১। কাফন-দাফন, গোসলদান ও জানাযা পড়া ইত্যাদি সকল বিধানেই হিজড়ারা, সমান অধিকার ও সেবাপ্রাপ্তি প্রশ্নে অহিজড়া মুসলমানদের অনুরূপ। একজন মুসলিম নর বা নারী হিসাবে মুসলিম সমাজের কাছে তেমন সমান আচরণ প্রাপ্তিও তাদের হক-অধিকারের অন্তর্ভূক্ত ।
ক) উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে যেমন আগে সংশ্লিষ্ট হিজড়া’র পরিচিতি তথা সে কি একজন পুরুষ? না কি নারী? তা নির্ধারিত করে নিতে হয় ঠিক তেমনি গোসল ও কাফন-দাফনেও নারী বা পুরুষ নির্ধারণ করে; এবং জেনে নিয়ে অর্থাৎ নারী হলে অন্যকোন নারীই তাকে গোসল দেবে এবং ৩ কাপড়ের স্থলে ৫ কাপড় দেয়া হবে (আদদুররুল মুখতার+রাদ্দুল মুহতার ঃ খ-৩, পৃ- ৯৯, যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)।
আর যদি পুরুষ গণ্য করা হয় তাহলে তাকে অন্য কোন পুরুষই গোসল দেবে এবং তিন কাপড়ে কাফন দিয়ে, জানাযা পড়ে, দাফন করতে হবে। কোনরূপ বৈষম্য করা হবে না। অবশ্য যে- হিজড়াকে নারী বা পুরুষরূপে নির্ধারণ (প্রাচীন গবেষণা মতে) করা যাচ্ছে না তথা ‘জটিল হিজড়া’, তাকে সতর্কতামূলক নারীর অনুরূপ পাঁচ কাপড়ে দাফন করা যেতে পারে; যদিও তিন কাপড়ে দাফন করাও জায়েয আছে (প্রাগুক্ত)।
খ) আরও উল্লেখ্য, তার পুরুষ হিসাবে গণ্য হওয়ার ক্ষেত্রে সে একজন পুরুষের অনুরূপ সুন্নাত পদ্ধতিতে নামায আদায় করবে; নারী হিসাবে গণ্য হওয়ার ক্ষেত্রে সে একজন নারী’র অনুরূপ সুন্নাত পদ্ধতি অনুসরণে নামায আদায় করবে; আর জটিল হিজড়া হলে সতর্কতামূলক নারীদের অনুরূপ পদ্ধতি অনুসরণে সালাত আদায় করবে (প্রাগুক্ত)।
আর জামাতে নামায আদায় কালীন পুরুষ হলে পুরুষের কাতারে দাঁড়াবে; নারী বলে গণ্য হলে নারীদের কাতারে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করবে; আর ‘জটিল হিজড়া’ হিসাবে গণ্য হওয়া’র ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে প্রসিদ্ধ সেই ‘যাহিরুর রিওয়াত’ বা ওই হাদীসাংশ যা সকল ফিকাহ-ফাতাওয়া ও হাদীসের কিতাবে বলা হয়েছে-অর্থাৎ “প্রথম কাতারগুলো হবে পুরুষদের, তারপর শিশু-কিশোরদের, তারপর হিজড়া (জটিল)দের এবং তারপর হবে মহিলাদের কাতার” (নূরুল ইযাহ+মারাকিউল ফালাহ্: পৃষ্ঠা-৩০৬-৩০৮, দারুল কিতাব, দেওবন্দ, ভারত, তা. বি. হিদায়া : খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১২৪, মাকতাবা থানভী, তা. বি. ইত্যাদি)।
(গ) মৃত্যু-পরবর্তি গোসলের ক্ষেত্রে তাকে পুরুষ বা নারী যে-কেউ হাতে কাপড় পেঁচিয়ে তায়াম্মুম করিয়ে দেবে। আর মাহরাম কেউ থাকলে তিনি হাতে কাপড় পেঁচানো ব্যতীতই তায়াম্মুম করিয়ে দিতে পারবেন (প্রাগুক্ত : বাদায়ে‘)।
(ঘ) জামাতে সালাত আদায় কালীন একজন জটিল হিজড়া পুরুষদের কাতার ও শিশু-কিশোরদের কাতারের পরে এবং নারী-কাতারের সামনে দাঁড়াবে (প্রাগুক্ত : বাদায়ে‘)।
(ঙ) নামাযে ইমামতি প্রশ্নে, একজন জটিল হিজড়া পুরুষদের সালাতে ইমামতি করবে না; তবে প্রয়োজনে নারীদের ইমামতি সেও করতে পারে (প্রাগুক্ত : বাদায়ে‘)।
২। মৃত হিজড়া যদি চার বছর বয়সী বা কমবেশী বয়সের এমন শিশু হয় যে, তার প্রতি স্বভাবজাত আকর্ষণ জন্মে না তাহলে তাকে নারী পুরুষ যে কেউ গোসল দিতে পারবে (আহসানুল ফাতাওয়া : খ-৪, পৃ- ২২১ ; যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত )।
৩। মৃত হিজড়া যদি এমন হয় যে, তাকে নারী বা পুরুষ কোনো দিকেই প্রাধান্য দেয়া যাচ্ছে না তাহলে সেক্ষেত্রে সে সাবালকের কাছাকাছি হোক বা সাবালক হোক; তাকে তায়াম্মুম করিয়ে, কাফন পরিয়ে জানাযা দিয়ে কবরস্থ করা হবে (আদদুররুল মুখতার+রাদ্দুল মুহতার ঃ খ-৩, পৃ-৯৪-৯৫, যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত+ আল-বাহরুর রায়িক : খ-২, পৃ-৩০৫, ৩১১; যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত )।
৪। জানাযা’র দু’আর ক্ষেত্রেও উপরিউক্ত নিয়মে নারী-পুরুষ জেনে নিয়ে দু’আ পড়বে। আর মৃতটি যদি না-বালক হয় এবং ছেলে বা মেয়ে নির্ধারণ জটিল হয় তাহলে শিশুদের ক্ষেত্রে বর্ণিত দু’আর যে কোনটি পড়লেই যথেষ্ট হবে (আহসানুল ফাতাওয়া : খ-৪, পৃ-২০২, ২২১ ; যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)।
উপসংহার: উপরিউক্ত বিস্তারিত আলোচনা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, ইসলামী শরীয়তে ‘আশরাফুল- মাখলুকাত’ মানবজাতির ছোট্ট একটি অংশ হলেও, আলোচ্য হিজড়াদের ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় ও যথেষ্ট দিক-নির্দেশনা বিদ্যমান। যে-কারণে খোদ হিজড়াদের নিজেদের বেলায় দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতন হওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় নের্তৃবৃন্দেরও ধর্মীয় কর্তব্য বর্তায়, হিজড়াদের সংশ্লিষ্ট পরিবার-স্বজনদের, জনগণকে, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এদের বিষয়ে সচেতন ও উৎসাহিত করা। যেন সবাই এদের সঙ্গে অপর দশজনের অনুরূপ সদ্ব্যবহার ও মানবিক আচরণ করে; এদের বিয়ে-শাদী, ঘর- সংসার, আয়-উপার্জন, সামাজিকতা, ইবাদত-বন্দেগী, মৃত্যু-পরবর্তী সম্মানজনক কাফন-দাফন-জানাযায় সকলেই সহযোগিতা করতে পারে।
বিশেষ করে এরা যেন ভবঘুরে হয়ে রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি বা হাতপাতা কিংবা বাসা-বাড়িতে হানা দিয়ে সংশ্লিষ্টদের উত্যক্ত না করে; বরং অন্য দশজনের অনুরূপ প্রয়োজনীয় ও সম্ভাব্য কাজ-কর্ম ও পেশায় নিয়োজিত হয়ে সম্মানজনক জীবিকা এবং সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হতে পারে- তেমন সার্বিক প্রচেষ্টা ও উদ্দোগে আমাদের সকলকে শরীক হতে হবে। তার পাশাপাশি রাষ্ট্র ও প্রশাসনকেও এদের সার্বিক কল্যাণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। মহান আল্লাহ্ আমাদের সকলকে জিড়াদের কল্যাণে এগিয়ে আসার তাওফীক দিন। আমীন!
লেখক : মুফতী ঃ ইসলামিকফাউন্ডেশন,বায়তুল মোকাররম, ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন