শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সৌরশক্তি ব্যবহারে সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা

নাজমুন্নাহার নিপা | প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৩ এএম

ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এর ফটোইলেক্ট্রিক ইফেক্টকে কাজে লাগিয়ে ফটোভোল্টাইক কোষের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় গত শতাব্দীতে। ১৯৮০ সালের দিকে উদ্ভাবিত এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করে সূর্যের তাপকে কন্সেন্ট্রেটেড সোলার পাওয়ারে রূপান্তরিত করে পানিকে বাষ্প ও বাষ্প দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কৌশল এখন অনেক জনপ্রিয়। এছাড়াও রয়েছে পানি বিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস, ধানের তুষ, ইক্ষুর ছোবড়া, বর্জ্য, শিল্প প্রক্রিয়ার অব্যবহৃত তাপ হতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইত্যাদি

বর্তমানে সোলার প্যানেল দ্বারা গৃহস্থালির নিত্য প্রয়োজনে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। সোলার প্যানেল অসংখ্য ফটোভোল্টাইক সেলের সমষ্টি, যা সূর্যের আলোকশক্তিকে ব্যবহারোপযোগী বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তর করে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৮০,০০০ সোলার হোম সিস্টেম বিক্রি হচ্ছে। সারাদেশে প্রায় ৩০ লক্ষ সোলার হোম সিস্টেম বিভিন্ন এনজিওর সাহায্যে ইন্সটল করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য শক্তির উপর নির্ভরতা বাড়ছে।
নবায়নযোগ্য এনার্জির জন্য সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে সোলার পার্ক, সোলার মিনি গ্রিড, সোলার রুফটপ, সোলার ইরিগেশন ইত্যাদি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বায়ুশক্তি কাজে লাগিয়ে জেনারেটরের টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র মুহুরী প্রজেক্ট বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রে অবস্থিত ৪টি ২২৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন টারবাইন দিয়ে প্রায় এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ায়, কুতুবদিয়া বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২০ কিলোওয়াট ক্ষমতার ৫০টি টারবাইন দ্বারা ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। বায়োগ্যাস এবং বায়োমাস থেকেও দেশের বিভিন্ন স্থানে জ্বালানির চাহিদা মেটানো হচ্ছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা অনুযায়ী, সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ১৩টি স্থানে উইন্ড রিসোর্স ম্যাপিং চলছে। চট্টগ্রাম বিভাগে পানিবিদ্যুতের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া আরও যেসব ক্ষেত্রে সমীক্ষা কাজ শুরু হয়েছে, সেগুলো হলো সোলার বোটিং সিস্টেম, শিল্পক্ষেত্রে সোলার ওয়াটার হিটিং, মৎস্যচাষে সোলার ওয়াটার সাপ্লাই, পৌরবর্জ্য হতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প স্থাপনায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সোলার রুফটপ সিস্টেম স্থাপন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সোলার রুফটপ সিস্টেম স্থাপন ইত্যাদি
নবায়নযোগ্য জ্বালানি ঘিরে ক্রমেই সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব এই জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রোল মডেলে পরিণত হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গ্লোবাল স্ট্যাটাসের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। আর নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের বৈশ্বিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিনিউঅ্যাবল এনার্জি এজেন্সির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সৌরবিদ্যুৎ খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। এর মাধ্যমে দেশের ১ লাখ ৩৭ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে সৌরবিদ্যুৎ। বর্তমানে সারাদেশে ১ হাজার ৪৬৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার সোলার পার্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। সরকারি বিভিন্ন ইউটিলিটি কর্তৃক আরও ৩৯০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সোলার পার্ক স্থাপনের কার্যক্রম বাস্তবায়নাধীন আছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ১ হাজার ৯৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সোলার পার্কের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা সম্ভব হবে। দেশের গ্রিডবহির্ভূত গ্রামীণ এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ইডকলসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দ্বারা এরই মধ্যে প্রায় ৫৮ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে প্রতি বছর ২২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ১ লাখ ৮০ হাজার টন কেরোসিন সাশ্রয় হয়েছে। এ ছাড়া দুর্গম ও দ্বীপাঞ্চলে সোলার মিনিগ্রিড প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ পর্যন্ত ১৯টি সোলার মিনিগ্রিড প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আরও ৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। গ্রেডার তত্ত্বাবধানে ইডকল কর্তৃক মনপুরা দ্বীপকে ১০০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক দ্বীপ হিসেবে গড়ে তুলতে বিদ্যুতায়নের কার্যক্রম চলমান আছে। কিছুদিন আগেই ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরে সুতিয়াখালী ৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প পরীক্ষামূলক উৎপাদনে গেছে। ১৭৪ একর জমির ওপর ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ পর্যন্ত এটি দেশের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প। সৌরশক্তি ব্যবহারের কয়েকটি নতুন প্রযুক্তি নিম্নে উল্লেখ করা হলো, যার মাধ্যমে আমরা সহজেই এই শক্তি ব্যবহার করতে পারব।
রেডিসেট পাওয়ার সিস্টেম: রেডিসেট পাওয়ার সিস্টেম শুধু সোলার চার্জারই নয়, এটি নবায়নযোগ্য এনার্জি সিস্টেম, যা সোলার প্যানেল, বাইসাইকেল জেনারেটর, গ্রিড ইলেকট্রিসিটি ইত্যাদি থেকে চার্জ করা সম্ভব। পরবর্তীতে এটির ব্যাটারি চার্জকে কাজে লাগিয়ে আলো থেকে শুরু করে ছোটখাটো ইলেকট্রনিক যন্ত্র চার্জ দেওয়াও সম্ভব।
সানওয়াটার: সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সৌরশক্তি সংগ্রহ করে তা দিয়ে পাম্পের মাধ্যমে চাষের প্রয়োজনে জমিতে পানি দেওয়ার প্রকল্পটিই হচ্ছে সানওয়াটার। এতে করে যেমন বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় চাষের জন্য পানি সরবরাহ করাটা সহজ, অন্যদিকে ঠিক তেমনই খুব কম খরচে প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহার করেই ফসল উৎপাদনে সহযোগিতা করা সম্ভব। গ্রিনলাইট প্ল্যানেট সান কিং: সান কিং প্রো’তে ব্যবহার করা হয়েছে লিথিয়াম ফেরো-ফসফেট (এলএফপি) ব্যাটারি। এটি সূর্যের আলো ব্যবহার করে চার্জ করে নিলে তা দিয়ে পরবর্তীতে মোবাইল চার্জ করা ও আলো জ্বালানো সম্ভব। এ প্রকল্পে ব্যবহৃত ব্যাটারিটি লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির চেয়েও শক্তিশালী।
ডি.লাইট এস ২০: পরিপূর্ণ চার্জে এস২০ টানা আট ঘণ্টা আলো প্রদানে সক্ষম। এটি ৩৬০-ডিগ্রি কোণ থেকে আলো দেয় যাতে করে আলোটি ছড়িয়ে যায় এবং সে আলোতে কাজ করা সম্ভব হয়। সোলার প্যানেলের মাধ্যমে এ যন্ত্রটি চার্জ করা যায়। এছাড়াও নোকিয়ার এসি চার্জার দিয়ে বা ইউএসবি কেবলের মাধ্যমেও এটি চার্জ করা সম্ভব।
সৌরচালিত অটোরিকশা: সম্প্রতি সৌরচালিত অটোরিকশা নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশেরই একজন রিকশাচালক ইউনুস মিয়া। সৌরশক্তি দিয়ে চার্জ হয় এমন একটি রিকশা বানিয়েছেন তিনি। দিনে মাত্র দুইবার চার্জ দিলে পুরো দিন চালানো যায় এই রিকশা। নির্মাণে ৫০ হাজার টাকা খরচ হলেও টানা ২০ বছরের ওয়ারেন্টি রয়েছে এই রিকশাটিতে।
সৌরচালিত নৌকা: সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক আবিষ্কার করেছেন সৌরচালিত নৌকা। এ নৌকা নিজেই সব ধরনের দুর্ঘটনা এড়াবে। দেশে প্রতি বছর নৌকা, লঞ্চ ও জাহাজডুবিতে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটে। অসচেতনতা ও আইন না মেনে বেশি যাত্রী আরোহণের কারণে এ দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়ার কারণে এবং প্রযুক্তির ব্যবহার না থাকায় নৌদুর্ঘটনা ঘটছে অহরহ। এ সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশি তিন গবেষক উদ্ভাবন করেন সৌরচালিত নৌকা। নৌকাটি সোলার প্যানেলের মাধ্যমে শক্তি সংগ্রহ করে। নৌকা যখন ঘাটে থাকবে তখন তার কোনো বিদ্যুৎশক্তি খরচ না হলেও সোলার প্যানেল সিস্টেম থাকার কারণে ব্যাটারি চার্জ হতেই থাকবে। একবার ফুল চার্জ হলে ১২ জন যাত্রীর উপযোগী এই নৌকাটি টানা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা চালানো সম্ভব।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (গ্রেডা) কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ২৩টি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান আছে। আর এগুলো বাস্তবায়ন হলে এর মাধ্যমে ১ হাজার ২২০ দশমিক ৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। আশার কথা, সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে দেশের ১ কোটির বেশি মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে। আবার নবায়নযোগ্য জ্বালানির ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ খরচও অন্যান্য জ্বালানির তুলনায় কম।
গ্রেডার দেওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে সৌর প্যানেল (সোলার প্যানেল) থেকে ৪১৫ মেগাওয়াট, বায়ু থেকে ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট, জল থেকে ২৩০ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাস থেকে দশমিক ৬৩ মেগাওয়াট এবং বায়োম্যাস থেকে দশমিক ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। আবার ভালো সম্ভাবনা থাকায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বিনিয়োগে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ অংশীদারি কোম্পানি গঠনে চুক্তি করেছে চীন।
বর্তমানে জার্মানির ব্যবহৃত মোট জ্বালানির প্রায় ৩০ শতাংশ জোগান দেয় নবায়নযোগ্য সৌর ও বায়ুশক্তি। আর ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটির মোট ব্যবহৃত জ্বালানির ৪৫ শতাংশ জোগান দেবে নবায়নযোগ্য সৌর ও বায়ুশক্তি। আর ২০৫০ সালের মধ্যে এটি হবে ৮০ শতাংশ। জার্মানি ২০২২ সালের মধ্যে তাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সৌর শক্তির বিকাশ ও ব্যবহার পরিবেশকে দূষিত করে না, এটি একটি পরিচ্ছন্ন শক্তি। প্রতি বছর পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশে পৌঁছে যে সৌর বিকিরণ তা ১৩০ ট্রিলিয়ন টন কয়লার সমান হয়, যা বিশ্বে বৃহত্তম শক্তি হিসেবে উপগণিত হচ্ছে। ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা ছাড়াই পৃথিবীতে সূর্যালোক জ্বলছে, ভূমি বা সমুদ্রের উপরে, উচ্চ পর্বত বা দ্বীপগুলি সর্বত্রই উন্নত এবং ব্যবহারযোগ্য, সংগ্রহ করা সহজ, এবং শোষণ ও পরিবহনের কোনো প্রয়োজন নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন