ইসলামী পরিভাষায় পবিত্রতাকে ‘তাহারাত’ এবং পরিশুদ্ধতাকে ‘তাযকিয়াহ’ বলে। পবিত্রতা অর্জন করতে হয় আঙ্গিক বা সর্বদৈহিক প্রয়োজনে, পক্ষান্তরে তাযকিয়াহ এর সাধনা করতে হয় আত্মার সংশোধন তথা আত্মাকে কলুষমুক্ত করণের প্রয়োজনে। ইসলামী শরীয়াত তথা কুরআন সুন্নাহ মতে পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতার গুরুত্ব অত্যধিক। পবিত্রতার বিষয়ে আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাওবাকারীকে ভালোবাসেন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালোবাসেন। (সুরা বাক্বারা : আয়াত ২২২)। এ আয়াত স্পষ্টভাবে পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধার বিষয়ে নাযিল হয়েছে। বিশ্বাসের পবিত্রতা মুক্তি দান করে, কর্মের পবিত্রতা সমৃদ্ধি ঘটায়, শারীরিক পবিত্রতা সুস্থতা আনে, মানসিক পবিত্রতা সাধুতা আনে, আর্থিক পবিত্রতা পরিতৃপ্তি দান করে, বাহ্যিক পবিত্রতা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা জীবনকে পরিশীলিত করে; ভাষার পবিত্রতা ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায়, রুচির পবিত্রতা শ্রেষ্ঠত্ব দান করে, দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গির পবিত্রতা জীবনকে সুন্দর করে; পরিবেশ ও প্রতিবেশের পবিত্রতা মহানুভব করে। এছাড়াও পবিত্রতা প্রেম সৃষ্টি করে; পবিত্র চিন্ত সুখী করে, পবিত্র দৃষ্টি অন্তর জয় করে, পবিত্র বাক্য হৃদয়ে প্রশান্তি আনয়ন করে, পবিত্র আবেদন আপন করে, পবিত্র আহবান অনুগত করে, পবিত্র স্পর্শ পূর্ণতা প্রদান করে, পবিত্র অনুরাগ বন্ধনে আবদ্ধ করে, পবিত্র বন্ধন সমাজকে উন্নত করে, পবিত্র বিধান জাতিকে ঋদ্ধ-সমৃদ্ধ করে; পবিত্র জীবন আত্মবিশ্বাস ও সৎ সাহস তৈরি করে।
পবিত্র হাদিস শরিফে প্রখ্যাত সাহাবী আবু মালিক আশআরী (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লহ (সা.) বলেন, ‘আত তহুরু শাতরুল ইমান।’ অর্থাৎ, পবিত্রতা ইমানের অঙ্গ। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘আত তহুরু নিসফুল ইমান।’ অর্থাৎ, পবিত্রতা ইমানের অর্ধেক। (মুসলিম শরিফ, মিশকাত শরিফ, পৃষ্ঠা: ৩৮, আলফিয়াতুল হাদিস)।ইসলামে পবিত্রতার গুরুত্ব প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইসলাম পরিচ্ছন্ন। সুতরাং তোমরা পরিচ্ছন্নতা অর্জন করো। নিশ্চয়ই জান্নাতে কেবল পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিই প্রবেশ করবে।’ (ফাইজুল কাদির, হাদিস : ৩০৬৫)। অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর দ্বিনের ভিত্তি স্থাপিত।’ (মাউসুআতু আতরাফিল হাদিস আন-নাবাবি, পৃষ্ঠা. ২৯৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পবিত্রতা নামাজের চাবি।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৭৬)।
উপমহাদেশের বিখ্যাত হাদীস বিশারদ শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) বিষয়টিকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়া নেক কাজের অন্যতম ভিত্তি, যা রুচিশীল ব্যক্তির রুচির দাবি। বিশেষত, যার মধ্যে মালাকুতি (ফেরেশতাসুলভ) নূর প্রসার লাভ করেছে। সে অপবিত্রতা অপছন্দ করে এবং পবিত্রতা পছন্দ করে। তাতে আনন্দ ও প্রশান্তি বোধ করে।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, পৃষ্ঠা. ১৭৩)। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী (রহ.) পবিত্রতাকে চারস্তর বলে উল্লেখ করেছেন (১) শরীরের অঙ্গ সমূহ পবিত্র রাখা। (২) শরীরের অঙ্গসমূহ পাপাচার থেকে মুক্ত রাখা (৩) অন্তরকে অসৎ চিন্তা হতে মুক্ত রাখা। (৪) মন-মস্তিষ্ককে আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছু থেকে মুক্ত ও পবিত্র রাখা। এই চার প্রকার পবিত্রতা অর্জন করতে পারলে মানুষ ইনসানে কামিলে পরিণত হয়। (আল-মুরশিদুল আমিন, ইমাম গাজ্জালী (রহ.) পৃষ্ঠা ৩৬-৩৭)।
মানুষের আত্মাই দেহের নিয়ন্ত্রক। অন্তর যদি নিজে কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে, তবে সারা শরীরের কার্যকলাপও সঠিক থাকবে। পক্ষান্তরে অন্তর যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তবে শরীরের সব ব্যবস্থাপনাও বিনষ্ট হবে। তাই সবার আগে আত্মাকে ঠিক করা দরকার। আর আত্মার এ পরিশুদ্ধতাই হলো ‘তাযকিয়াহ’। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই সেই সফলকাম হয়েছে যে নিজের নফস বা আত্মাকে কলুষতা থেকে মুক্ত করেছে। আর সে অকৃতকার্য হয়েছে যে নফসকে কলুষিত করেছে।’ (সূরা আশ-শামস: আয়াত: ৯-১০)। আল্লাহপাক আরো বলেন, ‘আজ সম্পদ ও সন্তান কোনো উপকার করতে পারবে না, কেবল যে পরিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে।’ (সুরা শুআরা: আয়াত : ৮৮-৮৯)।
আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার শক্তিই ‘নফস আম্মারাহ’ বা কুপ্রবৃত্তিকে দমন করতে পারে, মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে পারে এবং এর মাধ্যমেই রূহানি চেতনা বিকশিত হয়। মানুষের অধ্যাত্ম চেতনা ও আত্মশুদ্ধি এমনই এক প্রবল প্রখর শক্তি। যুগশ্রেষ্ঠ বিখ্যাত দার্শনিক হজরত ইমাম গাজ্জালি (র.) বলেন, ‘মানুষের আত্মা স্বচ্ছ অসির মতো উজ্জ্বল। আর মন্দ স্বভাব ধূম্র ও অন্ধকারের মতো মলিন। তা ক্রমশ আত্মার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আত্মাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয় এবং একটি কালো আবরণ সৃষ্টি করে। যার ফলে সে আল্লাহর দর্শন থেকে বঞ্চিত হয়। পক্ষান্তরে মানুষের মহৎ গুণ ও সৎ স্বভাব উজ্জ্বল আলোকতুল্য। যা আত্মার অভ্যন্তরে প্রবেশপূর্বক সকল মলিনতা ও পাপ বিদূরিত করে আত্মার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।’ (কিমিয়ায়ে সা’আদত)।
পরিশুদ্ধতার উপায় সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, আবু আবদুল্লাহ নোমান বিন বশির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘নিশ্চয় হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। এ দুইয়ের মধ্যে রয়েছে সন্দেহজনক বিষয়, বেশির ভাগ মানুষ সেগুলো জানে না। অতঃপর যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় থেকে বেঁচে থাকে, সে নিজের দ্বিন ও সম্মানকে ত্রুটিমুক্ত রাখে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহজনক কাজে লিপ্ত হলো সে হারামে লিপ্ত হলো। যেমন কোনো রাখাল, তার (গবাদি) পশু সংরক্ষিত এলাকার আশপাশে চরায়। আর তখন আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, যেকোনো সময় কোনো পশু তার মধ্যে ঢুকে পড়বে। সাবধান! প্রত্যেক বাদশাহরই সংরক্ষিত এলাকা থাকে। আর আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা হচ্ছে তাঁর ‘নিষিদ্ধ বিষয়গুলো’। সাবধান! নিশ্চয়ই মানবদেহে একখন্ড গোশতের টুকরো আছে, যখন তা সুস্থ হয়ে যায় গোটা শরীরটাই সুস্থ হয়ে যায় এবং যখন তা অসুস্থ হয়ে যায় গোটা শরীরই অসুস্থ হয়ে যায়। জেনে রেখো! এটাই হচ্ছে কলব।’ (সহিহ মুসলিম: হাদিস : ৪১৭৮)
কলব তথা অন্তরের পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধির জন্য এবং আল্লাহর বিধান পালনে তার দৃঢ়তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা আবশ্যক। রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া করতেন, ‘হে অন্তর পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার আনুগত্যে দৃঢ় করে দেন।’ (মুসনাদে আহমদ: হাদিস : ৯৪২০)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষের অন্তর আল্লাহর দুই আঙুলের মধ্যে অবস্থিত, তিনি তা যেমন ইচ্ছা পরিবর্তন করেন।’ (সহিহ মুসলিম: হাদিস : ৬৯২১)। রাসুলুল্লহ (সা.) আত্মশুদ্ধির জন্য নিয়মিত দোয়া করতেন। তাই আলেমরা আত্মশুদ্ধির জন্য দোয়া করা ‘মুস্তাাহাব’ বলে মত দিয়েছেন। মহানবী (সা.) দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে সুস্থ অন্তর (কলব) কামনা করছি।’ (মুসনাদে আহমদ: হাদিস : ১৭১১৪)।
’মহান আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর নৈকট্য হাসিলের লক্ষ্যে ‘ দৈহিক পবিত্রতা ও আত্মিক পরিশুদ্ধতা, লাভের তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখকঃ প্রভাষক (আরবী), নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন