শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

কারবালার সূচনা

মুফতি গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী | প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

হযরত মুহাম্মদ (সা:)’র কলিজার টুকরো হযরত ইমাম হাসান (রা:) ও ইমাম হোসাইন (রা:)’র সাথে যে অমানবিক আচরণ করা হয়েছিল শুধু তাই নয়, এর আগেও মহানবী (সা:)’র কলিজায় আঘাত দেয়া হয়েছিল। সুতরাং কারবালার সুচনা নবীজী থাকতেই সুচনা হয়েছিল। কোন বাধাই রাসুলে পাক (সা:) কে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখা যাচ্ছিলো না, সর্বত্র ইসলামের নুর বিকশিত হচ্ছিল। পথভ্রষ্টরা একের পর এক ব্যর্থ হচ্ছিল। তখন তারা টার্গেট করলো মোহাম্মদ (সা:)-এর হৃদয়ে আঘাত করো। যাতে প্রতি মুহুর্তে তাঁর অন্তকরণে দহন সৃষ্টি হয়। আর এ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তারা তা-ই করলো। তারা নবীজীর সন্তানদের সাথে অমানবিক আচরণ করতে লাগলো। সেই একই অমানবিক পথ অনুস্বরণ করলো কারবালার ময়দানে।


সর্ব প্রথম মক্কা শরীফের কাফেরগণই রাসুল (সা:) কে মানষিক নির্যাতন করার উদ্দেশ্যে তাঁর সন্তানদের সাথে র্দুব্যবহার করেছিলো। যার প্রমাণ সকল নির্ভরযোগ্য সিরাতের কিতাবে বর্ণিত আছে। প্রমাণ স্বরূপ তবাকাতে ইবনে সা’দ, সিরাতে ইবনে হিসাম, আনছাবুল আশরাফ সিরাত গ্রন্থগুলো থেকে কিছু আলোচনা তুলে ধরা হলো।
রাসুলুল্লাহ (সা:) নবুওয়াত প্রকাশের পূর্বে মক্কার আবু লাহাবের পুত্র উতবার সাথে হযরত রুকাইয়ার (রা:) প্রথম বিয়ে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা:) ওহী নাযিল হওয়ার পর দ্বীনের দাওয়াত শুরু করেন। এতে স্থানীয় অমুসলিমরা বিরোধীতা শুরু করলো। কুরাইশদের সাথে তাঁর বিরোধ যখন চরম আকার ধারণ করে তখন তারা আল্লাহর রাসুল (সা:) কে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে সকল পথ পন্থা বেচে নেয়। তারা সকল নীতি-নৈতিকতার মাথা খেয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, মোহাম্মদ (সা:)’র বিবাহিত মেয়েদেরে স্বামীর উপর চাপ প্রয়োগ অথবা প্রলোভন দেয়া হবে যাতে তারা প্রত্যেকের স্ত্রীকে (রাসুলের স. কন্যাগণকে) তারা তালাক দিবে এবং পরে তাদের পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দিবে। তাতে মুহাম্মাদের মনোকষ্ট ও দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পাবে এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। তারা প্রথমে হানা দিলো রাসুলুল্লাহর (সা:) বড় মেয়ের স্বামী আবুল আস ইবনে রাবী’র নিকট। ইসলামের শত্রুরা প্রস্তাব জানালো তার স্ত্রী যায়নাব বিনতে মুহাম্মদকে তালাক দিয়ে পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দেয়ার। কিন্তু তিনি তাদের মূখের উপর স্পষ্ট ভাষায় না বলে দিলেন। নির্লজ্জ কুরাইশ নেতৃবৃন্দ এমন জবাব শুনেও থামলো না। তারা গেল রুকাইয়ার (রা:) স্বামী উতবা ইবনে আবি লাহাবের নিকট এবং তার স্ত্রীকে (নবীর মেয়ে) তালাক দানের জন্য চাপ প্রয়োগ করলো। সাথে সাথে এ প্রলোভনও দিলো যে, সে কুরআইশ গোত্রের যে সুন্দরীকে চাইবে তাকে তার স্ত্রী হিসেবে উপহার দেয়া হবে। বিবেকহীন জালিম পুত্র উতবা তাদের প্রস্তাব মেনে নিল। সে রুকাইয়ার বিনিময়ে সা’ইদ ইবনুল আস মতান্তরে আবার ইবনে সাইদ ইবনুল আসের একটি মেয়েকে পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। কুরাইশ নেতারা সানন্দে তার এ দাবী মেনে নিল। তাদের না মানার কোন কারণ ছিল না। তাদের তো প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, যে কোনভাবে এবং যতটুকু পরিমানেই হোক মুহাম্মদকে (সা:) দৈহিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করবে। মুহাম্মদের (সা:) একটু কষ্টতেই তাদের মানসিক প্রশান্তি । নরাধম উতবা তার স্ত্রী সায়্যিদা রুকাইয়াকে (রা:) তালাক দিল।

নবীজীর মেয়ে হযরত যয়নব (রা:) মক্কা শরীফ থেকে হিজরত করে আসার সময় তাকে উটের পিঠ থেকে ফেলে দেয়া হয়। তিনি একটি পাথরের উপর ছিটকে পড়লে শরীর ফেটে রক্ত বের হতে থাকে এবং গর্ভপাত হয়ে যায়। এ মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে রাসুলুল্লাহ (সা:) ইশরাদ করেন : ‘সে ছিল আমরা সবচেয়ে ভালো মেয়ে। আমাকে ভালোবাসার কারণেই তাকে কষ্ট পেতে হয়েছে।

তিবরানী শরীফের বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত আছে, হযরত যয়নব (রা:) উটের পিঠ থেকে পড়ে যে আঘাত পান আমরণ সে ব্যথা অনুভব করতেন। এবং সেই ব্যথায় তিনি শেষ পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করেন। এ জন্য তাকে শহীদ মনে করা হয়। (মাযমাউজ জাওয়ায়িদ, খন্ড-০৯, পৃষ্টা-২১৯)।

বুখারী শরীফসহ অন্যান্য নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলোতে বর্ণিত আছে, এ ঘটনার কারণে রাসুলুল্লাহ (সা:) এত মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, প্রথমে তিনি আক্রমণকারীদের জ্বালীয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। অত:পর জ্বালানোর পরিবর্তে হত্যা করার নির্দেশ দেন। বিস্তারিত জানার জন্য বুখারী শরীফের কিতাবুল জিহাদ দেখুন।

একইভাবে কারবালার প্রান্তরে আওলাদে রাসুলদের সাথে অমানবিক আচরন করা হয়েছিলো। নবী করীম (সা:)’র মনের কষ্ট কিয়ামত পর্যন্ত উম্মতে মুহাম্মদী স্মরণ করে অশ্রু ঝরাবে। কারবালার ঘটনায় জিন্দা নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) যে কষ্ট পেয়েছিলেন তার বর্ণনা তিরমিযী শরীফসহ হাদিসের অন্যান্য কিতাবে উল্লেখ আছে। এ কষ্ট পাওয়ার ঘটনাগুলোকে সিরাজুল হিন্দ শাহ আব্দুল আজিজ দেহলভী (রাহ.) বছরে একবার অনুষ্ঠান করে লোকদেরকে শুনাতেন। এতে তাদের অশ্রু ঝরতো। শাহ ছাহেব তাঁর লিখিত ফতওয়ায়ে আযিযী কিতাবে লিখেছেন, (আাশুরার মজলিসে) ইবনে আব্বাস (রা:) ও অন্যান্য ছাহাবীগণ থেকে বর্ণিত বেদনাদায়ক স্বপ্ন, যে স্বপ্নগুলো থেকে বুঝা যায়, রাসুল (সা:) এ হত্যা কান্ডের ফলে অত্যন্ত চিন্তিত ও ব্যথিত হয়েছেন। সেগুলো আলোচনা করা হয়। অত:পর কুরআনে কারীমের খতম করা হয়। অত:পর পাঁচটি আয়াত পাঠ করে উপস্থিত খাবারের উপর ফাতেহা করা হয়। আর এ সময় যদি কেউ মধুর কন্ঠে সালাম পড়েন এবং শরিয়াত সম্মতভাবে মর্সিয়া পাঠ করেন তখন আমিসহ অধিকাংশ উপস্থিতির অন্তর বিগলিত হয়ে কান্না চলে আসে। যদি আমার কাছে এটা যায়েজ না হতো তবে আমি কখনো এরুপ করতাম না। এছাড়া অন্য কিছু করা শরিয়ত পরিপন্থী। সে সকল বিষয়ে বর্ণনা নিষ্প্র্রয়োজন। অতিরিক্ত আর কিছু লিখার নাই। সালামসহ ১২ ২৮ হিজরি। (ফতওয়ায়ে আযিযি, পৃষ্ঠা-২০০)।

ইসলামের সুচনালগ্নে কাফেররা রাসুলে পাক (সা:) কে মানসিকভাবে নির্যাতন করার উদ্দেশ্যে তারঁ পবিত্র সন্তানদেরকে নির্যাতন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করত। পক্ষান্তরে রাসূল (সা:) অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে অশ্রু ঝরাতেন। এমনকি কখনো কখনো বদদোয়াও করেছেন। এজিদ সমর্থকরা কারবালার ঘটনাকে তুচ্ছ ঘটনা মনে করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। তারা কি মক্কার কাফিরদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে না? না, তারা সে শিক্ষা গ্রহণ না করেনি। ইয়াযিদ বা তার সমর্থকরা অনেক আগে মৃত্যুবরণ করেছে। বর্তমানে যারা তার সমর্থক তাদের সম্পর্কে ইমাম আলুসী বাগদাদী (রহ.) লিখেছেন, যারা তাদের মদদদাতা, সহায়কারী, যারা তাদের সমর্থক, যারা তাদের প্রতি আকৃষ্ট, কিয়ামত পর্যন্ত তাদের উপর আল্লাহর লানত, ততদিন পর্যন্ত লানত, যতদিন একটি চোঁখ হলেও আবু আব্দুল্লাহ আল হুসাইন (রা:) এর জন্য অশ্রু ঝরাবে। (আল্লামা মাহমুদ আলুসি, রুহুল মাআনি ফি তাফসিরিল কোরআনিল আযিম, বৈরত: দারু ইহইয়ইত তুরাসিল আরাবি, থন্ড-২৬, পৃষ্টা-৭৩)।

হযরত উসমান (রা:) অসংখ্য অগণিত গুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও রাসুলে পাক (সা:) এর দুইজন পবিত্র কণ্যার স্বামী হয়ে তাদের সাথে অত্যান্ত ভালো ব্যবহার করতেন। যার কারণে রাসুল (সা:) তাকে অত্যান্ত ভালোবাসতেন এবং তাঁকে জুননুরাইন (দুই নুরের অধিকারী) উপাধীতে ডাকা হতো। হযরত যয়নব (রা:) এর স্বামী আবুল আ’স ইবনে রাবী তাকে অত্যান্ত ভালোবাসার কারণে ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও রাসুল (সা:) তাকে ভালোবাসতেন। রাসুল (সা:)’র ভালোবাসাই তাঁর ইসলাম গ্রহণের মূল কারণ ছিল।

যারা নবীজীর আওলাদদের সাথে অমানবিক আচরণ করেছিলো শুধু তাই নয়, প্রকারান্তরে তারা মুমিনের হুদয়ের সাথে অমানবিক আচরণ করেচিলো। ওরা ইহকাল ও পরকালে লাঞ্চিত। যুগে যুগে ওরা মানবতার কাছে ঘৃনিত। আজ যারা ঐ ঘৃনিত লানতপ্রাপ্তদের জন্য সাফাই গায় আমাদের বুঝতে বাকি রইলো না, তারা উতবা ইবনে আবি লাহাব ও এজিদের প্রেতাত্মা। আমাদের হৃদয় যেন হয় আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন