শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহান স্বাধীনতা দিবস

ইসলামই বাঙালির মর্যাদা দিয়েছে

ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক | প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০২১, ৯:১৯ পিএম

ইসলামই বাঙালিকে মর্যাদার স্থানে বসিয়েছে। মুসলমানরাই নিজেদের গৌড়ীয়, বরেন্দ্রীয় ইত্যাদি না বলে বাঙালি বলেছে। লালবাগের কেল্লায় প্রাচীন কবরের সামনে নামফলকে মরহুমদের নামের অংশে ‘বাঙালী’ শব্দ দেখতে পাওয়া যায়। বাঙলার সুলতানরা নিজেদের ‘সুলতান বাঙলা’, ‘শাহ-ই-বাঙলা’ বলতে গর্ববোধ করতেন। কাঠমন্ডুতে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ অভিযান করলে পরবর্তীতে কাঠমন্ডুবাসী স্বয়ম্ভু পাহাড়ের পাথরে খোদিত করে রাখে যে, ‘বাঙালী ফৌজ’ অত সালে এখানে অভিযান চালায়।

কথা হলো, বাঙালির স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য ইসলামের আগমনে সম্পূর্ণতা পেয়েছে। আর এটা তো সত্যি কথা যে, এ অঞ্চলের লোকজন মুসলমান না হলে বাংলাদেশের জন্মই হতো না। বঙ্গবন্ধু এসব জানতেন। তাই তিনি বারবার বলতেন, বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ। তিনি অনেককে ভেটো দিয়ে ওআইসি সম্মেলনে যান। তিনি বলতেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়। এই ভাবধারা তার কন্যার ভেতরও দেখছি, যা একটা আশার কথা। বঙ্গবন্ধু ইসলামের গুরুত্ব স্বীকার করলেও সব ধর্মের মানুষের অধিকার ও নিরপত্তা নিশ্চিত করেন। আর এই নীতি আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে। প্রতিবেশীদের চেয়ে এই রেকর্ড আমাদের অনেক ভালো। আর ইসলাম সমস্ত ধর্ম-সম্প্রদায় প্রতি ইনসাফ করে। স্পেন-পর্তুগালে আরব শাসন, পূর্ব ইউরোপে তুর্কি শাসনে ও উপমহাদেশে সুলতানী-মোগল শাসনে।

ভারসাম্য ও ইনসাফের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়ার পররাষ্ট্রনীতি। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা সঠিক ছিল। কার্যত জিয়ার পররাষ্ট্রনীতি বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির ‘এক্সটেনশন’। বঙ্গবন্ধু সাত দফাচুক্তি নাকচ করে ওআইসিতে যান। জিয়া মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন। তার পররাষ্ট্রনীতির ‘মাস্টার স্ট্রোক হলো সার্ক’ প্রতিষ্ঠা। উপমহাদেশের সবাইকে নিয়ে বসে শান্তির পথ অন্বেষণ ছিল এটা। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একটা ‘ফাইন টিউনিং’। সঠিক ভারসাম্য আনয়নের প্রচেষ্টা ছিল এটা। যত আঞ্চলিক ফোরামই করা হোক, সার্ক এখন পর্যন্ত ‘বেস্ট অপশন’। উপমহাদেশে সেই সব নেতার আগমনের অপেক্ষা করছি, যারা সার্ককে পুনর্জীবন প্রদান করবেন এবং উপমহাদেশে শান্তির হাওয়া বইয়ে দেবেন।

ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে হিন্দুত্বের মতাদর্শ জেঁকে বসায় এর প্রভাব বাংলাদেশে এসে পড়ছে। আসামে বিজেপি সরকার বলছে, চল্লিশ লাখ বাংলাভাষী মুসলমান বাংলাদেশি। আর বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, সমগ্র ভারতে নাকি দুই কোটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। ভারতীয়দের অনেকেই বলেন, এসব ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু বিজেপির বড় নেতারা তো বাংলাদেশের এলাকা দখলসহ আরো কড়া কথা বলছেন। আসলে আসামে বিজেপি সরকারের পর যদি পশ্চিম বাংলাতেও বিজেপি সরকার আসে, তাহলে সমূহ বিপদ আসবে আমাদের ওপর। তবে এটা ভুললে চলবে না, বিজেপি, হিন্দু মহাসভা, আরএসএসের সূতিকাগার হলো পশ্চিমবঙ্গ। বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, আশুতোষ মুখার্জি, শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি প্রমুখই হিন্দুত্ববাদের আদি গুরু।

আমাদের দেশের কেউ কেউ আবার আবেগের চোটে বলে ফেলে যে, এপারে-ওপারে একই সংস্কৃতি। এভাবে বললে তো আমাদের স্বাধীনতাই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। আমরা নানাভাবে পৃথক বলেই তো আলাদা দেশ ও পতাকার দাবিদার। রাশিয়া সংস্কৃতি ও ভাষার অজুহাতে ইউক্রেনের ওপর কর্তৃত্ব করতে চায়। এপার বাংলা, ওপার বাংলা এ ধরনের কথা বলা ঠিক নয়। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ, তারা নয়। তারা অন্য নক্ষত্রের বলয়ে। আর আমরা ছোট হলেও পৃথক নক্ষত্র। আমরা কেন ব্ল্যাকহোলের ফাঁদে ঢুকব? ইউরোপেও বহু দেশ আছে, যেখানে এক দেশে প্রতিবেশীর ভাষাও চলে। ফরাসি, জার্মান, মেসিডোনিয়ান ইত্যাদি ভাষার মানুষ বিভিন্ন দেশে রয়েছে। তারা কিন্তু এপার ফরাসি-ওপার ফরাসি, এপার জার্মান-ওপার জার্মান বলে না। আফ্রিকা এক ভাষার লোক বিভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক। বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক। বারবার তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাড়াচ্ছে বাংলাদেশে। গণহত্যা ও পাইকারি ধর্ষণের মাধ্যমে দশ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে তাড়িয়েছে তারা। রোহিঙ্গাদের ভাষা, চেহারা, গায়ের রঙ, ধর্ম সংস্কৃতি ইত্যাদি সেখানকার মতো নয়। আর কিছুটা বাংলাদেশের মতো, এই ছুতায় একটা সম্পূর্ণ নৃগোষ্ঠী তথা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে উৎখাত করলে তো পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ হয়ে শরণার্থীর ঢেউ নামবে। বাংলাদেশেও তো নানা রঙের, ভাষার, ধর্মের মানুষ রয়েছে। খোদ মিয়ানমার থেকে আগত মানুষও আছে।

কথা হলো, সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, প্রতিবেশী যেমনি উপকারে আসে, তেমনি তারাই আবার আক্রমণকারী হয়। তাই আমাদের প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের যদি খুদকুঁড়া খেয়ে অর্থ বাঁচিয়ে প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে হয়, তাও করতে হবে। ইউরোপের ইতিহাসে আমরা দেখি, প্রতিবেশী দেশগুলো প্রতিবেশীকে দখল করে ভাগ করে নেয়। পোল্যান্ডের ওপর এটা রাশিয়াও করে, জার্মানিও করে।
বাংলাদেশ চায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে স্বাভাবিক, ন্যায়সঙ্গত সম্পর্ক। আমরা খামাখা ঝামেলায় জড়াতে চাই না। রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান কাম্য।

লেখক : ইতিহাসবিদ ও প্রবন্ধকার

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন