মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী খাদ্যের জন্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। আর এ উদ্ভিদ তথা গাছ তাদের পুষ্টির জন্য মাটির উপর নির্ভর করে। গাছ তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান (খনিজ পদার্থ) মাটি থেকে সংগ্রহ করে। এ থেকেই মাটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের যে সকল বস্তুর প্রয়োজন হয় তার সবগুলিরই উৎস মাটি। অথচ, মানুষের দ্বারা এবং মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মকান্ডের কারণে মাটির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। মাটি দূষিত হচ্ছে।
মাটিদূষণ বলতে বুঝায়, মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান হ্রাস ও অবাঞ্চিত পদার্থসমূহের সঞ্চয়, যা প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের জন্য ক্ষতিকর। অবাঞ্চিত পদার্থ বলতে সেসব উপাদানকে বুঝায়, যা মাটির নেতিবাচক রূপান্তর ঘটায়। মাটিদূষণ পরিবেশদূষণের একটি প্রধান অংশ। নগরায়ন ও ব্যাপকহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধিই মাটিদূষণের প্রধান কারণ। মাটি দূষণের প্রধান কারণগুলি হলো: ১। ভূমি ক্ষয়, ২। রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ, ৩। অপরিকল্পিত নগরায়ন, ৪। অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধন, ৫। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, ৬। চিংড়ি চাষ ও ৭। অনিয়নন্ত্রিত কৃষিকাজ।
নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো:
ভূমি ক্ষয়: ভূমিক্ষয়ের প্রধান কারণ বৃষ্টি ও বায়ু প্রবাহ। ভূমিক্ষয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় যখন মানুষ নির্বিচারে গাছ-পালা কেটে বন উজাড় করে, তৃণভূমিতে চাষাবাদ শুরু করে এবং মাটির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে গাছ-পালা কেটে ফেলে; ফলে মাটি আলগা হয়, তখন বাতাস সহজে মাটি উড়িয়ে নিয়ে ভূমিক্ষয় ঘটায়। এছাড়া বৃষ্টির পানি দ্বারা উন্মুক্ত স্থানের ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পায়। এভাবে ভূমিক্ষয়ের ফলে সৃষ্টি হয় প্রচুর পলির। জমি চাষের ফলে ভূমিক্ষয় ত্বরানি¦ত হয়, কেননা জমি চাষের ফলে মাটি আলগা হয়, তখন বৃষ্টির পানি ও বায়ুপ্রবাহ সহজেই একস্থানের মাটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে। এ ধরনের উৎস থেকে সাধারণত সবচেয়ে বেশি পলি এসে থাকে। এছাড়া কিছু পলি আসে এমন মাটি থেকে যেখানে কোন গাছপালা নেই।
রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ: শিল্প-কল-কারখানা থেকে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বর্জ্য হিসেবে নির্গত হয়। এছাড়া গ্রাম বা শহরের গৃহস্থালী বর্জ্য ও নাগরিক বর্জ্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্তূপ করা হয়। এ সমস্ত বর্জ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থসহ রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন জীবাণু থাকে, যা বর্জ্য স্তূপকৃত স্থান ও তার পার্শ্ববর্তী স্থানকে দূষিত করে।
অপরিকল্পিত নগরায়ন: বাংলাদেশসহ গোটাবিশ্বের জনসংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এরই সাথে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের শহরমুখী বসবাস। এ কারণে বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশের শহরের জনসংখ্যা ঘনত্ব দিন দিন বাড়ছে। ১৯৫০ সলের পরবর্তী ৩৫ বছরে বিশ্বে শহরবাসী লোকের সংখ্যা ১.২৫ বিলিয়ন (১২৫ কোটি) থেকে বৃদ্ধি পেয়ে তিনগুণ হয়েছে। অধিকতর উন্নত দেশসমূহে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশে তা চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ব্যাপক সংখ্যক শহরবাসীর চাহিদা পূরণার্থে শহরে গড়ে উঠছে অনিয়ন্ত্রিত পাকা-বাড়ি, সুউচ্চ ফ্লাট বাড়ি এবং যেখানে সেখানে শিল্প-কল-কারখানা। এভাবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে শিল্প-কল-কারখানা ও ফ্লাট বাড়ি উঠাতে দূষিত হচ্ছে শহুরে পরিবেশ। এমনিভাবে অপরিকল্পিতভাবে নগর গড়ে উঠাতে ভেঙ্গে পড়ছে শহরের বর্জ্য নিষ্কাশন ও পয়ঃনিষ্কাশন। এসব বর্জ্য দ্বারা শহরাঞ্চল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটি, পানি, বাতাস দূষিত হচ্ছে।
অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধন: জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাতে বৃক্ষকর্তনের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অধিক জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান রাস্তাঘাট, কল-কারখানা তৈরি করতে বনভূমি ও কৃষিজমি ব্যবহার করা হয়, ফলে বনভূমিতে গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং মাটি উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে। মাটি উন্মুক্ত হওয়ায় মৃত্রিকা ক্ষয়বৃদ্ধি পেয়ে মাটি তার পুষ্টি উপাদান হারাচ্ছে, তথা মাটি দূষণ ঘটছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ইতোমধ্যে অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেখানে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ: ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলির নাব্য কমে গেছে এবং নদীতে স্রোত কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাগরের লোনা পানি অধিক ভিতরে প্রবেশ করছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে মাটির লবণাক্ততাজনিত মাটিদূষণ শুরু হয়ে গেছে।
চিংড়ি চাষ: চিংড়ি বাংলাদেশের একটি মূল্যবান রপ্তানীযোগ্য সম্পদ। একারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা ও কক্সবাজার এলাকায় ব্যাপক হারে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে। চিংড়ি চাষে অনেক দিন লোনা পানি বদ্ধ অবস্থায় থাকে বলে, লবণাক্ততাজনিত মাটিদূষণ ঘটে।
কৃষি কর্মকান্ড: কৃষি কাজে অধিক ফসল ফলনের জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছিটানো হয়, এর দ্বারা মাটিদূষণ ঘটে। যে কোনো কৃষি কাজই মাটির পুষ্টি উপাদান নষ্ট করে থাকে। মাটি চাষাবাদের সময় মাটি আলগা হয়ে পড়ে এবং মাটিক্ষয়ের মাধ্যমে মাটিদূষণ ঘটে। এছাড়া জমি চাষকালে মাটির কাঠামো নষ্ট হয়। মাটির কাঠামো (বুনট) নষ্ট হলে গাছ জন্মাতে অসুবিধা হয়।
মাটিদূষণের ফলাফল ভয়াবহ, যেমন:
১। ভূমিক্ষয়ের ফলে ভূমির উপরিভাগ থেকে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান অন্যত্র সরে যায় ফলে উক্ত জমি অনুর্বর হয়ে পড়ে, যা গাছ-পালা জন্মানোর অনুপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং উক্ত এলাকা ক্রমান¦য়ে বৃক্ষ শূন্য হয়ে পড়ে। ২। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ মাটিকে দূষিত করে, ফলে সে এলাকায় কোন উদ্ভিদ ও প্রাণী জন্মাতে পারে না। ৩। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে অন্যান্য দূষণের পাশাপাশি মাটিদূষণ ঘটে, যা মানুষসহ অন্যান্য জীবের বসবাসের অনুপোযোগী হয়। এর দ্বারা মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। ৪। ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধনের ফলে ভূমি ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। ফলে সেখানে গাছপালা জন্মাবার পরিবেশ নষ্ট হয়, যা মরুকরণকে প্রভাবিত করে। ৫। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের প্রায় সবগুলি নদীতে পানির স্রোত হ্রাস পেয়েছে এবং নদীগুলি দিন দিন তাদের নাব্য হারাচ্ছে। এর দ্বারা নদী ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটিদূষণের ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ৬। চিংড়ি চাষের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে মাটি লবণাক্ততাজনিত দূষণের স্বীকার হচ্ছে। ফলে সে এলাকার মাটির ঘাস পর্যন্ত মরে যাচ্ছে। ৭। কৃষি কর্মকান্ডের সময় অপরিকল্পিত চাষাবাদ, রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমি তার উর্বরতা হারাচ্ছে। এজন্য জমি থেকে ফসল উৎপাদন হার পর্যায়ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে।
মাটির দূষণ নিয়ন্ত্রণ: ১। আলগা মাটি সহজে ক্ষয় হয়ে থাকে। এজন্য আলগা মাটিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘাস বা অন্যান্য উদ্ভিদ লাগানা উচিত। ২। ব্যাপকহারে বৃক্ষনিধন বন্ধ করা প্রয়োজন। গাছ কাটার প্রয়োজন হলে পাশাপাশি গাছ লাগাবার উদ্যোগ নিতে হবে। ৩। নগর বা গ্রামের গৃহস্থালীর বর্জ্য ও সিওয়েজ বর্জ্য স্থানান্তরের পূর্বে পরিশোধিত করে নিতে হবে। ৪। অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন বন্ধ করতে হবে। ৫। চিংড়ি চাষের বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। ৬। কল-কারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিক বর্জ্য ভূমি, জলাশয় বা নদীতে নির্গমনের পূর্বে পরিশোধিত করতে হবে। ৭। জমিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার, জীবাণু সার ব্যবহার করতে হবে। জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে শীম জাতীয় উদ্ভিদ জন্মানো যেতে পারে। ৮। জমিতে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এর পরিবর্তে জৈব প্রক্রিয়ায় কীট-পতঙ্গ দমন করা যেতে পারে। তাছাড়া জমিতে পর্যায়ক্রমে ফসল চাষাবাদ করলে কীট-পতঙ্গের আক্রমণ হ্রাস পায়। ৯। মাটি দূষণ এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
লেখক: সহযোগী সম্পাদক, দ্য এনভায়রনমেন্ট রিভিউ, ম্যাগাজিন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন