বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

শ্রেষ্ঠ দার্শনিক সুফিসম্রাট ইমাম গাজালি (রহ.)

নূর মুহাম্মদ রাহমানী | প্রকাশের সময় : ১ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০২ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর

যোগ্যতায় মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হয়ে অবশেষে খোদ নিজামুল মুলক তাকে নিজামিয়া মহাবিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যাপক নিযুক্ত করে দিলেন। এ সময় ইমামের বয়স ছিলো মাত্র ৩৪ বৎসর। এত অল্প বয়সে নিজামিয়া বিদ্যালয়ের প্রধান হওয়া ছিলো গৌরবের বিষয়। কারণ, সে জামানার বড় বড় বিজ্ঞ ব্যক্তিগণও এ বিদ্যালয়ের প্রধান হওয়ার চরম আকাঙ্খকা ছিলো। এ ছিলো ৪৮৪ হিজরির জুমাদাল উলা মাসের কথা।

৪৪৮ হিজরিতে খলিফা মুকতাদির বিল্লাহ ইন্তেকাল করেন। খলিফা নির্বাচিত হন মুস্তাজহির বিল্লাহ। খলিফা ছিলেন আলেম উলাম ভক্ত। ইমাম গাজালির সাথে ছিলো তার বিশেষ সম্পর্ক। এই খলিফার আমলে বাতেনি সম্প্রদায় অত্যন্ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে খলিফা তাদের খন্ডনে একটি গ্রন্থ রচনা করতে বললেন। ইমাম গাজালি একটি গ্রন্থ রচনা করলেন। খলিফার নামে কিতাবের নাম রাখলেন মুস্তাজহির।

ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক, প্রাজ্ঞ লেখক ছিলেন একাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত আলেম আবু হামেদ গাজালি। সে সময় ইসলামের নামে প্রচলিত থাকা ভয়ঙ্কর মতবাদ ও ভ্রান্ত দর্শন মুসলমানদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। বিচিত্রধর্মী অসাধারণ গুনাবলির অধিকারী মহামনীষী ইমাম গাজ্জালি মূলত সেসবের বিরুদ্ধে কার্যকর বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করেছেলেন। এ কারণে তাঁকে হুজ্জাতুল ইসলাম বা ইসলামের সাক্ষ্য উপাধি আখ্যা দেওয়া হয়। গ্রিক দর্শন থেকে শুরু আরম্ভ করে শিয়া মতবাদের উত্থান ও জোয়ারসহ সব বাতিল মতবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।

সে সময় ছিল দর্শনের যুগ। তাই তিনি দার্শনিকদের যুক্তি ও পরিভাষা দিয়েই তাদের অবস্থানের অসারতা তুলে ধরেন। দর্শনের ফাঁকফোকরগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। বিভ্রান্তিতে পড়ার আশঙ্কায় তিনি সর্বসাধারণের জন্য দর্শনের অধ্যয়নকে অনাবশ্যক মনে করতেন। কারণ এতে উপকারের তুলনায় অপকারের আশঙ্কা প্রবলতর।

তিনি ছিলেন একাদশ শতাব্দীর একজন শীর্ষস্থানীয় সুফি সাধক। নিজ কির্তিতে মহীয়ান। আলেমে রব্বানিগণের এক উজ্জল জ্যেতিষ্ক। আধ্যাত্ম সাধনা এবং পথভুলা মানুষজনকে আল্লাহর রাস্তায় ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর চেষ্টা সাধনার অন্ত ছিল না। তাই তো ১৯৯৫ সালে নিজের আধ্যাত্মিকতার সংকট অনুভব করে নিজামিয়া থেকে পদত্যাগ করেন। তারপর ৪৮৪ হিজরিতে তিনি বাগদাদ থেকে বেরিয়ে দামেস্ক, জেরুজালেম এবং হেজাজসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করতে শুরু করেন। বাগদাদ থেকে সিরিয়ায় দামেশক নগরীতে গিয়ে কঠোর আধ্যাত্মিক কঠোর সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। পাশাপাশি প্রচলিত ধ্যান-ধারণার নানান দিকগুলো বিশ্লেষণ করতে থাকেন।

সমস্ত ঐতিহাসিকদের মতে ইমাম গাজালি শাইখ আবু ফারমিদির (আফজাল ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী) (রহ.) নিকট তাসাউফের দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।

সিরিয়ায় দু’বছর অবস্থানের পর ইমাম সেখান থেকেই বাইতুল মুকাদ্দাস রওয়ানা করেন। বাইতুল মুকাদ্দাস জিয়ারত করে মাকামে ইবরাহিমি তথা যেখানে হজরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ (আ.)-এর রওজা শরিফ অবস্থিত। সেখানে আগমন করেন।

অতঃপর সেখান থেকে হজ আদায়ের নিয়তে পবিত্র মক্কা ও মদিনা অভিমুখে যাত্রা করেন। মক্কা মোকাররমায় কিছুদিন অবস্থান করছিলেন। এই সফরেই তিনি মিসর ও ইসকান্দারিয়ায়ও বহুদিন অবস্থান করেন। সফরে তিনি দীর্ঘ দশটি বছর কাটিয়ে দেন। সফরগুলোতে পূণ্যময় স্থান গমন করেন। বহু প্রাচীন পরিত্যক্ত বিরান ভূমিগুলোতে গিয়ে তার দৃৃশ্যসমূহ অবলোকন করে আল্লাহর সৃষ্টি ও ধ্বংস রহস্যের তথ্য উদঘাটনে ব্রতী হন।

প্রবাস জীবনে ৪৯৯ হিজরিতে যখন তিনি মাকামে ইবরাহিমিতে যান, তখন ইবরাহিম (আ.)-এর রওজা শরিফে দাঁড়িয়ে তিনি তিনটি বিষয়ে শপথ গ্রহণ করেন। ১. কখনও কোনো রাজা বাদশার দরবারে গমন করব না। ২. কোনো বাদশা বা আমির উমারার হাদিয়া গ্রহণ করব না। ৩. কারও সাথে কোনো বিষয় নিয়ে তর্ক বাহাসে অবতীর্ণ হব না। বস্তুত এরপর থেকে তিনি আমরণ এ শপথ প্রতিজ্ঞা পালন করে গিয়েছিলেন।

অবশেষে ১১০৬ সালে তিনি বাগদাদে ফিরে আসেন। শুরু করেন পুনরায় শিক্ষকতা ঠিক আগের মতো। ৪৯৯ হিজরিতে তিনি আবার নিশাপুরের মাদরাসায়ে নিজামিয়ায় অধ্যাপনার পদ অলংকৃত করেন। এর কিছুদিন পর ৫০০ হিজরিতে উজির ফখরুল মুলক বাতেনিয়া সম্প্রদায়ের হাতে নিহত হন। এ হত্যাকান্ডের পর তিনি মাতৃভূমি তুসে ফিরে আসেন। নিজ বাসস্থানের নিকটেই একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এখানে থেকেই ইলমে শরিয়ত ও ইলমে মারেফাতের শিক্ষা প্রদান করছিলেন।

১১১১ সাল মোতাবেক ৫০৫ হিজরি জুমাদাল উলা মাসের ১৪ তারিখে নিজ মাতৃভূমি তুশ নগরীর তেহরানে ইহলোগ ত্যাগ করেন।

ইমাম সাহেব কোনো ছেলে সন্তান রেখে যাননি। তবে কতিপয় কন্যা সন্তান ছিল। এ কন্যা সন্তানদের দ্বারাই তার বংশ বিস্তার লাভ করেছে।

ইমাম গাজালির শিষ্য শাগরেদ ছিল অসংখ্য। মুহাম্মদ ইবনে তুমরাত, যিনি স্পেনের তাশেকিন বংশের শাসন বিলুপ্ত করে এক বিরাট হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইমাম সাহেবের অন্যতম শিষ্য। তা ছাড়া উন্দুলুসের প্রখ্যাত আলেমদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি আবু বকর আররিও ইমামের যোগ্যতম শিষ্য।

ন্যায়-নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব আবু হামেদ গাজালির মেধা, বুদ্ধিমত্তা, জামানার বিরল প্রতিভার অধিকারী এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এ কারণেই ইমাম জাহাবি (রহ.) তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, গাজালি অনেক বড় শায়েখ, কিনারাবিহীন ইলমের ইমাম, হুজ্জাতুল ইসলাম, জামানার একক ব্যক্তিত্ব যার উপাধী জাইনুদ্দিন। উপনাম আবু হামেদ।’-(সিয়ারু আলামিন নুবালা ৯/৩২৩)।

আবু হামেদ গাজালি যদিও জ্ঞান-গরিমা, ফিকহ, তাসাউফ, ইলমে কালাম ও ইলমে উসুলের বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তথাপি যুহদ (পার্থিব অনাসক্তি), ইবাদত-বন্দেগি, একনিষ্ঠতা এবং ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমুদ্র ছিলেন। এতদসত্তেও দর্শনের প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিলো। তিনি দর্শনকে তাসাউফের ছাঁছে ঢেলে ইসলামি লেখায় পেশ করেছেন। এজন্য মুসলমান বিশেষজ্ঞগণ এর যথেষ্ট খন্ডন করেছেন। এমনকি খাস শাগরেদ আবু বকর ইবনুল আরাবিও এর খন্ডন করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের শাইখ আবু হামেদ দর্শনের গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছেছেন। অতঃপর সেখান থেকে বের হতে চেয়েছেন তবে বের হতে পারেননি। তাঁর থেকে বাতেনি মতাদর্শগুলোও বর্ণিত আছে। যার সত্যতা হজরত গাজালির কিতাবসমূহে পাওয়া যায়।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া ৪/৬৬)।

ইমাম গাজালি (রহ.) শেষ জীবনে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দিকে পরিপূর্ণ ফিরে এসেছিলেন। কোরআন ও হাদিসকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি ইলমে কালাম (তর্কবিদ্যা) ও ইলমে কালামে মনোনিবেশকারীদের খুব নিন্দা করেছেন। সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে কুরআন ও সুন্নাহর ওপর নিয়ে এসেছেন। এবং এগুলোকেই সবকিছুতে মূল বানানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। সাথে সাথে সাহাবা তাবেয়িদের পথ ও পদ্ধতি অনুসারে চলার নসিহত করেছেন।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন