বিশ্ব একবিংশ শতাব্দীতে পা রেখেছে। এগিয়ে যাচ্ছে নতুন সহস্রাব্দের দিকে। উন্নত সভ্যতার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা যখন নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের কথা বলছি, তখন স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে, সারাবিশ্বের নারী সমাজের অবস্থা এক রকম নয়। গত তিন দশকে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার নারী সমাজে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু এও সত্য যে, নারী সামাজের এই অগ্রগতি কোনো অবস্থাতেই একই সময়কালে পুরুষ সমাজের অর্জিত অগ্রগতির সমকক্ষ নয়। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারী সমাজের অবস্থান তো এখনো রীতিমত আশাঙ্কাজনক। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছে প্রায় ৫০ কোটি নারী। উন্নত দেশগুলোতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা নারীদের সংখ্যাও কম নয়। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, ইতালি, নরওয়ে, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশের কথা বাদ দিয়ে সমগ্র বিশ্ব প্রেক্ষাপট তুলে ধরলে বর্তমানে বিশ্বে নারীদের অবস্থা আরো স্পষ্ট হবে। বিশ্বের অশিক্ষিত জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ নারী এবং বিশ্বের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারি ৭০ শতাংশই নারী।
বেগম রোকেয়া থেকে বেগম সুফিয়া কামাল পর্যন্ত যে সময় অতিবাহিত হয়েছে, সে সময়ে তারা যে, বাংলার নারীর স্বীয় মর্যাদা, অধিকার নারীমুক্তির অবিচ্ছেদ্য সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন তা আজ আমাদের কাছে নারীমুক্তি আন্দোলনের উদাহরণ ও প্রেরণা। তবে কেন জানি আজও নারীরাই পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক নয়। এর পিছনে আর্থসামাজিক পরিবেশই দায়ী। ফলে নারীর সমঅধিকার ও নারী মুক্তির কথা জোর গলায় বলা হচ্ছে। কিন্তু নারীর অবস্থানে প্রত্যাশিত পরিবর্তন হচ্ছে না। আজও অসংখ্য নারী নানাভাবে নানামুখী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সবক্ষেত্রেই নিরাপত্তার অভাব অনুভব করছে। আজও অসংখ্য নারী এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ আর যৌতুকের শিকার হচ্ছে। এমন একটি দিনও নেই যেদিন খবরের কাগজ এসব ছাপা হচ্ছে না। যদিও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে নারী সমাজের অংশগ্রহণও লক্ষনীয়। গার্মেন্ট শিল্পে লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক কাজ করছে। আবার পরীক্ষায় মেধাতালিকায়ও মেয়েদের প্রাধান্য লক্ষ করা যাচ্ছে। তারপরও কোথায় যেন চাহিদা এবং প্রাপ্তির অপূর্ণতা লক্ষনীয়। চাহিদা এবং প্রাপ্তির মেলবন্ধন এক এবং অভিন্ন হওয়া উচিত।
নারী যদি শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হয়, তবে সে সচেতন হয় না। তার আয় বাড়ে না, ফলে সে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়, যা নারীকে দুর্বল করে দেয়। নারীর প্রধান শক্তি হলো শিক্ষা। নারীশিক্ষার বিস্তার ঘটলে নারীর কর্মসংস্থান হবে, আয় বাড়বে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে। তাই নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিৎ, নারী শিক্ষা বিস্তার। সরকারের প্রশংসনীয় পদক্ষেপের একটি হচ্ছে সর্বস্তরে সার্বজনীন শিক্ষা। এই শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকার পরও প্রশ্ন আসে, নারী শিক্ষার অগ্রগতি কতটুকু? সরকার বা সরকারিভাবে যা দরকার তা চালু আছে, তা চলছে। কিন্তু এই আহবানে সামাজিক বা পারিবারিকভাবে জনগণ কতটুকু সুযোগ-সুবিধা নারীদের দিচ্ছে? যতক্ষণ না আমাদের সামাজিক এবং পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর শিক্ষা লাভে ইতিবাচক দৃষ্টি পড়বে, ততক্ষণ নারী শিক্ষার উন্নয়ন শতভাগ হবে না। শিক্ষা ছাড়া যেকোন মানুষ অন্ধ, সে নারী হোক কিংবা পুরুষ। তাই নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত নারী শিক্ষা বিস্তার।
দেশের অর্থনীতিতে, সমাজ বিনির্মাণে এখন নারীর অবদান অনস্বীকার্য। তবে স্বীকার করতেই হবে, এ নারী এখনো ব্যাপক বৈষম্য-বঞ্চনা, নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার। পরিবার, সমাজ, বাইরের কর্মজগতে তাকে অধিকার আদায়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। নারীকে সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মান্ধতা এবং অশিক্ষার কারণেও তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বৈষম্য আমরা দেখেছি। এছাড়া যৌতুক, বাল্যবিবাহ, পারিবারিক সহিংসতা, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ বা হত্যার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে, যা কোনভাবেই শুভ হতে পারে না। বন্ধ করতে হবে সব ধরনের নারী নির্যাতন। নারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
নারীর উন্নয়ন ছাড়া পরিবারের উন্ন্য়ন সম্ভব নয়। আর পরিবারের সমৃদ্ধি ছাড়া সামাজিক উন্নয়ন অসম্ভব। সামাজিকভাবে উন্নতি সাধন হলে রাষ্ট্রের সফলতা আসে। নারী অধিকার ক’জনে জানে কিংবা ক’জনে বুঝে? সফলতা অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও আসবে। দেশের কাজে, আত্মদানের গৌরবে, ধর্ম, সমাজ, সংসারে নারীর ভূমিকা অনন্য। বস্তুত নারীর মর্যদা আর অবস্থান থেকেই অনুধাবন করা যায় একটি দেশ কতখানি সভ্য এবং উন্নত। তাই নারীকে পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা দেবার জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা শ্রেণী নির্বিশেষে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন