এ বিষয়ে আল্লামা ইবনে নুজাইম মিসরী র. তাঁর রচিত প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য শরীয়া আইন ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আল-বাহরুর রায়িক’ ৮ম খন্ড, ৩৩৬-৩৩৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-
“বিবাহ সংক্রান্ত মূলনীতি: পিতা যদি সাবালক হওয়ার পূর্বে আলোচ্য এমন কোন হিজড়াকে কোন মেয়ে’র সঙ্গে বিবাহ দেন অথবা হিজড়া’র স্ত্রী বানান সেক্ষেত্রে ওই বিবাহ আইনত স্থগিত বলে গণ্য হবে; বিবাহটি ‘ফাসিদ’ বলেও গণ্য হবে না; ‘বাতিল’ বলেও গণ্য হবে না; এবং ‘হিজড়া’ বিষয়টি (‘জটিল’ বলে প্রমাণিত ও ধর্তব্য হচ্ছে? না কি ‘পুরুষ’ কিংবা ‘নারী’ যে-কোন এক প্রকারের মধ্যে ধর্তব্য, পরিগণিত হচ্ছে?) যে-পর্যন্ত সুস্পষ্টভাবে স্থিরীকৃত না হয়ে যায় -তারা পরস্পর একে-অন্যের ওয়ারিসও হবে না। কেননা আইনগত বিবেচনায় অনুমোদিত ও বলবৎ বিবাহেরই অনিবার্য ফল বা বিধান দাঁড়ায় তাদের পারস্পারিক একে-অন্যের ওয়ারিস হওয়ার বিষয়টি; অথচ স্থগিত বিবাহের ক্ষেত্রে তো তেমন বিধান প্রযোজ্য হবে না” (‘আল-বাহরুর রায়িক’, ৮ম খন্ড, ৩৩৬-৩৩৭ পৃষ্ঠা)।
“সুতরাং এমতাবস্থায় তাকে তার পিতা যদি কোন মেয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন এবং সে সাবালক হয়ে যায়; তার পুরুষ সুলভ নিদর্শন ইত্যাদি প্রকাশ হয়ে পড়ে; তখন তাদের বিবাহ জায়েয হয়েছে মর্মে ফায়সালা দেয়া হবে। তবে হ্যাঁ, যদি এমন হয় যে, সে ওই স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম, সহবাসে অক্ষম সেক্ষেত্রে তাকে এক বছরের সময়-সুযোগ দেয়া হবে (চিকিৎসা ও সক্ষমতা অর্জনে); যেমন কিনা অহিজড়া কোন (‘ইনীন/ ‘আজিয’) অক্ষম, অপারগকে তার স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসে অক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রদান করা হয়” (প্রাগুক্ত)।
“আর এমন জটিল হিজড়া যদি তার অনুরূপ আরেকজন জটিল হিজড়াকে বিবাহ করে তা হলে সেক্ষেত্রে তাদের উভয়ের অবস্থা স্পষ্ট (একজন পুরুষ, অপরজন নারী) না হওয়া পর্যন্ত বিবাহটি স্থগিত বলে গণ্য হবে। তাদের উভয়ের অবস্থা যদি স্পষ্টভাবে নির্ণীত হয়ে যায়, (এবং একজন পুরুষ ও অন্যজন নারী বলে প্রমাণিত ও ধর্তব্য হয়ে যায়) তখন সেক্ষেত্রে বিবাহটি জায়েয বলে আইনত গণ্য হবে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কোন একজন মারা যায় কিংবা এই প্রশ্ন বা জটিলতা দফা হওয়ার পূর্বে দু’জনই মারা গেল; সেক্ষেত্রে কেউ কারও ওয়ারিস বলে আইনত গণ্য হবে না...” (প্রাগুক্ত)।
আল্লামা ইবনে নুজাইম মিসরী র. এর উক্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও নির্দেশনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে:
১। সাবালক হওয়ার পূর্বে যেহেতু নারী-পুরুষ সুলভ নিদর্শনগুলো পুরোপুরি প্রকাশ ও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না এবং সংশ্লিষ্ট হিজড়ার বেলায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করা যাচ্ছে না। সে কারণে তাদের পারস্পারিক বিবাহ স্থগিত মর্মে গণ্য করা হবে। কিন্তু ইতোপূর্বে যদি তাদের তেমন নিদর্শন চিহ্ণিত ও সুস্পষ্ট হয়ে যায় এবং একজন পুরুষ ও অপরজন নারীরূপে ধর্তব্য হয়ে যায় Ñসেক্ষেত্রে তাদের বিবাহ তাৎক্ষণিক ‘জায়েয’ ও বলবৎ হয়ে যাবে; স্থগিত বলে গণ্য হবে না। অতএব, জটিলতা আর রইলো কোথায়? জটিলতা’র প্রশ্ন তো অপ্রাপ্ত বয়ষ্কের ক্ষেত্রে যখন নাবালক অবস্থায় বিয়ে করানোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক বা নাবালকের ক্ষেত্রে তো অহিজড়াদের বিবাহ প্রশ্নেও আইনগত নিষেধাজ্ঞা বিদ্যমান; আবার বিভিন্ন সমস্যা তো আছেই!
সুতরাং এমন প্রশ্ন অবান্তর যে, হিজড়াদের বিয়ে-শাদীর আয়োজন করে কী লাভ? কারণ, তারা তো হয়তো পারস্পারিক সহবাসে, দাম্পত্য সুখ ও হক আদায়ে অক্ষম হতে পারে! কেননা এমন প্রশ্ন তো অহিজড়া অনেক নারী বা পুরুষের বেলায়ও বাস্তবে হয়ে থাকে। তা ছাড়া, সব হিজড়া বা হিজড়া মানেই তাদের যৌন চাহিদা বা ক্ষমতা নেই-তা তো বাস্তবে প্রমাণিত সত্য নয়। অথচ তাদেরকে বিবাহ-শাদী ও সামাজিকতার বন্ধনে সকলের সঙ্গে আমরা যদি একাকার করে নিতে না পারি; তা হলে তো আমাদের সেই সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা থেকেই গেল!
২। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার অগ্রগতির কারণে যেখানে দৈহিক অস্ত্র-পাচারের মাধ্যমে চিকিৎসা (যা উপরে আলোচিত হয়েছে) দ্বারা বড় ও মূল সমস্যা সমাধান ও নিরসন সম্ভব এবং তাদেরকে পৃথক নারী-পুরুষের কাতারে বিভাজন সম্ভব ও সহজসাধ্য; সেখানে যৌন শক্তি ও তেমন সামর্থ প্রাপ্তির চিকিৎসা, সুরাহাও অসম্ভব হওয়ার কথা নয়।
ক্ষণিকের তরে ধরে নিলাম যে, তাদের কারও কারও হয়তো তেমন শক্তি-সামর্থ হবে না; কিংবা তাদের কারও সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা হবে না! তা হলে সেক্ষেত্রে অধমের প্রশ্ন: এমন বাস্তবতা কি আমরা অহিজড়া জনগণের অনেক নারী বা পুরুষের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আছে কি না? অবশ্যই আছে। তাই বলে কি, আমরা আমাদের সংশ্লিষ্ট সেসব স্ত্রী বা স্বামীকে তালাক দিয়ে বা ছেড়ে চলে যাব? বিশেষ করে ইসলাম ধর্মসহ অপরাপর সব ধর্মেই যেখানে প্রয়োজনে দ্বিতীয় বিবাহ বা একাধিক বিবাহেরও অবকাশ, আইনগত বৈধতা স্বীকৃত! সুতরাং আমাদের পক্ষে যুক্তি ও মানবিকতার দাবী হবে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন জ্ঞান করে, সামর্থ থাকা সাপেক্ষে প্রয়োজনে আমরা একাধিক বিয়ের পদক্ষেপ নিতে পারি এবং এমন প্রক্রিয়া অবলম্বনের দ্বারাও একজন ‘আশরাফুল মাখলূকাত’ হিজড়াকে আশ্রয়, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে সমাজ-সংসারের কাজে লাগাতে পারি।
লেখক : মুফতী : ইসলামী ফাউন্ডেশন, বায়তুল মোকাররম, ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন