এক দেড় দশক আগেও যখন নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে প্রযোজক ও নির্মাতারা সংবাদ সম্মেলন করতেন তখন তাদের সিনেমার গল্প সম্পর্কে যেমন একটা ধারনা পাওয়া যেত, তেমনি পুরো চলচ্চিত্রের ধারা সম্পর্কেও জানা যেত। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের সার্বিক চিত্র ফুটে উঠত। দেশের দর্শক কি ধরনের সিনেমা পছন্দ করে, সেই চাহিদার প্রেক্ষাপটে নির্মাতারা সিনেমা নির্মাণ করতেন। আন্তর্জাতিক বাজারকে টার্গেট করে যে সিনেমা নির্মাণ নির্মাণ করা যায়, তা তাদের কাছে কল্পনাও করতেন না। আমাদের দেশের সিনেমা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুক্তি দেয়ার চিন্তা প্রযোজক ও নির্মাতাদের মধ্যে একেবারেই ছিল না। এ ধরনের সিনেমা নির্মাণের উদ্যোগ, দূরপ্রসারী চিন্তা ও পরিকল্পনা তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। বর্তমানে চলচ্চিত্র চরম দুঃসময় অতিক্রম করছে। করোনার আগে হাতেগোনা কিছু সিনেমা নির্মিত হলেও, করোনার ধাক্কায় তা তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। নতুন সিনেমার অভাবে অনেক সিনেমা হল বন্ধ রয়েছে। বলা যায়, দেশের চলচ্চিত্র একপ্রকার অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। তবে চলচ্চিত্রের মরুভূমিতে যেন ফুল হয়ে রয়েছেন জনপ্রিয় নায়ক, প্রযোজক ও বিশিষ্ট শিল্পপতি অনন্ত জলিল। চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা দূরে থাক, দেশে এর বাজার সৃষ্টি নিয়ে যখন অন্যান্য প্রযোজকের কোনো উদ্যোগ নেই, তখন তিনি নিজ চিন্তা, সৃজনশীলতা ও উদ্যোগে আমাদের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। ইতোমধ্যে ইরানের সাথে যৌথ প্রযোজনায় নির্মাণ করেছেন দিন দ্য ডে নামে একটি আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা। একইভাবে নির্মাণ করতে যাচ্ছেন তুরস্কের সাথে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নেত্রী দ্য লিডার। দুটি সিনেমাই আন্তর্জাতিক বাজারে মুক্তি দেয়া হবে। আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি দুটি সিনেমার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা নিয়ে হোটেল লা মেরিডিয়ানে এক গ্র্যান্ড অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। অনুষ্ঠানে ইরান, লেবানন, তুরস্ক ও ভারতের খ্যাতিমান অভিনেতারা উপস্থিত থাকবেন। এ উপলক্ষে গত রবিবার লা মেরিডিয়ানে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে চলচ্চিত্রের ‘ম্যাজিক্যাল কাপল’ হিসেবে পরিচিত অনন্ত ও বর্ষা উপস্থিত থেকে চলচ্চিত্র দুটি নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। চলচ্চিত্রে বহু সংবাদ সম্মেলন হলেও এ ধরনের সংবাদ সম্মেলন কখনো হতে দেখা যায়নি। এর কারণ, এটি প্রথাগত কোনো সংবাদ সম্মেলন ছিল না। এটি আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছিল। অনন্ত শুধু আমাদের সিনেমা নিয়ে কথা বলেননি, তিনি কিভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের সিনেমা নিয়ে গিয়েছেন তার বিস্তারিত তথ্য এবং চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরেন। অনন্ত যখন কথা বলেন, তখন সাংবাদিকরা যেসব প্রশ্ন করতে পারেন, তার জবাব আগেভাগেই তার বক্তব্যে উঠে আসে। কারণ, তার সিনেমা নির্মাণ প্রক্রিয়া এবং শুটিং সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া সহজ নয়। ফলে সাংবাদিকদের মধ্যে তা জানা এবং তুলে ধরার অনুসন্ধানী প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক। তাদের এই জানার বিষয়গুলো অনন্ত তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে তুলে ধরেন। এতে তার সিনেমা সম্পর্কে সাংবাদিকরা আগে থেকেই ধারণা লাভ করেন এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান ও অন্যান্য সম্পূরক প্রশ্ন করার সুযোগ পান। গত রবিবার তিনি যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তাতে সাংবাদিকদের এ অভিজ্ঞতা হয়েছে। এ অভিজ্ঞতা একটি আন্তর্জাতিক মানের সংবাদ সম্মেলনের। যেখানে দেশের চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাওয়ার কথা উঠে এসেছে। অনন্ত বলেন, আমি যেহেতু একজন বিজনেসম্যান এবং এক্সপোর্টার্স, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে, তাই চলচ্চিত্র ব্যবসার শুরু থেকেই চিন্তা করতাম, আমাদের চলচ্চিত্রকে কিভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়। চিন্তা করি, আমি তো চলচ্চিত্রও এক্সপোর্ট করতে পারি। তবে আমাদের প্রচলিত ধারার সিনেমা দিয়ে বিশ্ববাজার ধরা এবং এক্সপোর্ট করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন, আন্তর্জাতিক মান এবং চাহিদার সাথে তাল মিলানো। এ চিন্তা থেকেই আমি ইরান ও তুরস্কের সাথে যোগাযোগ শুরু করি। ইরানের চলচ্চিত্র বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য। ফলে আগে দেশটির সাথে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারলে আন্তর্জাতিক বাজার ধরা যাবে। কাজটি সহজ ছিল না। আমি যখন ইরানকে প্রস্তাব করি, তখন দেশটি দূতাবাসের মাধ্যমে আমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করে। আমি কে, কি করি, দর্শকের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, এসব বিস্তারিত খবর নিয়ে ইরান সরকারের কাছে রিপোর্ট দেয়া হয়। ইরান সরকার এ রিপোর্টে সন্তুষ্ট হয়ে আমার সাথে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করে। এভাবে দিন দ্য ডে’র নির্মাণের সূত্রপাত হয়। এছাড়া তুরস্কও আমার সম্পর্কে জেনে নতুন সিনেমা নেত্রী দ্য লিডার সিনেমার সাথে যুক্ত হয়। আমার দৃষ্টি এখন মিশর এবং অন্যান্য দেশের দিকে। এভাবে আমি আমাদের দেশের সিনেমার আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছি। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, আমাদের সিনেমা এবং চ্যানেল নিয়ে ভারতের নেতিবাচক ভূমিকা। দেশটি আমাদের চ্যানেল প্রচার করতে দেয় না। সিনেমা চালানোরও তেমন সুযোগ দেয়া হয় না। ফলে আমাদের দেশের নায়ক-নায়িকা ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভারতের দর্শক খুব একটা চেনে না। এতে আমার ভেতর একটি জেদ কাজ করে। চিন্তা করলাম আমি যদি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সিনেমা নির্মাণ করতে পারি, তবে সারাবিশ্ব আমাদের সিনেমা সম্পর্কে যেমন জানবে, তেমনি আমাদের অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও চিনবে। এ জেদ থেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সিনেমা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। নেত্রী দ্য লিডারে ভারতের বিখ্যাত অভিনেতাদের নিয়েছি। তাদের দেখাতে চাচ্ছি, আমরাও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সিনেমা নির্মাণ করতে পারি। দিন দ্য ডে মুক্তি পেলে তারা তা বুঝতে পারবে। অনন্ত বলেন, এক দশক আগে যখন আমার প্রথম সিনেমা খোঁজ দ্য সার্চ নির্মাণ ও মুক্তি দেই, তখন থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে সিনেমা মুক্তির বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে থাকি। এরপর মোস্ট ওয়েলকাম, নিঃস্বার্থ ভালবাসা, হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ, দ্য স্পীড, মোস্ট ওয়েলকাম-২ দেশের বাইরে মুক্তি দেয়ার পরিকল্পনা করি। সেই ধারাবাহিক পরিকল্পনার প্রজেক্ট দিন দ্য ডে এবং নেত্রী দ্য লিডার। অনন্তর সংবাদ সম্মেলনটি আক্ষরিক অর্থেই আমাদের চলচ্চিত্রের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তিনি নিজেই যে আলাদা একটি আন্তর্জাতিক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেছেন তা এখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। চলচ্চিত্রের ‘ম্যাজিক ম্যান’ হয়ে উঠেছেন। তার এ উদ্যোগ আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য যেমন গৌরবের, তেমনি দেশের জন্যও গৌরবের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন