জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্রীর যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে ক্যাম্পাসে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এই নিয়ে ‘অপরাজনীতি’র অভিযোগ উঠেছে খোদ সেলের প্রধানের বিরুদ্ধে। পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে ভিসিপন্থী শিক্ষকরা। তৈরী হয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। ‘ন্যায়-বিচার’ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এমন অভিযোগ তুলেছেন ভিসিপন্থী শিক্ষকদের একাংশ। এর বিরুদ্ধে ‘ফাইট ফর রাইট’ নামে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে জনমত তৈরী করছেন তারা। গতকাল রবিবার এই গ্রুপের শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাথে দেখা করে ‘ন্যায়-বিচার’র দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে ভিসিপন্থী শিক্ষকদের আরেকাংশ এই ঘটনাকে অভিযুক্ত যৌন হয়রানিকারী শিক্ষককে বাঁচানোর ‘অপকৌশল’ হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, বিচারাধীন বিষয়ে এভাবে হস্তক্ষেপ করা স্বাধীন বিচাকার্যকে বাধাগ্রস্থ করার শামিল।
জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের এক ছাত্রী ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সানওয়ার সিরাজ নামের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করে। এই অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এক সপ্তাহের মাথায় ২৯ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষককে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। এরপর এই ঘটনায় তদন্ত শুরু করে ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল’।
এমন অবস্থায় ১ বছর পার হওয়ার পর অভিযোগকারী ছাত্রী গণমাধ্যমকে জানায়, ‘আমি স্যারের (সানওয়ারের) নামে কোন অভিযোগ দিতে চাইনি। অভিযোগ পত্রটি মামুন আকন্দ নিজে লিখে আমাকে জিম্মি করে দাখিল করিয়েছে। অভিযোগ দাখিলের সময় উনি (মামুন আকন্দ) নানা রকম স্ক্রিনশর্ট ও অডিও বানায়। তা দ্বারা সানওয়ারের সাথে আমার অন্য রকম সম্পর্ক আছে বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে।’
এদিকে সানওয়ার সিরাজ বলছেন, ‘তদন্ত চলাকালে ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলে’র প্রধান অধ্যাপক রাশেদা আখতার বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে নানা সময় বলেছেন আমাকে বহিস্কারের মাধ্যমে আমার উইকেট ফেলে দিবেন। পাশাপাশি তিনি বলেছেন, আমি বহিস্কার হলে অধ্যাপক বশিরের রাজনৈতিক একটি হাত কাটা যাবে। যার ফলে সমাজবিজ্ঞান অনুষদেও ডীন হওয়ার জন্য তার (রাশেদার) আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না। তদন্তাধীন সময়ে তার এসব বক্তব্যে স্পষ্ট হয় এই বিচার প্রক্রিয়ায় তার হীন উদ্দেশ্য ও ব্যক্তি স্বার্থ জড়িত। ’
এমন অবস্থায় তদন্ত প্রতিবেদনের রিপোর্ট জমা দিয়েছে ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল’। যার আলোকে আগামী সিন্ডিকেট সভা থেকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কিন্তু ইতোমধ্যে শিক্ষকদের বিভিন্ন গ্রুপে গুঞ্জণ শুরু হয়েছে, ‘অধ্যাপক রাশেদা রাজনৈতিক কারণে একপাক্ষিকভাবে সানওয়ার সিরাজকে শাস্তির সুপারিশ করেছেন।’ এই জন্য গতকাল রবিবার শিক্ষকদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাথে দেখা করে ন্যায় বিচারের দাবি জানিয়েছেন। এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর সিকদার মো: জুলকারনাইন বলেন, ‘আমরা মনে করছি সেলের প্রধান সেলকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে আমাদের সহকর্মীর প্রতি অবিচার করছে। তাই আমরা শিক্ষক সমিতির কাছে ন্যায়বিচার দাবি করেছি।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকুরিচ্যুত এক শিক্ষকের কথিত স্ত্রী ভিসি পতন আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য এই ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ দিয়েছিল। তিনি চাকরি ফেরৎ পাওয়ার জন্য এই ষড়যন্ত্র করেছেন। তবে তিনি তার ষড়যন্ত্রে সফল হননি। আর এ কথা অভিযোগকারী ছাত্রী নিজেই গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করেছে। ’
কেন আপনাদের কাছে মনে হচ্ছে সেলের প্রধান সেলকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেÑএমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই প্রক্টর প্রক্টর বলেন, ‘অভিযুক্তের বয়ান নিতে আমরা সেলের অনীহা লক্ষ্য করেছি। কারণ অভিযুক্ত যখন ঘটনার নতুন তথ্য সেলে জমা দিতে চেয়েছিলেন তখন সেল জমা নেয়নি। এছাড়া সেলের প্রধান তদন্ত চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, তিনি উইকেট ফেলে দিবেন, অমুকের হাত কেটে দিবেন ইত্যাদি। এছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে থেকে তিনি সেলের দায়িত্ব পালন করলে রাজনৈতিক কারণে আক্রোশ হওয়ার সম্ভবনা থাকে। আমরা সেই আশঙ্কাই করছি। এই শিক্ষক আক্রোশের শিকার হচ্ছেন যা অমানবিক। ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। তাই আমরা ন্যায়বিচার দাবি করেছি।’
এই বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এ মামুন বলেন, ‘এটা বিচারাধীন বিষয় আমি এই বিষয়ে মন্তব্য করতে চাচ্ছিনা। তবে আমাদের কোন শিক্ষক যদি অবিচারের শিকার হন তাহলে আমরা সেই বিষয়টি দেখবো।’
অন্যদিকে এই অভিযোগের বিষয় জানতে ওই ছাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ছাত্রীর ভাই জানান, ‘আমরা অভিযোগটি তুলতে চাই। আরও দুই-তিনমাস আগে সেল থেকে আমাদেরকে ফোন দিয়েছিল। আমরা তখন বলেছিলাম কিভাবে অভিযোগটি তোলা যায়? কিন্তু সেল থেকে আমাদের আর কিছুই জানায়নি।’ এছাড়া ওই ছাত্রীর বাবা জানান, ‘আমার মেয়ে অসুস্থ। আমরা অভিযোগটি তুলতে কয়েকবার চেষ্টা করেছি।’
এই বিষয়ে জানতে সেলের প্রধান অধ্যাপক রাশেদা আখতারকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। সেলের সদস্য অধ্যাপক হারুন অর রশীদ খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সেলের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছি। তাই এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাইনা।’
সেলের অন্য সদস্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুবায়দা নাসরিনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ওই অভিযোগকারী ছাত্রীর পরিবারকে গত দুই তিনমাস আগে আপনি ফোন দিয়ে ছাত্রীকে সেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেছিলেন, তখন ওই মেয়ের পরিবার আপনার নিকট অভিযোগ প্রত্যাহার করতে চেয়েছিল কিনা? এই বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নিবে এই বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে চাইনা।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন