শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

প্রসঙ্গ : ‘সমান’ অধিকার বা ‘সমান’ মর্যাদা

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:০২ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর
সমাজ বা রাষ্ট্রের অপেক্ষাকৃত ছোট অংশের প্রতি অবিচার অবহেলা অথবা তাদের ব্যক্তি ও সামাজিক অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে যাবে। এই অনুশীলনটা রাজনীতিবিদদের মধ্যে যতটা প্রকট কিংবা ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ থাকে, সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সেটা থাকে না। একজন সাধারণ মানুষ কিংবা নাগরিকের মধ্যে ‘ইকুয়াল’ প্রত্যয় কিংবা বিবেচনাটি যতটা গুরুত্ব পায়, সেরকম সমান গুরুত্ব পায় না বিষয়টা অনেক রাজনীতিবিদদের কাছে, তেমনি কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তিত্বদের কাছেও। এটা বা¯তবতা।আবেগের কথা না। ইকুয়াাল বিষয়টা তখন রাজনৈতিক স্বার্থে কিংবা গোষ্ঠীর স্বার্থে অথবা ব্যক্তি স্বার্থে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। রিএ্যাকটিভ বা অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়াশীল হয়। ইতিহাসে এসবের দৃষ্টান্ত আছে।
মানুষ মানুষকে সমান অধিকার দেয় কতটা, বা সেটা দিতে পারে কিনা। এটা নিয়েও প্রশ্নের অনেক সুযোগ আছে। আমরা মানব সমাজে জন্মগতভাবেই সমান না। কারো জন্ম প্রাচুর্যের মধ্যে, কারো দরিদ্রতার মধ্যে। কারণ অধিকাংশ মানুষের প্রতিদিনই কাটে সমাজে বিভিন্ন অগ্রাধিকারভুক্ত শ্রেণির মানুষের থেকে পাওয়া অবহেলার মধ্যে। এই পরিবেশে একটা শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে জন্মমাত্র সে একটা অ-সমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনাতেই কিন্তু বড় হচ্ছে এবং হয়।এরকম ঘরে জন্ম নেয়া কোনো মানবসন্তান সমাজে ধনী শ্রেণীর ঘরে জন্ম নেয়া সন্তানের তুলনায় সবক্ষেত্রেই শুরুথেকেই একটা ‘আন-ইকুয়্যাল’ সমাজ ব্যবস্থায় বড় হয়ে ওঠে। এই ব্যবস্থাপনাকে বর্তমান রেখে আমরা কোনো ধরনের ‘ইকুয়ালিটি’ বা সমান অধিকারকে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করতে পারি বা পারব কিনা জানি না।তাই বলে কি ইকোয়াল রাইটসের কথা বলা হবে না? না, তা তো বলিনি। তবে কোনো একটা কিছুকে ইকুয়াল রাইটস বলে রায় বা দাবি করলে, আমরা যেন মনে রাখি যে সমাজে ইকুয়াল রাইটস, এই যুদ্ধটা কিন্তু প্রতিদিনের।এর চূড়ান্ত সুফল এখনো সমাজে আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। কবে বা পারব, তাও সুনিশ্চিতভাবে বলা কঠিন, তবে এই সংগ্রামের যুদ্ধ প্রতিমুহূর্তের। এর সঙ্গে দ্বিমত করার অবকাশ নেই।সমাজে এই সমান সমান বিষয়টাকে, গুরুত্ব দিতে গিয়ে অনেক দার্শনিক এবং সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তাাবিদরা এক সময় সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো এই যে, একটা সময় আমরা সর্বহারা শ্রেণী বলতে যে বিষয়টাকে বুঝতে পারতাম, বাস্তবে দেখা গেছে সেরকম কোনো শ্রেণী ক্ষমতায় গেলে তখন সেই শ্রেণী বা গোষ্ঠী আর ‘সর্বহারা’ থাকে না। তাই পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ সেই অর্থে গণতন্ত্রের মতো সফল হতে পারেনি।পুঁজিবাদের কাছে সমাজতন্ত্রের পরাজয় বা সাম্যবাদের পরাজয়ের অন্যতম একটি কারণ, মানুষ আসলে জন্ম থেকেই অ-সমান- আর্থিক, পারিবারিক, শিক্ষা, সামাজিক, রাজনৈতিক, ভৌগলিক এবং রাষ্ট্রীয় আত্মপরিচয়ের মধ্যেই বড় হয়। রাষ্ট্র যদি তার আচার আচরণের সংস্কৃতিতে সমতা বা গণতন্ত্রকে না, বৈষম্যকে এবং শক্তি প্রয়োগে বেশি অগ্রাধিকার দেয়, সেই রাষ্ট্র এবং সমাজে কোনো ধরনের সমতা বা ইকুয়ালিটি বিরাজ করে না। এটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সমান বাস্তবতা।সমাজে একজন ধনী ব্যক্তির সঙ্গে, একজন অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ব্যক্তির অধিকার সমান হয় না। একজন উচ্চশিক্ষিত, আলোকিত মানুষের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত একজন মানুষের। অধিকার এবং অগ্রাধিকার সমান না। একজন শক্তিশালী মানুষের সঙ্গে একজন দুর্বল মানুষের অধিকার সমাজে সমান না। একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তির সঙ্গে, ‘ক্ষমতাহীনদের’ ‘সমান’ অধিকার হয়না। যেমন সর্ব ভোগীদের সঙ্গে সর্বহারাদের ক্ষমতা সমান না।বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা, রাষ্ট্র, এর কোনটাই মানুষকে এইসব চিন্তার উপরে অন্য মানুষের অধিকারকে নিশ্চিত করতে কিংবা সুরক্ষা দিতে সমান দৃষ্টিভঙ্গি আমরা চর্চা করি না। চারিত্রিকভাবেও মানুষ কিন্তু ব্যক্তি এবং শ্রেণীর স্বার্থের প্রতি আমরা দুর্বল। এটাও বাস্তবতা।
একটা সমাজ যখন অনগ্রসর ছিল বা এতটা অগ্রসর ছিল না, তখনো যেমন ছিল এখনো তেমনি আছে। ইতিহাসে পড়েছি যে, যখন সমাজে সামাজিক সম্পর্ক অনেকটা পশু হত্যার মধ্যে বিরাজমান ছিল, তখনও দেখা গেছে নির্দিষ্ট পরিবারের যে ব্যক্তিটি বেশি পশু হত্যা করতে পারতেন, পশু হত্যায় যার শক্তি যত বেশি হতো, সমাজে বা পরিবারে তার অগ্রাধিকার অন্যদের তুলনায় বেশি থাকত। নিহত পশুর মাংস তখনও সমানভাবে বণ্টন হতো না। সমাজে সম্পদের বণ্টন তখন থেকেই অসমান। অধিকার অসমান ছিল।এখন সমাজ বদলেছে, সভ্যতার নানা রকম উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারের কারণে সমাজ অগ্রসর হয়েছে অনেক। কিন্তু সমাজের ভেতরের মানুষের মধ্যে যে একটা পাশবিকতা আছে, অপরাধের প্রতি ঝোঁক আছে। অপরের সম্পত্তি অধিকারে লোভ আছে।
শারীরিক শক্তির প্রতি দুর্বলতা আছে। এর তো কোনো পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হয়েছে এর ব্যবহারের কৌশল কিংবা মোড়কের। এই অবস্থাতে আমরা সমাজ বা রাষ্ট্র কতটা কার পক্ষে, কার বিপক্ষে ‘ইকুয়াল রাইটস’ প্রতিষ্ঠা করতে পারব। বিষয়টাকে চিন্তাতে উপেক্ষা করা যাবে কি?
সভ্যতার অগ্রসরের সঙ্গে এক পর্যায়ে মানুষ যখন নিজের তৈরি কাপড়ের পোশাক পরিধান করা শুরু করল। তখন পোশাক ছাড়া মানুষকে সমাজ গ্রহণ করত না। তাদের সমালোচনা হত। কেউ যদি আমরা দাবি করি যে, একজন যদি পোশাক পরে হাঁটতে পারেন রাজপথে, আমি তাহলে ‘ন্যাংটা’ হয়ে হাঁটতে পারব না কেন? এটা আমার ব্যক্তিগত অধিকার। সমাজ তখন হয়তো বলবে সমাজের কোনো নর্মের কথা। যে এটা করা যাবে ওটা করা যাবে না।
এখন সব কিছুর যে রকম পরিবর্তন দেখছি হয়তো বা একদিন এরকম আসতেই পারে, মানুষের কাপড় পরা এবং না পরা সমান অধিকার বিবেচিত হবে অথবা হতে পারে।সমান অধিকার কিংবা সমমর্যাদা। এই বিষয়গুলো সমাজের মানুষের দ্বারাই সময়, পরিবেশ এবং যুগের দাবিতে বদলে যায়। এক সময় মানুষ যেটাকে এক ধরনের অপরাধ কিংবা অপছন্দ করতো, আজকে অনেক ক্ষেত্রে সেরকম অপছন্দগুলো ব্যক্তি স্বাধীনতার পছন্দের অগ্রাধিকারে চলে আসছে। সমাজ এবং রাষ্ট্র একে স্বীকৃতিও দিচ্ছে। এটা সমান অধিকার নাকি অধিকারবোধে অন্যের অধিকারকেও ‘ইকুয়ালি’ সম্মান করা। বিষয়টা মাঝে, মাঝে চিন্তার নাড়া দেয়।তাই কখনো কখনো মনে হয়, বাস্তবে ইকুয়াল বিষয়টা এক ধরনের রোমান্টিকতা কিনা। যদি তাই না হয় তখন যদি চোর-ডাকাতরা বলে, আমি চুরি করবো বা ডাকাতি করব। এটা আমার অধিকার। এর জন্য আমাকে জেলে নেয়া যাবে না। এটাও আমার সমান অধিকারের বিষয়। তখন এটাকে আমরা কীভাবে দেখব।তাই ইকুয়ালিটি কথাটার অর্থ যদি এমন হয়, যা খুশি তা না করা কিন্তু আমার সব কাজের মধ্যে একটা শালীনতা, অন্যের প্রতি সহনশীলতা, এবং সমাজের মূল্যবোধের প্রতি বিনীত শ্রদ্ধা রেখে আমার অধিকারকে চর্চা করা।সে ক্ষেত্রে ইকুয়ালিটির সম্মান এবং এর অধিকার সবার আগে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। কিন্তু তা না হয়ে কোনো ইকুয়াল রাইটস যদি এ ব্যাপারে উগ্রতার রূপ নেয়, সভ্যতার বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তি এবং ক্ষুদ্র শ্রেণীস্বার্থকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়। সে ক্ষেত্রে কোনো ইকুয়াল রাইটস ইকুয়ালি জাস্টিফাই করা কঠিন হয়ে যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শ্বেতাঙ্গ অগ্রাধিকার বিষয়টাও তখন অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে ইকুয়ালিটির ধারণা নিয়ে মার্কিন সমাজে বর্ণ বৈষম্যকে আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং জটিল করে দিতে পারে এই সমাজ ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চাকে।
আমাদের মানবিকতাবোধ, মনুষত্ববোধ, পরমত সহিষ্ণুতা, অন্যের প্রতি বিনয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ন্যায় পরায়ণতা- এইসব কিছুতেই আমরা যদি আমাদের সামগ্রিক চিন্তা এবং চেতনাতে এবং ব্যবহারে এর দৃষ্টান্ত রাখতে পারি। হয়তো তখনই সম্ভব হবে সমাজে এক ধরনের ইকুয়াল রাইটস কিংবা সমতা আনা অথবা বজায় রাখা। পুরোটা না হলেও আংশিক হলেও। এসব চর্চার শুভ ফল সমাজ এবং রাষ্ট্রে যে ইকুয়ালিটি বয়ে আনবে এবং আনতে পারে, তারও মূল্য কম হবে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন