বরগুনার তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের বড় অংকুজানাপাড়ায় নির্মাণাধীন চায়না পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানির তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সরকারি বন্দোবস্তপ্রাপ্ত ২৩টি পরিবারের জমি দখল করে নিলেও আড়াই বছরে ফেরত পায়নি জমির মূল্য। মামলা-হামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ অব্যাহত নানাবিধ হয়রানির শিকার হয়ে আদালতের স্মরণাপন্ন হয় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। আদালত জমির স্থিতিবস্থা বজায় রাখার জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা আমলে না নিয়ে দ্রুত জমি ভরাট, অবকাঠামো নির্মাণ করে যাচ্ছে তাপ বিদ্যুৎ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তালতলীতে এ তাপ বিদ্যুৎ কোম্পানি জমি দখলের পূর্বে নির্ধারিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতো ১৪৭টি ভ‚মিহীন পরিবার। মামলা, হামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এ পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করা হয়। নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুনর্বাসনের কথা বলা হলেও সর্বস্ব হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে উচ্ছেদকৃতদের অনেকেই। পরিবারপ্রতি সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা প্রদান করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। বাস্তÍহারা পরিবারগুলোর অনেকেই একই এলাকায় প্রাপ্ত টাকার সিংহভাগ খরচে স্বল্প পরিমাণ জমি ক্রয় করে বসতঘর তৈরি করেন। সেখানে নেই রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র, শিক্ষা-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। নেই নিজস্ব কোন জমি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ। একমাত্র মৎস্যের উপর নির্ভরশীল এ পরিবারগুলো মৎস্য সঙ্কটের কারণে বর্তমানে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
২০১৮ সালে চীনের পাওয়ার চায়না রিসোর্স লিমিটেড এবং বাংলাদেশের আইসোটেক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইসোটেক ইলেকট্রিফিকেশন কোম্পানি লিমিটেড ও বরিশাল ইলেট্রিক পাওয়ার কোম্পানি যৌথভাবে তাপ বিদ্যুৎ কোম্পানির বাস্তবায়ন কার্যক্রম এলাকাবাসীর তীব্র বিরোধিতার মুখে শুরু করে। সরকারি খাস জমি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ, ব্যক্তিগত জমি ক্রয় এবং ক্রয়ের নামে চলে দখলদারিত্ব। ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূমিতে গড়ে তোলা ভূমিহীন দরিদ্র ১৪৭টি পরিবারকে উচ্ছেদ করে জমি অধিগ্রহণ, মাটি ভরাট ও তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে নেয়। ১২৪টি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। ২৩টি ভূমিহীন পরিবারের মাঝে সরকারের বরাদ্দকৃত ২৩ একর আবাদি জমি দখলের আড়াই বছরেও কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি ভুক্তভোগীরা। ভুক্তভোগীরা বরগুনা সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে জেলা প্রশাসকসহ তাপ বিদ্যুৎ কোম্পানির ৯ জনকে বিবাদী করে মামলা দায়ের করেন ২০১৮ সালে।
প্রাথমিকভাবে ১৭৪ একর জমির ওপর স্থাপনকৃত এ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে বনাঞ্চল উজাড়, ইলিশ প্রজণন কেন্দ্র নষ্ট, পরিবেশের ভারসাম্য অরক্ষণ, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ইত্যাদির আশঙ্কা করছেন স্থানীয় সচেতন নাগরিক সমাজ। প্রজনন মৌসুমে সমুদ্রের লবণ পানি থেকে উঠে এসে মা ইলিশ ডিম ছাড়ে এখানে। নদীপারের খোট্টার চরে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে এই নদীতে আসবে কয়লা ভর্তি জাহাজ। আর নদীপাড়ে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকালে নদীর পানি শুধু উত্তপ্তই হবে না দূষিতও হবে। যার বড় প্রভাব পরবে ইলিশের ওপর। খোট্টার চরের আশেপাশে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু বনাঞ্চল। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সুন্দরবন নামে পরিচিত টেংরাগিরি বনও রয়েছে মাত্র ১ থেকে ২ কিলোমিটারের মধ্যে।
এ ব্যাপারে তালতলী উপজেলা ভূমিহীন সমবায় সমিতির সভাপতি গাজী মো. চান মিয়া বলেন, তাপ বিদ্যুৎ কোম্পানি আমাদের সাথে কোন আলোচনা না করেই ভূমিহীনদের নামে বরাদ্দকৃত জমি দখলে নেয়। আমরা বাঁধা দিতে গেলে পুলিশ দিয়ে মারধর করে তাড়িয়ে দেয়। ৮ জনের নামে ৩০ লাখ টাকার চাঁদাবাজী মামলা দায়ের করে।
নিশানবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও ১নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, তাপ বিদ্যুতের নামে একটি চক্র টাকার জোর খাটিয়ে তাদের শেষ সম্বলটুকু ছিনিয়ে নিয়েছে। যা অত্যন্ত অমানবিক। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হাত ছাড়া হওয়ায় এখন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে। ভূমিহীনদের ন্যায়সংগত অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা কামনা করছেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন