শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাও যোগ্যতা নয়, রাজনৈতিক বিবেচনা ও ব্যক্তিপছন্দকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জেষ্ঠ্য শিক্ষকদের অভিযোগ: নিয়োগে এই অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির কারণে অযোগ্য ও অনুপযুক্তরা শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ লাভ করেছেন। এতে শিক্ষার মানে যেমন অবনতি ঘটছে, তেমনি উপযুক্ত জ্ঞানবান ডিগ্রীধারার সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। ভাইস চ্যান্সেলরগণ বা প্রভাবশালী শিক্ষকবৃন্দ তাদের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সিলেকশন কমিটি ও সিন্ডিকেটগুলোকে বাধ্য করছেন তাদের পছন্দের প্রার্থীদের মনোনীত করতে। এক্ষেত্রে তারা আইন-বিধি ও প্রথার কোনো তোয়াক্কা করছেন না। অনেকে মনে করেন, অযোগ্য ও অনুপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ হওয়ার বড় কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপকভিত্তিক রাজনীতিকীকরণ। সরকার ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করে নির্বাহী নির্দেশের মাধ্যমে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ নিয়োগ হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। আর রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলরগণ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না। শিক্ষকই কেবল নয়, অন্যান্য নিয়োগ, শিক্ষকদের পদায়ন, দায়িত্ববন্টন ও প্রমোশনের ক্ষেত্রেও রাজনীতিই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় সঙ্গতকারণেই বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাই সবকিছুর মালিক-মোকতার ও দন্ডমুন্ডের অধিকর্তা হয়ে বসেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্ববিদ্যালয় কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান, যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, মেধার লালন ও গবেষণা হয়ে থাকে। দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, নিয়োগের প্রায় সকল ক্ষেত্রে অযোগ্য ও অনুপযুক্তরা প্রাধান্য পাওয়ায় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা গুরুত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় শিক্ষার মানের পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও গবেষণা প্রায় উঠেই গেছে।

একদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। এখন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় তার নাম থাকেনা। বর্হিবিশ্বে এক সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যথেষ্ট সুনাম ছিল। সুনাম ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ আরো কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার আশায় বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্রছাত্রী আসতো। এখন শিক্ষার মান, গবেষণার মান, পরিবেশের মান কমে যাওয়ায় বিদেশী শিক্ষার্থী বলতে গেলে আসেই না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্বমানের গবেষণা হয়েছে। এখন গবেষণা কমতে কমতে কার্যত প্রান্তিক অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার জন্য বরাদ্দ অবিশ্বাস্যরকম কমেছে। শুধু তাই নয়, এই যৎ সামান্য বরাদ্দও ব্যয় করা সম্ভব হয় না। উৎসাহী গবেষক পাওয়া যায় না। গবেষণার জন্য গাইড-সুপারভাইজার মেলেনা। শিক্ষকদের অধিকাংশের জ্ঞান-গবেষণা চর্চায় নিয়োজিত থাকার চেয়ে দলবাজি ও যে কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনে নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে হতবাক ও বিস্মিত হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে নির্মাণ কাজ, ঠিকাদারি, ক্যান্টিন পরিচালনা পর্যন্ত সর্বত্র এই দুর্নীতি বিস্তার লাভ করেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রের দুর্নীতিকে মানুষ যেভাবে দেখে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিকে সেভাবে দেখেনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক দুর্নীতি তাদের গভীরভাবে আহত করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জাতির ভবিষ্যৎ নাগরিকদের ভালোমন্দের প্রশ্ন জড়িত।

সরকারি-বেসরকারি ক্রয় নিয়ে সাম্প্রতিককালে যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে অবাক হয়ে যেতে হয়। রাস্তা, সেতু ও ভবন নির্মাণের পর অল্পদিনের মধ্যে ভেঙ্গে বা অকেজো পড়ার কারণ যে দুর্নীতি, সেটা ব্যাখ্যা করার অবকাশ রাখেনা। অনুরূপভাবে বিভিন্ন লেনদেনে কমিশনবাজি বা দুর্নীতির কথাও আরো অজানা নয়। দুর্নীতির সঙ্গে অযোগ্যতার একটা নিকট সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত অযোগ্যরা যেমন দুর্নীতি করে তেমনি দুর্নীতির লালন ও বিস্তার ঘটায়। আগেই উল্লেখ করেছি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। একেই বোধ হয় বলা হয়, যদ্দেশে যদাচার। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির সর্বশেষ খবর এসেছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অভিযোগ উঠেছে ভাইস, চ্যান্সেলর অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পরিবারের সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছেন। ছেলেকে সেকশন অফিসার ও মেয়েকে শিক্ষকপদে নিয়োগ দিয়েছেন। স্ত্রীকে অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। অন্যান্য নিযুক্তিতেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি ইউজিসি তদন্ত করছে। ইতোপূর্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরসহ ভাইস চ্যান্সেলর ও রেজিস্টারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ইউজিসির তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া ৩৪ শিক্ষকের নিয়োগ স্থগিত হয়েছে। এর আগেও আরো কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু তার পূর্ণ তদন্ত ও প্রতিবিধান হয়নি। এর পেছনেও যে রাজনীতি প্রধান ভূমিকা রাখছে, তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব দূর করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ই কেবল নয়, অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই দুর্নীতি কমবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা, উপযুক্ততা এবং পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনায় নিলে নিয়োগ যথার্থ ও ন্যায়ানুগ হবে। দুর্নীতি নিরোধে বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে আমলে নিতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন