পূর্ব প্রকাশিতের পর
২। গ্রন্থকার হিজড়াদেরও বিজ্ঞ খাতনাকারী দ্বারা খাতনা করানো’র ব্যাপারেও গুরুত্বারোপ করেছেন এবং তা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত বলেও উল্লেখ করেছেন। আবার তার পাশাপাশি হিজড়াদের আপনজনদের তেমন সঙ্গতি না থাকলে, তার খরচ রাষ্টীয় কোষাগার থেকে বহনের কথাও উল্লেখ (প্রাগুক্ত: পৃ. ৪১৯) করেছেন এবং তা যে প্রজা সাধারণ ও মুসলিম জনগণের অন্যতম কল্যাণ সাধন তা-ও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। -এ থেকে স্পষ্ট যে, তা কতটুকু গুরুত্ব বহন করে। কেননা ‘খাতনা’ বিষয়টিও একটা অন্যতম সার্জিক্যাল ও দৈহিক অপারেশন এর নামান্তর। আর এটি একজন হিজড়া’র বেলায় আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হচ্ছে, এর মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট হিজড়া’র জটিলতা নিরসন সম্ভব এবং তাকে নারী বা পুরুষ হিসাবে চিহ্ণিত ও নির্ধারণের মাধ্যমে তাদেরকে রাষ্ট্রের বিশাল জনগোষ্ঠির সঙ্গে একাকার করে ফেলা; সুশৃঙ্খল জনশক্তি হিসাবে দেশ গড়ার কাজে লাগানোও সম্ভব হতে পারে।
মোটকথা, উপরিউক্ত উদ্ধৃতিগুলো থেকে নতুন করে আমরা- ১) নারী ও পুরুষ হিজড়া নির্ধারণের প্রক্রিয়া, ২) সাবালক হওয়ার পরও জটিল হিজড়া’র অস্তিত্ব এবং ৩) হিজড়ার বেলায় অহিজড়া মুসলিমদের অনুরূপ নামায-রোযা ও উত্তরাধিকারের বিধান প্রয়োগ করা -এই তিনটি বিষয় পেলাম।
তবে ‘জটিল হিজড়া’ এর সমস্যা বা বিষয়টি তো বাহ্যিকভাবে মনে হচ্ছে থেকেই গেল! তা অনেকটা ঠিক বলা যায়, আমাদের প্রাচীন ও প্রচলিত গবেষণা, অনুসন্ধান, কিতাবাদির ব্যাখ্যা-বর্ণনার নিরীখে। কিন্তু-
আধুনিক গবেষণা মতে, বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে (২০০০খ্রি. মোতাবেক ১৪২০হি.) বায়রুত ও দামেশক থেকে একযোগে প্রকাশিত, হানাফী মাযহাবকে নতুন আঙ্গিকে সাজানো-গোছানো গ্রন্থ ‘আল-ফিকহুল হানাফী ফী ছাওবিহিল-জাদীদ’ গ্রন্থটির দ্বিতীয় খন্ড, ২৭২ পৃষ্ঠায় বিজ্ঞ আলেম ও ফকীহ্ গ্রন্থকার আল্লামা আবদুল হামিদ মাহমূদ তুহমান ‘জটিল হিজড়া’ প্রসঙ্গে লিখেছেন-
ছয়. “উক্ত ‘জটিল হিজড়া’র ব্যাপারে, তার নারী বা পুরুষ বিষয়টি স্থিরীকৃত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত, তার ক্ষেত্রে সকল বিধি-বিধানে সতর্কতার দিকটি প্রযোজ্য হবে। সম্পদ বন্টন প্রশ্নে ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর গবেষণাপ্রসূত মতানুযায়ী তাকে ছোট অংশটি দেওয়া হবে। তার প্রক্রিয়া হবে: তাকে পুরুষ গণ্য করলে তার অংশ কত হয়? এবং নারী বলে গণ্য করলে তার অংশ কত হয়? -তা বিবেচনা করতে হবে এবং তার পর তাকে সে হিসাবে ছোট অংশটি প্রদান করা হবে অর্থাৎ যা তুলনামূলক ছোট হয়। আর উক্ত উভয়বিধ বিবেচনা কালীন কোনো ক্ষেত্রে সে যদি (ফারায়েয শাস্ত্রের ‘হিজাব’ বিধান মতে) প্রতিবন্ধকতার দরুন বঞ্চিত হয়; তা হলে সেক্ষেত্রে সে কোনো অংশ পাবে না” (প্রগুক্ত)। অর্থাৎ অন্য অহিজড়ারা যেমন (হিজাব) প্রতিবন্ধকতার কারণে বঞ্চিত হয়ে থাকেন তেমন কারণে হিজড়ারাও বঞ্চিত হবে। এমন নয় যে, কেবল হিজড়া হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট লোকটি বঞ্চিত হচ্ছে।
“সাহেবাইন’ তথা ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ র. বলেন: তাকে পুরুষ ও নারী কল্পনা করলে উভয়টির সমষ্টি যা হবে তার অর্ধেক প্রদান করা হবে। কিন্তু ‘ফাতওয়া’ তথা ‘চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত’ হচ্ছে ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর অভিমত অনুযায়ী। আর তা-ই হচ্ছে, সকল সাহাবীরও অভিমত” (‘আল-ফিকহুল হানাফী ফী ছাওবিহিল-জাদীদ’ : দ্বিতীয় খন্ড, ২৭২ পৃষ্ঠা; দারুল কলম, দিমাশক/কাহেরা, মিসর)। সুতরাং প্রান্তিক বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত প্রশ্নে সাহেবাইন এর অভিমত টেনে আনা এবং এখন আর নতুন করে গবেষণা’র নামে বিরোধ-বিতর্কে জড়ানো যাবে না।
(দুই)
সার-সংক্ষেপ:
-উক্ত উদ্ধৃতিগুলো থেকেও লক্ষণীয়:
১. সমস্যা কেবল ‘জটিল হিজড়া’র ক্ষেত্রে; যে-হিজড়া নারী বা পুরুষরূপে চিহ্ণিত হয়ে গেছে তার ক্ষেত্রে জটিলতার কিছু নেই। যে-কারণে সে স্বাভাবিক নারী-পুরুষের অনুরূপই সম্পদের উত্তরাধিকারী হবে এবং তার মুত্যুজনিত কারণে তার ওয়ারিসরাও অন্যদের অনুরূপ বিধি মোতাবেক তার উত্তরাধিকারী হবে।
২. সমাজ-সংসার ও রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য থাকলে এক সময় ‘জটিল হিজড়া’ও জটিল থাকবে না এবং তাদের ব্যাপারেও বৈসম্যহীন আইনী সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়ে যাবে।
৩. ইতোপূর্বে ‘বাহরুর রায়িক’ ইত্যাদি সূত্রে আলোচিত বিষয়টি অর্থাৎ ‘হিজড়া’দের প্রাপ্য অংশ ঘিরে ব্যাপক যে-আলোচনা বা অভিমতের প্রসঙ্গ বিভিন্ন কিতাবে বিদ্যমান তা কেবল জটিল হিজড়ার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; অন্য দু’প্রকার নারী বা পুরুষ হিজড়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যে-কারণে এ বিজ্ঞ গ্রন্থকার অপরাপর সব বক্তব্য এড়িয়ে গেছেন।
৪. এমনকি হানাফী মাযহাবের বিজ্ঞ ইমামদেরও আরও যেসব ‘তাফসীলী অভিমত’ রয়েছে, যা সাধারণত গবেষণা-অনুসন্ধানের অনিবার্য প্রয়োজনে করা হয়ে থাকে বা করতে হয়েছে; তা-ও তিনি পরিহার করে কেবল সংক্ষেপে ইমাম আ‘যম (র) ও সাহেবাইন-এর অভিমত উল্লেখ করে, সর্বশেষ ও স্থিরীকৃত চুড়ান্ত সিদ্ধান্তটিও জানিয়ে দিলেন। সুতরাং শরীয়া আইন ও গবেষণার ‘উসূল’ (মূলনীতি/নীতিমালা) মোতাবেক এসব নিয়ে নতুন করে গবেষণার কিছুই নেই এবং বিরোধ-বিতর্কেরও আর সুযোগ নেই।
৫. কুরআন-সুন্নাহ্, সাহাবাগণের আমল, চার মাযাবের গবেষক ইমামদের যুগে ও পরবর্তী যুগে ধর্মবিশেষজ্ঞগণ -বিশেষত শরীয়া আইনবিশেষজ্ঞ আলেম গ্রন্থকারগণ আলোচ্য বিষয়টিসহ অপরাপর সব বিষয়েই এতো অধিক পরিমাণে অনুসন্ধান ও অনুপুঙ্খ আলোচনা করে গেছেন যে, বর্তমানে আর নতুন করে এসব ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের কিছু নেই-এই অর্থে যে, আমরা আরও হাজার বছর গবেষণা করেও তাঁরা যা কিছু রেখে গেছেন, তার বাইরে নতুন কিছু দিতে পারবো না। নতুন কিছু দেওয়া তো পরের কথা; দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আমরা তো তাঁরা যা যা গুছিয়ে দিয়ে গেছেন এবং কোন্ বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত কি, চিহ্ণিত করে দিয়ে গেছেন -তাও খুঁজে বের করতে হিমশিম খেয়ে থাকি!
লেখক : মুফতী ঃ ইসলামি ফাউন্ডেশন, বায়তুল মোকাররম, ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন