বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

হিজড়া-৩ : তৃতীয় লিঙ্গ?

মুফতী মোঃ আবদুল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

প্রিয় পাঠক! আমরা উপরিউক্ত আলোচনা থেকে অর্থাৎ সূরা নিসা আয়াত নং ১ ও সূরা শুরা আয়াত নং ৪৯ থেকে এবং তার সমর্থনে আল্লামা শামী’র ব্যাখ্যা ও বক্তব্য (“এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, একজন লোকের মধ্যে একই সঙ্গে নারী ও পুরুষ হওয়ার বিশেষণ একত্র হতে পারে না। আর এমন বৈপরিত্ব বা স্ববিরোধ হয়ই বা কী করে?”) দ্বারাও বোঝা যাচ্ছে, প্রাথমিক পর্যায়ে বা বাহ্যিকভাবে যদিও আমরা দেখি দেখি যে, হিজড়া বা জটিল হিজড়া বলতে বাস্তবে কিছু সংখ্যক মানবের অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু প্রান্তিক বিবেচনায় তারা সকলেই হয়তো বা পুরুষের মধ্যে গণ্য হবে কিংবা নারীর মধ্যে পরিগণিত হবে; তৃতীয় স্তর বা তৃতীয় শ্রেণি বা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বলতে তেমন কিছু ধর্তব্য হবে না। অর্থাৎ পুরুষের নিদর্শন থাকলে পুরুষ, নারীর নিদর্শন থাকলে নারী বলে গণ্য হবে; আর যার বেলায় জটিল কিছু মনে হবে তাকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা’র মাধ্যমে হয় নারী বা পুরুষ যে-কোন এক শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হবে। সুতরাং জটিল হিজড়া’র সমস্যা আর থাকলো কোথায়?

এখানে আরও উল্লেখ্য যে, আল্লামা শামী’র উল্লেখের বাইরেও আরেকটি আয়াত পবিত্র কুআেনের সূরা হুজুরাতে রয়েছে (আয়াত নং ১৩), যা থেকে আরও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ্ যেমনিভাবে একজন পুরুষ ও একজন নারী (বাবা আদম ও মা হাওয়া) হতে মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন; যা আয়াতটির সাধারণ তরজমা ও তাফসীর থেকে বোঝা যাচ্ছে। একইভাবে তিনি মানব জাতিকে কেবল নারী বা পুরুষ -এ দু’শ্রেণিতেই বিভক্ত করে সৃষ্টি করেছেন; তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে মানব জাতির আরেকটি শ্রেণি সৃষ্টি করেননি। অবশ্য এক্ষেত্রে আমরা ‘মিন্ যাকারিঁও ও উন্ছা’ এর ‘মিন্’ হরফটিকে ‘মিন্ বয়ানিয়া’ বা ‘মিন্ তাব‘ইদ্বিয়া’ হিসাবে ধরে নিতে পারি। যেমন-

“হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, (কিংবা ‘তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, পুরুষ ও নারী হিসাবে’ অর্থাৎ তৃতীয় কোনো শ্রেণি বা তৃতীয় কোনো লিঙ্গ নয়) পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার”। লক্ষ্যণীয় যে, একে-অন্যের সঙ্গে পরিচিতির প্রয়োজনে কাউকে ‘হিজড়া’রূপে সৃষ্টি অত্যাবশ্যক নয়।

এ ছাড়া, ইতোপূর্বে আমরা এও আলোচনা করেছি যে, জটিলতা বা সমস্যা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের বর্তমান উন্নতির পূর্ব পর্যন্ত ছিল বটে; কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এখন আর সেই জটিলতা নেই বলে আমরা ধরে নিতে পারি। তবে হ্যাঁ, এটা ভিন্ন কথা যে, এক্ষেত্রে সরকার ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার প্রয়োজন আছে ও থাকবে। কেননা সব পরিবারের তেমন সফল চিকিৎসা ও সার্জারি করানোর মত আর্থিক সামর্থ ও সঙ্গতি নাও থাকতে পারে।

মোটকথা শরীয়া আইন গ্রন্থাদির উক্ত প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত ও আলোচনার বিবেচনায় চিন্তা করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলামী আইন তথা পবিত্র কুরআনেও ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বিষয়টির সমর্থন নেই; হাদীস শরীফেও তৃতীয় লিঙ্গ বিষয়টির সমর্থন নেই। হাদীস শরীফে বরং সংশ্লিষ্ট হিজড়াকে সম্পদের উত্তরাধিকার প্রশ্নে পুরুষ গণ্য করা হবে, না কি নারী? তার বর্ণনা নিন্মোক্ত হাদীসটিতে পাওয়া যাচ্ছে যেমন-

“রাসূল স.-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, একজন হিজড়া কোন্ প্রক্রিয়ায় ওয়ারিস হবে? নবীজী স. জবাবে বললেন: ‘প্রস্রাবের স্থান বিবেচনায়’ (মুসনাদে দারেমী সূত্রে উদ্ধৃত, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৬১)। একই রকম বর্ণনা হযরত আলী রা. সূত্রেও উদ্ধৃত হয়েছে। আবার ইসলাম-পূর্ব জাহেলিয়া যুগেও হিজড়াদের বেলায় তেমন বিধানই ছিল, তাই ইসলামও তা বহাল রেখেছে (আল-মুসতালাহাত ওয়াল-আলফাযুল ফিকহিয়্যা: খ-২,পৃ-৫৯-৬০, মিসর)। অর্থাৎ নারীসুলভ গুপ্তাঙ্গ হলে সে নারী হিসাবে ওয়ারিস হবে, আর পুরুষসুলভ গুপ্তাঙ্গ হলে সে একজন পুরুষ হিসাবে ওয়ারিস হবে।

আর ইতোপূর্বে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করে এসেছি যে, একজন হিজড়াকে নারী বা পুরুষ গণ্য করার ক্ষেত্রে সাধারণত সমস্যাটি হয়ে থাকে সাবালক হওয়ার পূর্বে। সাবালক হওয়ার পর আর তেমন জটিলতা সাধারণত থাকে না। তারপরও, ব্যতিক্রম ২/১ জন ‘জটিল হিজড়া’ নামে যারা থাকে, তাদের ব্যাপারটিও এখনকার উন্নত প্রযুক্তি ও চিকিৎসা ব্যবস্থার দরুন জটিল আর থাকছে না। সুতরাং আমরা এ আধুনিক যুগে উপনীত হয়েও ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ এর দিকে যাবো কেন? যেখানে খোদ ইসলামী শরীয়তেও তার তেমন জোরালো কোন প্রমাণ ও সমর্থন নেই।

সঙ্গত প্রশ্ন : প্রশ্ন জাগে যে, আপনার বক্তব্য মতে, তৃতীয় লিঙ্গ বিষয়ে খোদ পবিত্র কুরআন ও সুন্নায় যেখানে তেমন একটা শ্রেণি বা শ্রেণিবিন্যাস নেই; তা হলে ফিকাহ ও ফাতাওয়া’র গ্রন্থাদিতে ‘খুনছা’ বা হিজড়াদের ব্যাপারে এতো সব আলোচনার অর্থ বা প্রয়োজন কি ছিল? তার জবাব হল:

প্রথমত: হিজড়া নামক একটা শ্রেণি বা আমাদের অনুরূপ কিছু সংখ্যক মানুষ তো বাস্তবে বিদ্যমান। তাই, মৌল বিবেচনায় তাদের কথা মৌল অন্যতম দলীল ‘হাদীস শরীফে’ আছে; কিন্তু প্রথম ও প্রধান দলীল কুরআনে তাদেরকে যেহেতু পৃথক একটা শ্রেণি হিসাবেও নয় এবং পৃথক বিধান দিয়েও আলোচনা করা হয়নি। সে কারণে আমরাও তাদেরকে পৃথক একটা শ্রেণির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত বা গণ্য করতে পারি না এবং পৃথক লিঙ্গে পার্থক্য টেনে বৈসম্যের জন্ম দিতে পারি না।

দ্বিতীয়ত: হাদীস থেকে যে-টুকু নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে, তাও কেবল এটুকু যে, তাদেরকে হয়তো পুরুষ অথবা নারী যে-কোনো এক লিঙ্গে শ্রেণিভুক্ত করে সেই বিবেচনায় সম্পদের উত্তরাধিকার প্রদান করা; তৃতীয় লিঙ্গে পরিগণিত করে তৃতীয় শ্রেণির উপযোগী পৃথক ও ভিন্ন কোনো বিধান বা ব্যাখ্যা তাদের বেলায় প্রদান করা হয়নি।
তৃতীয়ত: ফিকহ ও ফাতাওয়া বিষয়টিই হচ্ছে বাস্তব ব্যবহারিক নির্দেশনা ও বিধি-বিধান সংক্রান্ত। বাস্তবতার নিরীখে সাবালক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যেহেতু একজন হিজড়াকে পুরুষ বা নারী হিসাবে চিহ্ণিত ও শ্রেণিভুক্ত করা কিছুটা জটিল অথচ এমতাবস্থায়ও তার সম্পদশালী বাবা বা মা কেউ মারা গেলে, অন্যদের সঙ্গে তারও উত্তরাধিকারের প্রাপ্য হিস্যা বণ্টণের প্রশ্ন দেখা দেয়; তার সালাত ইত্যাদি বিধান পালনের ক্ষেত্রে সে কি একজন নারীর অনুরূপ সালাত আদায় করবে, না কি একজন পুরুষের অনুরূপ কায়দায় তা সম্পাদন করবে? সে মারা গেলে তাকে ছেলে গণ্য করে তার জানাযা পড়া হবে, না কি তাকে মেয়ে গণ্য করে সেভাবে কাফন ও দু‘আ ইত্যাদি পড়া হবে? -এসব বিবেচনা করে তো ফিকহ-ফাতাওয়ার ইমামগণ ও তাঁদের গ্রন্থাদিতে বিস্তারিত আলোচনা ও সমাধান প্রদান ব্যতীত ভবিষ্যত মুসলিম উম্মাহ্র গত্যান্তর ছিল না। সুতরাং তাঁরা সে কাজটিই করেছেন এবং এক্ষেত্রে তাঁরা যথাযথ হক আদায় করেছেন।

কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করে হিজড়াদের আরেকটি শ্রেণি ও তৃতীয় প্রকারের বিধি-বিধান গ্রন্থবদ্ধ বা বিধিবদ্ধ তাঁরাও করে যাননি। ব্যতিক্রম যেটুকু করেছেন তাও সাময়িক সমস্যার প্রয়োজনে ব্যতিক্রম হিসাবেই করেছেন। উদাহরণত, কেউ মারা গেল এবং তার সন্তানদের মাঝে ছোট একটা হিজড়া বাচ্চাও রয়েছে; সাবালক না হওয়ার দরুন তাকে কী গণ্য করা হবে? তা স্পষ্ট নয়। আবার ত্যাজ্য সম্পদ বন্টণেরও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় কেবল ওই ব্যতিক্রমী বিধান অর্থাৎ ‘তাকে ছেলে বিবেচনা করলে, কত অংশ পায়? আর মেয়ে বিবেচনা করলে কত অংশ পায়? উভয় বিবেচনার ক্ষেত্রে যে-অংশটি ছোট হবে, তা তাকে প্রদান করা হবে।’
উক্তরূপ এমন ব্যতিক্রমী বিধান বা ব্যাখ্যা তো অহিজড়াদের ক্ষেত্রেও রয়েছে, যেমন পারিবারিক সম্পদ বন্টণ প্রয়োজনে উপস্থিত সময়ে ‘হামল’ তথা গর্ভস্থিত সন্তানটিকে ছেলে ধরা হবে, না কি মেয়ে? -সেক্ষেত্রেও এমন ব্যতিক্রমী ও সাময়িক বিবেচনায় কাজ চালিয়ে যেতে হয়; যা আলেমগণের জানা।

একইভাবে নিরুদ্দেশ ব্যক্তি বা তেমন ওয়ারিসের বেলায়ও এমন সাময়িক বিবেচনা’র প্রয়োজন হয়ে থাকে। অথচ এখানে যেমন সন্তানটি ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় ঠিক তেমনি সাবালক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে সংশ্লিষ্ট হিজড়া’র ব্যাপারটিও স্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমাদেরকে তৃতীয় লিঙ্গের দিকে যেতে হবে কেন? এই তৃতীয় লিঙ্গের দিকে যাত্রা মানেই তাদেরকে স্বজন-পরিবার, আইন-আদালত ও রাষ্ট্রের সহযোগিতার মাধ্যমে আরও আপন করে নেয়া, একাকার করে নেয়া, জটিলতা কমানোর চেয়ে বরং প্রকারান্তরে জটিলতা আরও বৃদ্ধি, তাদেরকে পৃথক করে দেয়া, দূরে ঠেলে দেয়ারই নামান্তর হয়ে যাচ্ছে না?

রাষ্ট্র যেখানে তৃতীয় লিঙ্গ ঘোষণা করেছে
অবশ্য জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদেরকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ ঘোষণা’র যেসব কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, তা বিস্তারিত অধমের জানা নেই। হয়তো তাঁদের কাছে তেমন কোনো যুক্তি ও বিবেচনা থাকতে পারে যা অধম অনবহিত; অথবা এমনটিও হতে পারে যে, আমরা ইসলামী শরীয়তের উক্তরূপ স্পষ্ট ও বিস্তারিত নির্দেশনা যথা সময়ে দেশ ও জাতির কাছে তুলে ধরতে পারিনি। যে কারণে তাঁরা তেমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। অধমের দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা এ প্রবন্ধের অনুরূপ স্পষ্ট করে ও সবিস্তারে বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সক্ষম হলে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্যই পুন বিবেচনার সুযোগ পাবেন।

নিরপেক্ষ বিবেচনা: ইনসাফপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে একটু ভেবে দেখি যে, আমার বা আপনার অহিজড়া একটি সন্তান যদি অন্ধ হয় বা আতুর হয় বা পাগল হয় বা অন্য যে কোনোভাবে প্রতিবন্ধী হয়; তাকে কি শরীয়ত নারী বা পুরুষ এই দুই লিঙ্গের বাইরে হিসাব করে তৃতীয় লিঙ্গের আওতায় গণ্য করেছে? কিংবা এদের বেলায় উদাসীনতার সুযোগ রেখেছে? না। তা হলে হিজড়াদের ক্ষেত্রে আমরা বা রাষ্ট্র তেমনটি করতে যাবে কেন? হিজড়ারাও তো এদেরই অনুরূপ এক রকম প্রতিবন্ধী বলে গণ্য হতে পারে মাত্র! যদিও অপরাপর প্রতিবন্ধীদের তুলনায় এসব হিজড়ারা অনেক বেশি শক্তিশালী, সক্ষম ও কর্মট বটে; যদি আমরা তাদের সমাজ-সংসারের কাজে লাগাতে পারি।
লেখক : ইসলামি ফাউন্ডেশন, বায়তুল মোকাররম, ঢাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন