সকল প্রশংসা সেই মহান রব্বে কারীমের যিনি আমাদেরকে ইসলামের মতো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান দান করেছেন। তিনি বলেন আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। (সূরা মায়িদাহ : ৩)।
সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক সেই রাসূলে আরাবী ও তার পরিবার পরিজনের ওপর যিনি না হলে আমরা দ্বীনের সঠিক দিশা পেতাম না।
ইসলাম শুধু ইবাদাত-বন্দেগীর নাম নয় বরং তাতে রয়েছে জীবনের সকল ক্ষেত্রের দিক নির্দেশনা ও পূর্ণাঙ্গ বিধি-বিধান। ইসলামে মানব জীবনের কোন বিষয়কে উপেক্ষা করা হয়নি।ইসলাম মানুষের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ সাধনে বেশ গুরুত্বারোপ করেছে। আর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ সাধনের অন্যতম মাধ্যম হলো খেলাধুলা । এ ছাড়া খেলাধুলা আনন্দ ও চিত্তবিনোদনের অন্যতম মাধ্যম।খেলার সংজ্ঞা: মনোবিজ্ঞানে খেলার বেশ কিছু সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো ঃ
খেলা এমন কিছু তৎপরতা যা শিশুরা আনন্দ ও উপভোগের উদ্দেশ্যে সম্পাদন করে।
খেলা হচ্ছে এমন কিছু কাজ যা মানুষ একাকি কিংবা দলগতভাবে উপভোগের উদ্দেশ্যে সম্পাদন করে যেখানে অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকে না।
ব্যক্তির মানসিক উপভোগের লক্ষ্যে শারীরিক কসরত-শক্তি ও মেধাকে কাজে লাগানো হচ্ছে খেলাধুলা।
তবে এ সংজ্ঞা গুলোর সাথে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে খেলা আনন্দ ও উপভোগের পাশাপাশি মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বা উপকার সাধিত হতে হবে এবং শরীয়তের মূলনীতির আলোকে হতে হবে।
খেলাধুলা বৈধ হওয়ার জন্য শরীয়তের কতিপয় মূলনীতি সমূহ:
১. আল্লাহ বিমুখতার দিকে যাতে ঠেলে না দেয়: যেই খেলা নামাজ, আল্লাহর জিকির ও শরীয়তের মৌলিক বিধিবিধান পালন , পিতা-মাতার খেদমত ইত্যাদি থেকে বিরত রাখে সেই খেলা বৈধ নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
হে মুমিনগণ ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয় , তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা মুনাফিকূন : ৯)।
যে সব বিষয় মানুষকে দুনিয়াতে আল্লাহ থেকে গাফেল করে , তন্মধ্যে দু’টি সর্ববৃহৎ ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি। তাই এই দু’টির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। নতুবা দুনিয়ার যাবতীয় ভোগ-সম্ভারই উদ্দেশ্য। আয়াতের সারমর্ম এই যে, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মহব্বত সর্বাবস্থায় নিন্দনীয় নয়। বরং এগুলো নিয়ে ব্যাপৃত থাকা এক পর্যায়ে কেবল জায়েযই নয় -ওয়াজিবও হয়ে যায় । কিন্তু সর্বদা এই সীমানার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এসব বস্তু যেন মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে দেয় । তেমনিভাবে খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রেও একই হুকুম প্রযোজ্য হবে। এখানে ‘আল্লাহর স্মরণের’ অর্থ কোন কোন তফসীরবিদের মতে পাঁচওয়াক্ত নামাজ, কারও মতে হজ্ব ও যাকাত এবং কারও মতে কোরআন। হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন : স্মরণের অর্থ এখানে যাবতীয় আনুগত্য ও এবাদত। এই অর্থ সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। (তফসীরে মাআরেফুল ক্বোরআন)।
২. আক্বীদা বা বিশ্বাসগত ত্রুটি-বিচ্যুতি না থাকা: যে খেলা ঈমান- আক্বীদার সমস্যা করে, বা আক্বীদা পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে তা খেলা হারাম । বর্তমানে কিছু ইলেকট্রনিক বা অনলাইন খেলায় এ রকম কিছু সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে। যেমন: ঢ়ঁনম খেলা। এবং কোন প্রাণীর ছবি ও মূর্তি না থাকা।
৩. জুয়া,বাজি ও আর্থিক লেনদেন নিষিদ্ধ : যে খেলায় জুয়া, বাজি ও আর্থিক লেনদেন থাকে তা হারাম । আল্লাহ তায়ালা বলেন:
হে মুমিনগণ, এই যে মদ , জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ তো নয়। অতএব , এগূলো থেকে বেঁচে থাক- যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও । (সূরা মায়িদাহ: ৯০)। এছাড়াও জুয়া নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে আরো অনেক দলিল কুরআন ও হাদিসে রয়েছে।
৪. অধিক সময় ব্যয় না করা: খেলাধুলার ক্ষেত্রে সময়ের খুব বেশি অপচয় না হয় সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। আর পূর্ণাঙ্গ সময় তো দেওয়া যাবেই না। কেননা সময় হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। সময়ের সমষ্টিই হচ্ছে জীবন। জীবনের প্রতিটি মূহূর্তের হিসাব দিতে হবে।
আবু বারঝাহ আল আসলামী (রা.) থেকে বর্ণিত রসূল (সা.) বলেন: কিয়ামতের দিন কোন ব্যক্তি নিন্মোক্ত প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত তার দুই পা সামনে বাড়াতে পারবে না; তার জীবন কোথায় ব্যয় করেছে? তার জ্ঞান কোন কাজে লাগিয়েছে ? তার সম্পদ কিভাবে উপার্জন ও কোন খাতে ব্যয় করেছে? এবং তার শরীর কোন কাজে ব্যয় করেছে?। (তিরমিজী: ২৪১৭, হাদিস সহীহ)।
অতএব আমাদেরকে সময়ের গুরুত্ব দিতে হবে।
এ ছাড়া খেলার মাধ্যমে প্রসিদ্ধি সুনাম সুখ্যাতি লাভের চেষ্টা করা যাবে না। খেলাকে পেশা হিসেবে না বানানোর পক্ষেই অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের অভিমত।
জীবনের জন্য ঝুঁকি না হওয়া: এমন কোন খেলাধুলা করা যাবে না যা নিজের জীবন নাস কিংবা প্রবল আহত হওয়ার আশংকা থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: তোমরা নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না। (সূরা বাকারা: ১৯৫) ৬. কারো ক্ষতি না করা: খেলার আওয়াজ বা অন্য কোনভাবে প্রতিবেশি বা অন্য কারো কোন ক্ষতি সাধন না করা।
৭. শালীনতা বজায় রাখা : খেলাধুলায় শালিনতা বজায় রাখতে হবে। গালাগালি ও বকাঝকা ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। জয় পরাজয় নিয়ে যাতে ঝগড়া-বিবাদ,কলহ, শত্রুতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৮. পর্দার বিধান রক্ষা করা: নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও দেখা সাক্ষাৎ যাতে না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। যা সর্ব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। খেলোয়ার ও দর্শকদের সতর আবৃত থাকতে হবে। সাধারণত ফুটবল খেলায় সতর আবৃত থাকে না । এভাবে সতর খুলে খেলা ও খেলা দেখা কোনটিই জায়েজ নয় । পুরুষের সতর হলো নাভি থেকে হাটু পর্যন্ত ঢেকে রাখা। আর অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে মহিলাদের সতর হচ্ছে আপাদমস্তক।
প্রাগুক্ত মূলনীতি সমূহ মেনে যে খেলাধুলাও চিত্তবিনোদন করা সম্ভব, সে গুলো জায়েয হবে ইনশা আল্লাহু তায়ালা।
হাদিসে বর্ণিত কিছু নিষিদ্ধ খেলা সমূহ: রাসূলে কারীম (সা:) কিছু খেলাকে নিষিদ্ধ করেছেন । যেমন:
ক. পাশা খেলা। সুলাইমান বিন বুরাইদাহ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন , নবী কারীম সা: বলেন : যে ব্যক্তি পাশা খেলল সে যেন তার হাত কে শুকরের গোশত ও রক্ত দ্বারা রঙ্গিন করল। (সহীহ মুসলিম: ২২৬০) ইমাম নববী বলেন: জমহুরের মতে পাশা খেলা হারাম। এ জাতীয় দাবা,লুডু খেলাও মাকরুহ। তাই এ গুলো থেকে বেচে থাকা মুমিনের কর্তব্য।
খ. কারো নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু নিয়ে খেল তামাশা না করা: আব্দল্লাহ ইবনে সায়ীব ইবনে ইয়াযীদ তার পিতা থেকে তার পিতা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রসূলুল্লহ (সা:) বলেন : তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের লাঠি (নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস) খেলাচ্ছলে কিংবা ইচ্ছা করে না লুকায়, যদি কেউ লুকিয়ে রাখে সে যেন তা মালিকের নিকট ফিরিয়ে দেয়। (তিরমিজী: ২১৬০)।
গ. কবুতর নিয়ে খেলা করা। কবুতর নিয়ে খেলা করা জায়েজ নাই । কেননা এতে কোন উপকার নাই ।
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : রসূলুল্লাহ সা: এক ব্যক্তিকে কবুতরের পিছনে ছুটতে দেখে বললেন : এক শাইত্বান আরেক শাইত্বানের পিছনে ছুটছে। (আবু দাউদ: ৪৯৪০) ইমাম সিনদী বলেন : অনর্থক কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে তাকে শাইতান বলা হয়েছে যা তাকে আল্লাহর স্বরণ থেকে বিরত রাখে।
উল্লেখিত খেলাধুলা ছাড়াও আরো অনেক নিত্য নতুন খেলা রয়েছে, যে গুলোর প্রকৃতি ও ধরন বিস্তারিত জেনে হুকুম প্রদান করতে হয়। সুতরাং সে গুলো সম্পর্কে কোন বিজ্ঞ আলেম থেকে জেনে নিতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ ও সে অনুযায়ী যাবতীয় আমল বিশেষ করে খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রে তা পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করেন। আমীন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন