বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করুন

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের দাবি জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। গতকার শনিবার পরিষদের পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই দাবি জানানো হয়। পরিষদের প্রেসিডেন্ট মাহফুজ আনামের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগে সংবাদকর্মী ও মুক্তমত প্রকাশকারী ব্যক্তিরা ক্রমাগতভাবে নিপীড়ন- নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমন আশঙ্কা আমরা আইনটি তৈরির সময়ই করেছিলাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের আশঙ্কার চেয়েও আরো কঠিনভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। একজন মুক্তমনা লেখক মুশতাক আহমেদকে জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করে যেতে হলো।

সম্পাদক পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়, ১০ মাস কারাবন্দী থাকার পর কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে জামিন দেওয়ায় আদালতকে ধন্যবাদ জানাই। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংবাদকর্মী ও লেখকদের গ্রেপ্তার করে তাঁদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে নির্দয় আচরণ করছে, তা অত্যন্ত অনভিপ্রেত। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি লেখা শেয়ার দেওয়ার কারণে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে দীর্ঘদিন নিখোঁজ ও কারাগারে থাকতে হয়েছে। পরে জামিন পেলেও তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলো চলমান রয়েছে। আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কাজলকে মামলা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া কিশোর জামিন পেলেও তাঁর মামলাটি চলমান আছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি মিডিয়া ওয়াচডগ বডি আর্টিকেল ১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯৮টি মামলায় ৪৫৭ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ৪৫৭ জনের মধ্যে ৭৫ জন সাংবাদিক। তাঁদের মধ্যে ৩২ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আইনটি পর্যালোচনা করা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে তদন্তের আগেই যেন গ্রেপ্তার করা না হয়, এমন ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে আমরা স্বাগত জানাই। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য অনতিবিলম্বে আইনগতভাবে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাই। এ জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় অধ্যাদেশ বা আইনি উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাই।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া তৈরি, মন্ত্রিসভায় অনুমোদন, সংসদে বিল উত্থাপন ও প্রেসিডেন্টের সইয়ের আগে ও পরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সম্পাদক পরিষদ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা আপত্তি তুলেছিল। সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকজন মন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির সদস্যরা আমাদের সঙ্গে বৈঠক করে তা শুনেছিলেন। শেষে দেখা যায়, দাবিগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এমনকি এই আইন প্রণয়নকালে সংসদে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বক্তব্য এবং সংসদীয় কমিটির পেশকৃত প্রতিবেদন সম্পর্কে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের মতামতও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আপত্তিকর ধারাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা সেগুলো সংশোধনের সুপারিশ করেছিলেন। সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হলে আজকের এ পরিস্থিতি হয়তো উদ্ভব হতো না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আমরা কেন উদ্বিগ্ন, তা সম্পাদক পরিষদ ২০১৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে। ব্যাখায় আইনটির ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) নিয়ে সম্পাদক পরিষদ তাদের উদ্বেগ তুলে ধরেছিল। ধারাগুলো বিশ্লেষণ করে সম্পাদক পরিষদ যেসব মৌলিক ত্রুটি চিহ্নিত করেছিল, সেগুলো হচ্ছে: ১. ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন প্রতিহত করা এবং ডিজিটাল অঙ্গনে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করতে গিয়ে এমন একটি আইন করা হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যমের কর্মকান্ডের ওপর নজরদারি ও বিষয়বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে। এই আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩২ ধারা সংবিধানপ্রদত্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই ধারাগুলো নাগরিকদের বাক্ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণেরও সুযোগ সৃষ্টি করবে। যেমন ৮ ধারায় উল্লেখ আছে, যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রতীয়মান হয় যে, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা তার কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে, বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওইসব তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা বøক করার জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। ২১ ধারা বলছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে ওই ব্যক্তির সেটা অপরাধ হবে। ২৫ ধারায় আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে জ্ঞাত থাকা সত্তে¡ও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করার বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশে, বা কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির এ কাজটি হবে অপরাধ। ২৮ ধারা বলছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উসকানি দেওয়ার অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তির এ কাজ হবে একটি অপরাধ। ৩১ ধারায় উল্লেখ আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা স¤প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা স¤প্রদায়ের মধ্যে শত্রæতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে সেটা হবে অপরাধ। ৩২ ধারা বলছে, যদি কোনো ব্যক্তি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তিনি অনধিক ১৪ বছর কারাদন্ডে বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।

২. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমন এক আতঙ্ক ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে সাংবাদিকতা, বিশেষত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
৩. এই আইন সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছাড়াও কম্পিউটার ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ইত্যাদি ব্যবহারকারী সব ব্যক্তির মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করবে।

৪. এই আইনের ৪৩ ধারা পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ এ আইনে দেওয়া ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

৫. এই আইনে অস্পষ্টতা আছে এবং এতে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সহজেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে।
সম্পাদক পরিষদের দৃষ্টিতে উদ্বেগের আরেকটি বিষয় হলো, এ আইনের অপরাধ ও শাস্তিসংক্রান্ত প্রায় ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টি জামিন অযোগ্য, ৫টি জামিনযোগ্য এবং একটি সমঝোতাসাপেক্ষ। এর ফলে অনিবার্যভাবে একটা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সাংবাদিকতার স্বাভাবিক অনুশীলন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যারা অপরাধমূলক কর্মকান্ড করবে তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু, কৌশলে তা যেন গণমাধ্যম ও মুক্তমনের লেখকদের ওপর প্রয়োগ করা না হয়, তা নিশ্চিত করতে অনতিবিলম্বে আইনটির সংশোধন করতে হবে।

আমরা দাবি করছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংবাদকর্মীদের নামে যতগুলো মামলা হয়েছে, যতজন সংবাদকর্মী ও মুক্তমনা লেখক গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক এবং মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক। আমরা সরকারের সুবিবেচনা প্রত্যাশা করছি। ##

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন