‘ঘরত আছে তেরো ভাই- পোয়া লইন্না কেয় নাই’। (চট্টগ্রামে লোকমুখে প্রচলিত এই আক্ষেপের মানে হলো: ‘পরিবারে ১৩ ভাই থাকলেও কান্নারত শিশুটিকে কোলে নিচ্ছে না কেউই’)। ‘ধানের শীষ’ প্রতীক হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিএনপি তাদের মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনকে একাকী মাঠে ছেড়ে দেয়। বড় বড় পদধারী নেতা, সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা ভোটের মাঠ থেকে নিজেদের আগাগোড়া সরিয়ে রাখেন। মাঘের শীতে শালচাদর, লেপ-কম্বল মুড়িয়ে আরামসে ছিলেন ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে অন্দরমহলে। কাজেই ভোটে যা হবার তাই হয়েছে। একা শাহাদাতের তো কিছু না। ‘ধানের শীষ’ অর্থাৎ বিএনপির, জাতীয়তাবাদীদের বারোটা বাজলো! সখেদে হতাশায় গতকাল কথাগুলো বললেন বন্দরনগরীর মুরাদপুরে বিএনপির প্রবীণ তৃণমূল নেতা মো. কামরুজ্জামান মামুন।
শুধ্ইু মামুন নন। গেল বুধবারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে বিএনপির শোচনীয় পরাজয়ের হিসাব-নিকাশ মিলাতে পারছেন না দলটির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থক এমনকি নগরীর রাজনৈতিক সচেতন মানুষজন। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় বিরোধ, সহিংসতা, রক্তারক্তি, বিএনপির এজেন্টদের বের করে দিয়ে ভোটকেন্দ্র এমনকি গোপন বুথেও দখলবাজি, প্রশাসনের একচোখা ভূমিকা, ভোটে তাবৎ অনিয়ম-নৈরাজ্য মিলিয়ে বিএনপির পরাজয় ঘটবে এমনটি আগেই ধারণা করা হয়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদাতের স্মৃতি বিজড়িত ‘জাতীয়তাবাদের ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামে তাদের সম্মানজনক পরাজয় অনেকে আশা করেছিলেন। অথচ ‘ধানের শীষে’র লজ্জাজনক হারে হতভম্ব বিএনপির কর্মী-সমর্থকরাই শুধু নন; চট্টগ্রামের রাজনীতি সচেতন নাগরিকমহলও। তাছাড়া চট্টগ্রাম বিএনপিতে যত নেতা তত গ্রুপে বিরোধ-দূরুত্বও এরমধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
এবারের চসিক নির্বাচনে ভোটের অঙ্কে বিএনপির ‘ধানের শীষে’র মেয়রপ্রার্থী শোচনীয় পরাজয়ে জামানতও হারালেন। নির্বাচনে যত ভোট পড়ে তার ৮ ভাগের একভাগ বা ১২ দশমিক ৫০ শতাংশের কম ভোট পেলে প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। চসিক নির্বাচনে মেয়র পদে ভোট পড়েছে ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ। জামানত ফেরত পেতে হলে মেয়র পদপ্রার্থীকে কমপক্ষে ৫৪ হাজার ৪৩৬ ভোট পেতে হতো। অথচ ভোটের ফলাফলে ‘ধানের শীষে’ ডা. শাহাদাত হোসেন পেলেন ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট। আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীকে নবনির্বাচিত সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর কাছে তিনি ৩ লাখ ১৬ হাজার ভোটের পাহাড়সম ব্যবধানে পরাজিত হন। তাছাড়া চসিকের ৫৪ কাউন্সিলর পদের একটিও পায়নি বিএনপি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত পরিষদ এবারই প্রথম বিএনপি-শূন্য।
চসিক মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থীরা ইতোপূর্বে তিনটি নির্বাচনে হেরে যান। তবে ভোটের ব্যবধান ছিল সম্মানজনক। সর্বশেষ বিগত ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত চসিক নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৩৭ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দীনের কাছে পরাজিত হন। তখন ভোটের ব্যবধান ছিল এক লাখ ২৭ হাজার। সকাল আটটায় ভোটগ্রহণ শুরুর আড়াই ঘণ্টা পরই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে এম মনজুর আলমের প্রধান এজেন্ট বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। সেই হিসাবে অল্প সময়েই ‘কমলা লেবু’ প্রতীকে এম মনজুর আলম সাড়ে ৩ লাখ ভোট পান। অথচ এবার নির্বাচনে বিএনপি তাদের পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়াসহ নানা অভিযোগ করলেও শেষ পর্যন্ত ভোটে ছিল। মার্কাও ছিল ‘ধানের শীষ’। অথচ ভোট পড়লো অতিসামান্যই।
চসিক নির্বাচনে বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের খতিয়ান নিয়ে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে চলছে তোলপাড়। দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মী, সমর্থকরা দুষছেন বিএনপি নেতাদের। তারা বলছেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এলাকা পড়েছে ৫টি সংসদীয় আসনে। অতীতে কয়েক দফায় বিএনপির এমপিরা এসব আসনে জয়ী হন। চট্টগ্রামকে বলা হয় বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদের শক্ত-পোক্ত ঘাঁটি। সেই ঘাঁটি আর জনসমর্থন কী হাওয়া হয়ে গেল! তৃণমূলের কর্মীদের সাফ কথা, চসিক মেয়র পদে ‘ধানের শীষে’ প্রার্থিতা দিয়ে চট্টগ্রামের প্রথমসারির নেতা, সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিরা ঘরে বসে থেকেছেন। নেতাদের গাছাড়া ভাব, অদূরদর্শিতা, হটকারিতায় বিএনপির ঘাঁটিতে ‘ধানের শীষে’র ভরাডুবি মেনে নেয়া যায় না। নেতারা ভোটকেন্দ্রমুখী হননি। তৃণমূলের নেতাকর্মী, সমর্থকদের আগ্রহী করতে পারেননি। এমনকি ভোটার জনগণকেও ভোটকেন্দ্রে যেতে উদ্বুদ্ধ করেননি। ছিলেন নির্বিকার। সরকারি দলের কাছে করেছেন অঘোষিত কিংবা অসহায় আত্মসমর্পণ। ভোটের পর সরকার আর নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) দোষ দিয়েই বিএনপির নেতারা দায় এড়াতে চাইছেন।
আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীরা নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে নৌকার মেয়র প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামেননি। তবে তারা চট্টগ্রাম সফর করেন, এলাকায় সরকারি কর্মসূচিতে তৎপর ছিলেন। তাছাড়া দলের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়া, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনসহ অনেক কেন্দ্রীয় নেতা চসিক নির্বাচন ঘিরে চট্টগ্রামে পড়েছিলেন। অন্যদিকে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাতকে মাঠে অনেকটা একা ছেড়ে দিয়ে দলের মহাসচিব তো দূরের কথা কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আহবায়ক গোলাম আকবর খন্দকারের মতো চট্টগ্রামের নেতারাও ‘ধানের শীষে’র প্রচার, গণসংযোগে ছিলেন না।
থানা ও ওয়ার্ড বিএনপির কয়েকজন নেতা বললেন, বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় এটা জেনেই বিএনপি ভোটে অংশ নেয়। তবে সরকার, নির্বাচন কমিশনকে মোকাবেলা করে নির্বাচনে সম্মানজনক ভাল ফল করার মতো কোনো কৌশলই বিএনপি নিতে পারেনি। পারেনি দলের মাঠকর্মীদের উজ্জীবিত করতে। প্রচার, গণসংযোগে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের প্রায় সমানতালে তৎপর ছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত। সেই সুযোগটি ছিল। কারণ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী ও বিদ্রোহীরা মুখোমুখি থাকায় বিএনপিকে প্রচার, গণসংযোগে বাধা দেয়ার তেমন সুযোগ পায়নি তারা।
অথচ বিএনপি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে কেন্দ্রমুখী করতে পারেনি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেখা যায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারের ভিড়। এবার বিএনপির নেতাকর্মীরাও ভোট দিতে যাননি। অনেক এলাকায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী দূরের কথা; কাউন্সিলর প্রার্থীরাও এজেন্ট দেয়নি। মেয়র প্রার্থীকে ঘিরে তাদের প্রচার ও গণসংযোগ সীমিত ছিল। প্রার্থী যেখানে নেতারা ছিলেন সেখানে। অতীতে দেখা গেছে নেতা-কর্মীরা দলে দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রচার ও গণসংযোগ করেছেন। সব মিলিয়ে এবারের চসিক নির্বাচন বিএনপিকে একরাশ হতাশা ছাড়া আর কী ‘উপহার’ ও ‘অর্জন’ এনে দিয়েছে এমনটি প্রশ্ন তৃণমূল নেতা-কর্মীদের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন