই পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে নদীশাসন ছিল বিরাট একটি চ্যালেঞ্জিং এবং জটিল কাজ। একইভাবে পদ্মা নদীর গভীরতা বেশি এবং তলদেশের মাটির কন্ডিশন দুর্বল হবার কারণে নদীর বুকে পাইলিং করে পিলার নির্মাণ করাও ছিল বেশ জটিল এবং কঠিন। ফলে পদ্মাসেতুর টোটাল ডিজাইনটা খুব জটিল ছিল। কিন্তু পদ্মাসেতু নির্মাণে সরকারের অনমনীয় দৃঢ়তা সকল কঠিন কাজকে সমাধান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এইসিওএম নামক একটি ডিজাইন কোম্পানি পদ্মাসেতুর ডিজাইন করেছে। নদী শাসনের কাজ করেছে চীনের প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। সেতু নির্মাণের মূল দায়িত্বে রয়েছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের তত্ত¡াবধানে ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর পদ্মাসেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় আর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ এবং ৩৮তম পিলারের ওপর প্রথম স্প্যান বসে এবং এর মাধ্যমে মূল অবকাঠামো দৃশ্যমান হতে শুরু হয়। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে পিলার নির্মিত হয় এবং এসব পিলারের ওপর একটার পর একটা স্প্যান বসতে থাকে।
পদ্মাসেতু বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী সেতু। এটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্ত ১৮.১৮ মিটার। এই সেতুতে মোট পিলারের সংখ্যা ৪২টি। প্রতিটি পিলারে ৬টি পাইল রয়েছে এবং নদীর গভীরে সর্বোচ্চ ১২৩ মিটার লম্বা পাইলিং হয়েছে। পাইলিংরে গভীরতার দিক দিয়ে এটি বিশ্বে রেকর্ড করেছে। কারণ নদীর ওপর কোনো সেতু নির্মাণে এত গভীর পাইলিং অতীতে কোথাও করতে হয়নি। মোট ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে পদ্মাসেতুর মূল অবকাঠামো নির্মিত। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১৫০.১২ মিটার। এই সেতুটি স্টিল ট্রাসে নির্মিত এবং তা চীনেই নির্মিত হয়েছে। পদ্মাসেতু হচ্ছে দুই স্তর বিশিষ্ট একটি বহুমুখী সেতু। এর উপরের স্তর চার লেন বিশিষ্ট সড়ক সেতু এবং নিচের স্তর রেল লাইন। উপরের স্তর দিয়ে যান বাহন চলাচল করবে এবং নিচের স্তর দিয়ে রেল চলাচল করবে। পদ্মাসেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণ হবার পর এখন মূল কাজ হচ্ছে ট্রাসগুলোর ওপর পাঠাতন এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র/ইকুইপমেন্ট বসিয়ে একে যানবাহন এবং রেল চলাচলের উপযোগী করা। নদীর ওপর সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মিত হয়ে যাওয়ায় বাকী কাজ সম্পাদনে এখন আর বেশি সময় লাগবে না। আশা করা যায়, ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যেই পদ্মাসেতু যান চলাচলের জন্য সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়ে যাবে এবং ১ জুলাই থেকেই পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু করবে। তবে ২০২২ সালের জুনের আগেও এই সেতু সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য সময়ের আগেই পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে। পদ্মাসেতুর নির্মাণের মোট খরচ তিরিশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যার পুরাটাই বাংলাদেশ সরকার তার নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দিচ্ছে।
পদ্মাসেতুর এক প্রান্তে মুন্সীগঞ্জ এবং অপর প্রান্তে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা। এই সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিরামহীন এবং নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগের অবারিত এক সুযোগ সৃষ্টি হবে। পদ্মাসেতু চালু হবার পর কোনো যানবাহনকে আর পদ্মা নদী পার হবার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না। গ্রীষ্ম, বর্ষা এবং শীত বছরের প্রতিটি দিনেই যে কোনো যানবাহন মাত্র ৫ থেকে ১০ মিনিট সময়েই এই সেতু পার হয়ে যাবে। থাকবে না আর কোনো যানজট, বদলে যাবে চিরচেনা ভোগান্তির দৃশ্যপট। গাড়ি কেবল চলবেই আর চলবেই। ঢাকা থেকে মাত্র চার ঘণ্টায় পৌঁছে যাবে খুলনা শহরে, যা এতদিন ছিল কল্পনারও বাইরে। ফলে মানুষের সময় যেমন বাঁচবে, ঠিক তেমনিভাবে বিপুল পরিমাণে যানবাহনের জ্বালানি তেল বাঁচবে। একই সাথে পরিবহন খরচও কমবে। পদ্মাসেতুর দুই প্রান্তে ইতোমধ্যেই আট লেনের এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মিত হয়েছে। পদ্মাসেতু চালু হবার সাথে সাথেই দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক গতি আসবে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে পড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনে পদ্মাসেতু বিশাল এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এ সেতু বিশাল এই অঞ্চলের ৩ কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নের নতুন এক গতি আনবে। মাদারীপুর, শরিয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, গোপালগঞ্জ, খুলনা, যশোহর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল এবং পটুয়াখালীসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় শিল্পায়ন এবং পর্যটনের বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতদাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, পোল্ট্রি এবং ডেইরি খাতের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন এক সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতদাঞ্চলে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের তাজা তরিতরকারি অতি সহজেই পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকা চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারে যোগান দেয়া যাবে। একইভাবে এতদাঞ্চলে উৎপাদিত মৎস্য, পোল্ট্রি এবং ডেইরি পণ্য স্বল্প সময়েই পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকা চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারে যোগান দেয়া যাবে। মংলা বন্দর এবং নির্মিতব্য পায়রা বন্দরের কাজে নতুন এক গতি আসবে। এ দুটি বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির কাজ বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ জুড়েই উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি জোয়ার আসবে। মোটকথা পদ্মাসেতু বাংলাদেশের জন্য খুলে দেবে অফুরন্ত সম্ভাবনার নতুন এক দুয়ার।
লেখক: প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক
omar_ctg123@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন