শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

কুষ্ঠ চিকিৎসায় আরো গুরুত্ব দিতে হবে

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন | প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৩ এএম

কুষ্ঠ মানবেতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো রোগসমূহের অন্যতম। পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্ম, যথা- হিন্দু, খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মের ধর্ম গ্রন্থসমূহে এ রোগের উল্লেখ রয়েছে। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাসমূহের লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত মিসর, চীন, গ্রিক, রোম, ভারত ইত্যাদি প্রায় সব কটি দেশের ইতিকথায় এর বিবরণ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এ রোগের ইতিহাস চার হাজার বছরের পুরনো। এ রোগের সবচেয়ে পুরনো কংকাল-নির্ভর প্রমাণ মেলে ভারতবর্ষে, যা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব দু’ হাজার সালের সময়কার। তবে, রোগটির সাথে মানুষের পরিচয় কয়েক হাজার বছর আগের হলেও, এর প্রকৃত কার্য-কারণ তাদের জানা ছিল না। তেমনি এর কোন চিকিৎসাও তাদের আয়ত্তে ছিল না। ফলে, শত সহস্র বছর ধরে এ রোগকে কেন্দ্র করে চলে আসে নানাবিধ অলীক ধারণা ও কুসংস্কার, যার নির্মম শিকার হয়ে সমাজে যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর নিপীড়িত, নিগৃহীত হয়েছে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। কোথাও এটাকে মনে করা হয়েছে বিধাতার অভিশাপ, কোথাও বা পাপাচারের ফসল। এ রোগের কার্যকারণ বা প্রতিকারের বিষয়ে তেমন কিছু না জেনে থাকলেও মানুষ এটুকু বুঝতে পেরেছিল যে, এ রোগ ছোঁয়াচে, জন থেকে জনান্তরে ছড়াতে পারে। ফলে, সমাজের স্বার্থপরতার বলি হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হতে হয়েছে অস্পৃশ্য, কোথাও সমাজচ্যুত, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে লোকালয় থেকে নির্বাসিত।

দিন বদলেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ আমরা কুষ্ঠের কার্য-কারণ, এর লক্ষণাদি ও ক্রমধারা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল। এর কার্যকর চিকিৎসাও আমাদের আয়ত্তে। এক্ষেত্রে মাইলফলক ছিল ১৮৭৩ সালে নরওয়ের বিজ্ঞানী গেরহার্ড হ্যানসেনের যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই কৃতী বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন, কুষ্ঠ আসলে একটি জীবাণুঘটিত রোগ, যা একটি ধীরলয়ে বিকাশমান ব্যাকটেরিয়ার কারণে ঘটে। এই ব্যাকটেরিয়াটি আজ আমাদের কাছে Mycobacterium leprae নামে পরিচিত। সেই থেকে এ রোগটিও হ্যানসেন’স ডিজিজ নামে পরিচিতি লাভ করে।

কুষ্ঠ চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসে ৪০-এর দশকে ডেপসন নামের এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। এ ওষুধটির সীমাবদ্ধতার মধ্যে ছিল, এটি বহু বছর তথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আজীবন খাওয়া লাগত, যে কারণে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রোগীর অনুবর্তিতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়াত। তা সত্ত্বেও এটি প্রায় দু’ দশক ধরে কুষ্ঠ চিকিৎসায় প্রধান অবলম্বন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু, ৬০-এর দশকে এসে Mycobacterium leprae ডেপসনের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট হয়ে উঠতে শুরু করে। এ সময়টাতে রিফামপিসিন ও ক্লোফাজিমিন নামের এন্টিবায়োটিক দুটি আবিষ্কৃত হয়। কুষ্ঠ চিকিৎসায় ডেপসনের সাথে এ দুটি এন্টিবায়োটিক যোগ করে দেখা গেল, ওষুধ তিনটির সমন্বিত চিকিৎসা বেশ কার্যকর। তখন থেকে কুষ্ঠের চিকিৎসায় এই মাল্টি ড্রাগ থেরাপি (এমডিটি) চলে আসছে। এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা শুরুর পর দ্রুত রোগীর অবস্থায় উন্নতি দেখা দেয়। তবে, রোগ যাতে ফের ফিরে না আসে তা নিশ্চিত করতে দু’ বছরের মতো চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

কুষ্ঠ রোগের জন্য দায়ী জীবাণু Mycobacterium leprae রোগীর হাঁচি-কাশির সময় নির্গত কণার সাথে বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। জিনগত বৈশিষ্ট্যের বিচারে সংবেদনশীল কোন দুর্বল ইমিউনিটির লোক যদি দীর্ঘদিন এ ধরনের রোগীর সান্নিধ্যে থাকে এবং পুনঃ পুনঃ তাঁর হাঁচি-কাশিতে নির্গত জীবাণু-বাহী কণা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে, তাহলে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ইমিউনিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবাণুর সংস্পর্শে আসলেও ৯৫% প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি শক্তিশালী ইমিউনিটির কল্যাণে এ রোগে আক্রান্ত হয় না। শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ, এ রোগের জীবাণু অক্ষত ত্বক ভেদ করে দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। সাধারণত জীবাণু দেহে প্রবেশের ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ শরীরে দেখা দেয়। ক্ষেত্রবিশেষে লক্ষণ প্রকাশ পেতে এমনকি ১৫ থেকে ২০ বছরও লেগে যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে এ রোগে প্রান্তিক স্নায়ুসমূহ, ত্বক, চক্ষু ও শ্বসনতন্ত্রের উর্ধ্বভাগের শ্লেষ্মাঝিল্লি আক্রান্ত হয়। ত্বকে ছোপ ছোপ দাগ/ গোটা গোটা দানা ও পরবর্তীতে ক্ষত, এ সব অংশে অনুভূতি হ্রাস/ বিলোপ, হাত-পায়ে অবশ ভাব ও দুর্বলতা এবং মুখমন্ডল ও কানের লতিতে ফোলা ভাব দেখা দিতে পারে। চিকিৎসা নেয়া না হলে, আরও পরে তা অঙ্গ বিকৃতি/ অঙ্গ হানি, হাত-পায়ের নড়া-চড়ায় সমস্যা, এমনকি অন্ধত্বের মতো শারীরিক প্রতিবন্ধতায় পরিণতি লাভ করতে পারে।

মাল্টি ড্রাগ থেরাপি (এমডিটি) প্রবর্তনের পর থেকে বিশ্বে কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ৮০-এর দশকে যেখানে বিশ্বে কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা ছিল ৫২ লাখ, তা এখন ২ লাখে নেমে এসেছে। তবে, যে বিষয়টি এখনো যথেষ্ট উদ্বেগের তা হল, বিগত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে নজর দিলে দেখা যায়, প্রতি বছর ২ লাখের উপর নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এর ৫৬ শতাংশই শনাক্ত হয়েছে ভারতে। এরপর একাধিক্রমে রয়েছে ব্রাজিল (১৩.৬%), ইন্দোনেশিয়া (৮.৫%), নেপাল (১.৯%) ও বাংলাদেশ (১.৮%)। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশে নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৩,৫০০ থেকে ৪,০০০ -এর মধ্যে ছিল। বিশ্বে কুষ্ঠে আক্রান্ত রোগীর প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। ধারণা করা হয়, প্রায় ৪০ লাখের মতো রোগী শনাক্তকরণের অপেক্ষায় আছে, যাদের দক্ষ চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ত যোগানের অভাবে এখনও শনাক্ত করা যায়নি।

বাংলাদেশে সরকারি/ বেসরকারি উদ্যোগে কুষ্ঠ নির্মূলে জোরালো কর্মসূচি চলমান রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা প্রতি ১০,০০০ জনে ১ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা সেই ১৯৯৮ সালেই অর্জিত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সবাইকে কাজ করে যেতে আহবান জানিয়েছেন। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের ন্যাশনাল লেপ্রোসি প্রোগ্রাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লােবাল লেপ্রোসি স্ট্রাটেজি (২০১৬-২০২০)-এর আলোকে প্রণীত ন্যাশনাল লেপ্রোসি স্ট্রাটেজি বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিল। দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কুষ্ঠ চিকিৎসার জন্যে তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। তাছাড়া, একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধের তথ্য অনুসারে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে জেলা সদর ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এ সব হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের জন্য জীবাণু নিরূপণ, স্কিন বায়োপ্সি, নার্ভ বায়োপ্সি ও অন্যান্য ইমিউনোলজিক্যাল পরীক্ষারও ব্যবস্থা আছে। দ্য লেপ্রোসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিএলএমআই-বি) সহ বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মাধ্যমে কুষ্ঠরোগীর চিকিৎসা করে যাচ্ছে। উপরন্তু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধসমূহ (এমটিডি) বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। মোট কথা, দেশে কুষ্ঠ চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা নেহাত মন্দ নয়। তবে, হ্যা, রোগের এডভান্সড স্টেজে অনেক রোগীর নানাবিধ শারীরিক বৈকল্য দেখা দেয়, যাতে সার্জারি সহ বিশেষায়িত চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। এজন্যে বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন চিকিৎসক ও সফিস্টিকেটেড যন্ত্রপাতি এবং সঙ্গতকারণেই অধিকতর অর্থের যোগানের প্রয়োজন হতে পারে, যা হয়তো এখনও চাহিদার নিরিখে যথেষ্ট নয়।

যে প্রশ্নটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেখা দেয় তা হল, এত কিছুর পরেও বছর-ওয়ারি নতুন রোগী সনাক্তের পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে কি মনে হয় না, আমরা গত দশ বছর ধরে এক জায়গায় স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি? মনে রাখা দরকার, নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যার বিচারে আমরা বিশ্বে শীর্ষ পাঁচের মধ্যে অবস্থান করছি। কাজেই, আমরা যদি কুষ্ঠ মুক্ত দেশ গড়তে চাই, আমাদের এ জায়গাটায় বিশেষভাবে মনোযোগ নিবদ্ধ করা দরকার। রোগের বিস্তার ঠেকাতে হবে, নতুন নতুন রোগী সৃষ্টির রাস্তা বন্ধ করতে হবে। তা কীভাবে সম্ভব? দেখা গেছে, মাল্টি ড্রাগ থেরাপি শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই রোগীর রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা লোপ পায়। এছাড়াও, একজন কুষ্ঠ রোগীকে রোগের প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসার আওতায় আনা গেলে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন, কোন রূপ অঙ্গহানির আশংকা থাকে না। কাজেই, আমাদের যেটা দরকার তা হল, দেশের কুষ্ঠপ্রবণ এলাকাসমূহের সম্ভাব্য কুষ্ঠ রোগীদের যথাসম্ভব রোগের প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসার জন্য একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়া। এটার জন্যে কুষ্ঠের লক্ষণাদি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য ব্যাপকভিত্তিক গণপ্রশিক্ষণ ও প্রচারণা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। স্কুল-কলেজ ও মসজিদ-মাদরাসার মতো প্লাটফর্মসমূহ এবং এলাকার সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনসমূহকেও এতদুদ্দেশ্যে কাজে লাগানো যেতে পারে। জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন