সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

শায়খুল হাদীস আল্লামা ফখরুদ্দীন জাতজামী (রহ.)

প্রফেসর ড. মো: ময়নুল হক | প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০২ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর

এ হাদীসটির উপর তাকরীর করেছিলেন খুবসম্ভবত দুই সপ্তাহ এবং এ হাদীসের উপর দেড় শতাধিক প্রশ্নোত্তর করার পর সবচেয়ে আরাধ্য সেগুলোর উপর নিজের হাতে লেখা প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত নুসখা পেলাম যা দীর্ঘ দিন আমার নিকট সংরক্ষিত ছিলো। আল-হাদীস বিভাগের ছাত্রদের মাঝে আমার উস্তাদ জীবন্ত কিংবদন্তি মাওলানা ফখরুদ্দিন সাহেবের গল্প বলছিলাম, বলছিলাম একটা হাদীসের উপরে দেড় শতাধিক প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত নুসখার গল্প। একদিন আমার এক প্রিয়ভাজন ছাত্র এসে নুসখার আবদার জানালে আমি তাকে দিলাম যাতে সে ফটো কপি করে ফেরত দেয়। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য আমার উস্তাদের নিজের হাতের লেখা নুসখাটা আর ফেরত এলো না, যা এখনো আমাকে কষ্ট দেয়।

১৯৮৮ইং কামিল ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বেই খাতমে বুখারীর তাকরীর শেষ হলো। উস্তাদ আল্লামা ফখরুদ্দিন (রহ.) আমাদের কয়েকজনকে সিহাহ সিত্তার সনদ সরবরাহ করলেন এবং ভাইবা বোর্ডে যেনো আমরা হাদীস বর্ণনা সনদসহ করি সে তাকীদও দিলেন। ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ভাইবা নিতে আগমন করলেন ছারছানী দারুস সুন্নাহ মাদরাসার স্বনামধন্য অধ্যক্ষ মাওলানা শরীফ মো: আব্দুল কাদির (রহ.)। আমি ভাইবা বোর্ডে ঢুকে সালাম বাদ বসলাম। বুখারী শরীফের প্রথম হাদীসটি পড়তে বলা হলো। আমি শুরু করলাম হাদ্দাসানা শায়খুনা আল্লামা ফখরুদ্দি ইবনু মুফতী শাফিউর রহমান আন মুফতি সাইয়্যেদ আমীমুল ইহসান ইবনুস সাইয়্যেদ আব্দুল মান্নান আল-মুজাদ্দেদী আল-বারাকাতী বলার পরই বোর্ডে উপস্থিত আমার আরেক উস্তাদ শায়খুল হাদীস আল্লামা ওজিহ উদ্দিন আমাকে থামতে বললেন। এরপর উস্তাদ বললেন আমার এবং ফখরুদ্দিন সাহেবের একই উস্তাদ এবং সনদ একই। আমি পুনরায় শুরু করলাম হাদ্দাসানা উস্তাযুনাল মুহতারাম শায়খুল হাদীস আল্লামা ফখরুদ্দিন ওয়া উস্তাযুনাল মুহতারাম শায়খুল হাদীস আল্লামা ওজিহ উদ্দিন আন মুফতি সাইয়্যেদ আমীমুল ইহসান ইবনুস সাইয়্যেদ আব্দুল মান্নান আল-মুজাদ্দেদী আল-বারাকাতী বলতে বলতে ইমাম আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনু ইসমাঈল আল-বুখারী (রহ.) পর্যন্ত সনদ মুখস্থ বললাম, এরপর ইমাম বুখারীর উস্তাদ থেকে নিয়ে রাসূল (সা.) পর্যন্ত সনদ বুখারী শরীফের লিখিত সনদ পড়ে হাদীস পাঠ করলাম। পড়া শেষ হওয়া মাত্রই সুবহানাল্লাহ বলে মাওলানা আব্দুল কাদির সাহেব বোর্ডে উপস্থিত আমার দুই উস্তাদকে প্রশংসায় ভাসালেন। ভাইবা শেষ হলে আমাদের কয়েকজনকে পুনরায় ডেকে নেয়া হলো। আমি কিছুটা স্তম্ভিত ছিলাম কী না কী হয় সেটা ভেবে। যাহোক ভিতরে ঢুকার পর মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ আব্দুল কাদির সাহেব আমাদের বায়োডাটা চাইলেন এবং বললেন তোমাদের চাকুরী আমি দেবো। আমি ততদিনে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্র কাজেই বললাম পরে যোগাযোগ করবো ইনশা আল্লাহ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আমি যখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে যোগদান করলাম তখন শুনলাম আমার উস্তাদ মাওলানা ফখরুদ্দিন সিলেট আলিয়ায় যোগদান করেছেন। মনের বাসনা ছিলো উস্তাদের পায়ে সালাম ঠুকবো কিন্তু সেটা হয়ে উঠলো না। সিলেটের অধিবাসী আমার হাদীস বিভাগের প্রিয় ছাত্র মঈনুল ইসলাম পারভেজকে বললাম আমার উস্তাদকে আমার তরফ থেকে সালাম জানাবে এবং আমার অনুরোধটাও জানাবে উনি যেন দয়া করে উনার হাদীসের সনদটি আমাকে দান করেন, কারণ কামিল ভাইবার আগে যেটি দিয়েছিলেন সেটি হারিয়ে গেছে এবং আমি এখানে হাদীসের খেদমতের সুযোগ পেয়েছি। (আল্লাহ আমার উস্তাদকে জাযায়ে খাইর দান করুন এবং বেহেশতে উঁচু মাকাম দান করুন।) মঈনুল ইসলাম পারভেজের মুখে আমার কথা শুনার পর উস্তাদ নিজে থেকেই বলেছেন ও ময়নুল কাজী সিরাজ ও মুফিজের বন্ধু। এরপর উস্তাদ আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন এ বলে যে তার সন্তান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-হাদীস বিভাগের টিচার হয়েছে। আমার উস্তাদ মাওলানা ফখরুদ্দিন (রহ.) এর প্রিন্ট করা সনদ যা ফটোকপি করে দিয়েছেন তিনি, সেটি যখন আমার ছাত্র আমার হাতে পৌছালো তখন কী যে আনন্দ হচ্ছিল ভাষা তা ধারণ করতে সক্ষম নয়। বিষ্ময়ের ঘোর কাটতেও বেশ সময় লাগলো যে আমার উস্তাদ কতটা আন্তরিক হলে আমার ছাত্রের হাতে আমার জন্য এমন উপহার তিনি দিতে পারেন। তিনি আমাকে ইজাজাহ প্রদান করেছেন সিহাহ সিত্তার সনদের এবং তাতে ০৮.০৯. ২০০৫ইং স্বাক্ষর করে পাঠিয়েছেন। আমি আমার ছাত্রদেরকে জানালাম এ সুখের খবর যা অনেকেই বিষ্ময় প্রকাশ করছিলো যে আমার উস্তাদ থেকে রাসূল (সা.) পর্যন্ত সনদের মেল বন্ধন এখন আমার হাতে। আমি হাদীস বর্ণনা করছি যেন আল্লাহর রাসূলের মুখ থেকে। আল্লাহ আকবার, এটাই ইসলাম।

২০০৬ইং অগাষ্ট মাসে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদরাসাগুলো এসে গেলো। ভাবলাম কোন এক ফাকে সিলেট গিয়ে উস্তাদের সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটাবো। আমাদের ইবির অধীনে কামিল পরীক্ষা-২০০৭ ও ২০০৮ এক সাথে শুরু হলো। মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ফয়েজ মুহাম্মদ সিরাজুল হক সাহেব আমাকে বললেন সিলেট আলিয়ার পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনে আমার সাথে তোমাকে যেতে হবে। আমি খুব আনন্দিত হলাম কারণ আমার উস্তাদের সাক্ষাৎ মিলবে। কিন্তু যেয়ে শুনলাম উনি দু’বছর আগেই অবসরে চলে গেছেন। এখন হয়তো চট্টগ্রামে আছেন এ ভাবনা নিয়েই ফিরে এলাম সিলেট থেকে। এর বছর দুয়েক পরে আমার ছাত্র ও কলিগ ড. সৈয়দ মাকসুদূর রহমান(আল-হাদীস এন্ড ইসলামিক ষ্টাডিজ বিভাগের ১ম ব্যাচের ছাত্র ও গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত ছাত্র এবং বর্তমানে বিভাগীয় সভাপতি) চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদরাসায় ভাইবা নিতে গিয়ে আমার উস্তাদ (মাওলানা ফখরুদ্দীন রহ.) এর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়, কারণ আমার মুখে বহুবার আমার উস্তাদের নাম সে শুনেছে। তার সাক্ষাৎ পরবর্তীতে আমি জানতে পারলাম উস্তাদ এখনও হাদীসের দারসে রয়েছেন চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদরাসায় যা আমাকে আরোও আনন্দিত করলো। হঠাত চট্টগ্রাম থেকে উস্তাদের একটি চিঠি আমার কাছে পৌঁছালো যেটি পাঠিয়েছিলেন তিনি ০৯.০৮.২০০৯ইং। চিঠি খুলে আনন্দের অশ্রু বন্যায় ভেসে যাচ্ছিলাম, চিঠিটি বারবার পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম, আমি উস্তাদের আজিজম প্রফেসর। উস্তাদ আমার এবং প্রফেসর ড. আ. ন. ম. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) এর যৌথভাবে লেখা ”বহুস ফি উলুমুল হাদীস” বইটি পুরোটা পড়েছেন এটিও আমাকে বিস্মিত করেছে। কামিল হাদীসে ঢাকা আলিয়াতে পড়াকালীন যেভাবে আমাদেরকে আপনি সম্বোধন করে কথা বলতেন, সেভাবেই চিঠিতেও সে ভাষার প্রয়োগ আমাকে টেনে নিয়ে গেলো ছাত্র জীবনের সেই সোনালী অতীতে। যে অতীত আমাকে এখনও ভাবিত করে দল বেঁধে আলিয়া হোস্টেল থেকে বের হয়ে উস্তাদের খাজে দেওয়ান রোড বা উর্দু গির্দারোড এর ছোট বাসায়, পরবর্তীতে আলিয়ার দক্ষিণপূর্ব ব্লকের রুমে গিয়ে তাকরীর শুনে রাত বারোটায় আবার হোস্টেলে ফিরে আসা। যাহোক আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে পরামর্শক্রমে উস্তাদের চাহিদা মোতাবেক বই এবং আমার নিজের তরফ থেকে আরও কিছু অতিরিক্ত বই পাঠালাম। ফোনে উস্তাদের সাথে যখন কথা হলো উস্তাদ অত্যন্ত আনন্দিত ছিলেন এবং আমিও ছিলাম উতফুল্লু, আমাকে বললেন চট্টগ্রাম এলে আমার এখানে অবশ্যই বেড়িয়ে যাবে। আমিও কথা দিলাম ইনশা আল্লাহ আসবো। কিন্তু আফসোস! আমি কথা রাখতে পারেনি। কর্তৃপক্ষ আমাকে ভাইবা নিতে পাঠালো দারুল উলুম চট্টগ্রামে, ভাইবা শেষে ঢাকায় জরুরী কাজ থাকায় পরদিন ভোরেই ফিরতে হলো, যাওয়া হলো না উস্তাদের সান্নিধ্যে। ভাবলাম আবার একদিন আসবো, কিন্তু সেদিন আসার আগেই আমার উস্তাদ চলে গেলেন আল্লাহর সান্নিধ্যে। ২০১১ সালের ২৬ মে যখন আমার উস্তাদের ছেলে ফোনে জানালো এখবর তখন আসলে আমি নিথর হয়ে গেলাম, ইন্নালিল্লাহ পড়ে বোকার মতো প্রশ্ন করলাম আমার নাম্বারটা কিভাবে পেলেন? ছেলে জানালো আব্বুর মোবাইলে আপনার নাম্বারটা সেভ্ করা আছে এবং কল লিষ্ট ধরেই সবাইকে জানাচ্ছি।

আজ যখন উস্তাদকে নিয়ে স্মৃতির পাতা উল্টাচ্ছিলাম পেয়ে গেলাম উস্তাদের সেই আজিজম প্রফেসরের প্রতি লেখা চিঠি এবং প্রিন্টেড সনদের চটি বই যা পড়ে আমার দু’চোখ বেয়ে শুধু অশ্রুই ঝরছে। নিজেকে বড়ই অপরাধী মনে হয়, কেন জীবিত কিংবদন্তির পা ছুয়ে সালাম দিতে পারলাম না, আল্লাহ আমায় ক্ষমা করো, আমার প্রাণ প্রিয় উস্তাদের ভুল ত্রুটিগুলো মার্জনা করো, জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান বানিয়ে নাও এবং জান্নাতে যেন উস্তাদের সাক্ষাত লাভে ধন্য হই এ আকুতি করি তোমার দরবারে, ওরাসাতুল আন্বিয়ার দায়িত্ব পালনের ভার বহনের শক্তি দাও হে প্রভু! কবুল করো মোর এ মুনাজাত।
লেখক : সাবেক সভাপতি, আল-হাদীস এন্ড ইসলামিক ষ্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন