শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

পদ্মা সেতুর অর্থনীতি

আবুল কাসেম হায়দার | প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৭ এএম

২০২১ সালে যাবতীয় কাজ শেষ করে ২০২২ সালে পদ্মাসেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া সম্ভব হবে বলে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দিয়েছেন। পদ্মাসেতু নিজস্ব অর্থায়নে স্থাপনে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশ। দেশের মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ ভালো কিছু করতে পারে এবং বাংলাদেশ এখন একটি সক্ষম দেশ- এটা প্রমাণিত হয়েছে। বিশ^ব্যাংকের সঙ্গে সমস্যা, ঋণ স্থগিত ও নানা দীর্ঘসূত্রিতার ফলে সেতুর বাস্তবায়ন কাজ বেশ বিলম্বিত হয়। যে সেতু নির্মাণ শেষ করার কথা ছিল ২০১৪ সালে। এখন সেই সেতু চলার উপযোগী হবে ২০২২ সালে। দীর্ঘ সময় গ্যাপ। তাই ব্যয় বৃদ্ধি। নানা দুনীর্তির অভিযোগও রয়েছে ব্যয় বৃদ্ধির পিছনে। ২০২০ সালের শেষে এসে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। আগামী দুই বছর সময় লাগবে। তাতে ব্যয় আরও বাড়তে পারে। তারপর একটি বড় সেতুর স্থাপনা চালু হতে যাচ্ছে, এটাই আমাদের বড় আনন্দ। আমাদের বড় অর্জন।
পদ্মাসেতু নির্মাণের ফলে দেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক সুপ্রভাব পড়বে। এ বিষয়ে সেতুর ডিজাইন পরামর্শক মনসেল ২০১০ সালে এক বিশ্লেষণ বা স্টাডি রিপোর্ট সেতুর বোনফিট কস্ট রেশিও (বিসিআর) ১ দশমিক ৭ এবং ইকোনমিক ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (ইআরআর) ১৮ শতাংশ উল্লেখ করেছেন। সেতু নির্মাণ ব্যয় যুক্ত হয়ে বিসিআর ২ দশমিক ১ এবং ইআরআর দাঁড়াবে ২২ শতাংশ। অর্থাৎ এ সেতু নির্মাণ অর্থনৈতিক বিবেচনায় লাভজনক হবে। দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ দূরত্ব ২ থেকে ৪ ঘণ্টা কমে আসবে। রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ পথ হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, কাঁচামাল সরবরাহ সহজলভ্য হবে এবং শিল্পায়নের প্রসার ঘটবে, অর্থাৎ ছোট বড় নানা শিল্প কারখানা ২১টি জেলায় গড়ে উঠবে। কৃষির ব্যাপক উন্নতি ঘটবে। কৃষক পণ্যমূল্য ভাল পাবে। উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ডিজাইন পরামর্শক ছাড়াও বিশ^ব্যাংকের স্বাধীন পরামর্শক এবং সেতু বিভাগ নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও সেতু নির্মাণের অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করেছে। এসব সমীক্ষা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে যে, সেতু নির্মাণের অর্থনৈতিক প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ এবং দেশের সার্বিক জিডিপি ১ শতাংশের অধিক হারে বাড়বে।
পদ্মাসেতু নির্মাণের ফলে দেশের সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোর উন্নতি হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে (এন-৮) ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপিত হবে। সেতুর উভয় পাড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও প্রাইভেট শিল্পনগরী গড়ে উঠবে। বিনিয়োগ বাড়বে এবং বাড়বে কর্মসংস্থান। মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর সচল হবে। পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে এবং দক্ষিণ বাংলার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু মাজার, মাওয়া ও জাজিরা পাড়ের রিসোর্টসহ, নতুন পুরানো পর্যটন কেন্দ্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হবে। বর্তমানে ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী, পদ্মানদী পার হয়ে যেখানে ১২ হাজার যান চলাচল করে, সেখানে সেতু খুলে দিলেই যান চলাচল দ্বিগুণ হতে পারে এবং প্রতি বছর যানবাহন ৭-৮ শতাংশ বেড়ে ২০৫০ সালে ৬৭ হাজার যানবাহন চলবে। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ আমরা বিশ্বাসযোগ্য ধরে নিতে পারি। কারণ, আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখছি যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতুর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে যানবাহন বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভোগ-চাহিদা বৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, বাস্তবে প্রসার ঘটেছে এর চেয়ে আরও বেশি।
যে কোনো সেতু বা স্থাপনার ব্যয় নির্বাহ করার জন্য টোল আদায় করার নিয়ম সব দেশে রয়েছে। নিজস্ব অর্থায়ন বা ঋণে সেতু হলেও টোল আদায় ছাড়া বড় প্রকল্পের কোনো উপায় থাকে না। আমাদের দেশে ছোট ছোট সেতুর টোল এখনও আদায় করা হচ্ছে। যা করা উচিত নয়। একমাত্র জাতীয় ভিত্তিক, বড় স্থাপনার টোল আদায়ের নিয়ম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে। কাজেই পদ্মাসেতু থেকে টোল আদায়ের মাধ্যমে সেতুর অর্থ আদায় করতে হবে। করা উচিতও হবে। তবে কত হবে, কীভাবে হবে, কত বছরের মধ্যে এই খরচের অর্থ আদায় করা হবে, ইত্যাদি আলোচনার বিষয়।
পদ্মাসেতুর ব্যয় নির্বাহের জন্য সেতু বিভাগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ২৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকার এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ১ শতাংশ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে ১৪০ কিস্তিতে এই ঋণের অর্থ সেতু বিভাগ পরিশোধ করবে। কাজেই টোল এমনভাবে আদায় করতে হবে, যাতে ঋণের অর্থ ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় খরচ টোল থেকে করা যায়। বর্তমানে ফেরি পারাপার খরচের চেয়ে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করলে ঋণের টাকা সহজে শোধ করা যাবে। কিন্তু এইটি করা ঠিক হবে না। তাতে জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। যে কারণে পদ্মাসেতু করা, তার উপকার আমরা পাবো না। পণ্যের আনা-নেয়ার ব্যয় বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষ উপকার পাবে না। তাই ঋণের চুক্তির মেয়াদ কমপক্ষে ৫০ বছর করে সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে। তার ফলে টোলের আদায়কৃত অর্থ কম হবে। যানবাহনের ব্যয় কম হবে। পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল থাকবে। কৃষক ও ব্যবসায়ী সকলে উপকৃত হবে।
যেমন যমুনা সেতুর কথা বলুন। এই সেতুর টোল অধিক। সেতুর খরচের অর্থ ইতোমধ্যে আদায় হয়ে গিয়েছে। অথচ সেতুর টোল এখনও কমানো হয় নাই। যমুনা সেতুর টোল কমানো উচিত। তাতে পণ্যের ব্যয় কমবে। মানুষ উপকৃত বেশি হবে। পণ্য আনার খরচের ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে বগুড়ার ৩ টাকার মূল্যের সবজি ঢাকায় আমাদের ৩০ টাকা কিনতে হয়। অনুরূপ পদ্মাসেতুর টোল অধিক হারে হলে পণ্য মূল্যে স্থিতি থাকবে না।
অর্থনীতিবিদদের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্বাস, পদ্মাসেতু চালু হলে দেশের সার্বিক দারিদ্র্যতার সূচক হ্রাস পাবে। মানুষের আয় রোজগার বাড়বে। পদ্মাসেতুর এপার ও ওপারে নানা স্থাপনা গড়ে উঠবে। শিল্পের উন্নয়ন ঘটবে। যার ফলে মানব উন্নয়ন সূচকের অনেক অগ্রগতি হবে। যানবাহনের এই টোল আদায়ও আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধির বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।
বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিভিন্ন সামাজিক সূচকের ক্রম উন্নতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। পদ্মাসেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থে করার কারণে বাংলাদেশের সক্ষমতার স্বীকৃতি মিলেছে। আমরা পারি। আমরা সক্ষম। আমাদের মেধা আছে। আমাদের জ্ঞান অন্যদের চেয়ে কম নয়। এই সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকলের নিকট অতুল্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। আমরা চাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদ্মাসেতু চালু হোক। অর্থনীতিতে সুবাতাস প্রবাহিত হোক।
লেখক: সাবেক সহ-সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি, ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন