বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

যাকাত দেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ২৭ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০২ এএম

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় নি¤œ আয়ের মানুষ এবং দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষগুলো এখন খুবই কষ্টে আছে। দু’বেলা ডাল ভাত যোগাড় করতে তারা এখন হিমশিম খাচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষদের জীবনে এখন কেবল হাহাকার। এ অবস্থায় সামর্থ্যবান প্রত্যেক মানুষের উচিত, বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কারণ, সবার আগে জীবন বাঁচাতে হবে। এই পরিস্থিতিতে যাকাত হতে পারে ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার যোগানোর উৎকৃষ্ট হাতিয়ার। একই সাথে এই সময়টা হতে পারে আপনার যাকাত প্রদানের উৎকৃষ্ট সময়। সুতরাং, আসুন আমাদের মধ্যে যাদের ওপর যাকাত ফরয হয়েছে, তারা সবাই যাকাতের অর্থটা এই সময়ে মানুষের কল্যাণে ব্যয় করি। তাতে যাকাতও আদায় হবে আবার মানবতারও কল্যাণ হবে। আর এটাই ইসলামের শিক্ষা।

ইসলামে নামাজ রোজার মতই যাকাত একটি ফরজ ইবাদত। যাকাত হচ্ছে অর্থের ইবাদত। আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষদের ওপর যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক। আর আর্থিক সচ্ছলতার মাপকাটি ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। যাকাতের পরিমাণ নির্ণয়ের ফর্মুলাও ইসলাম বলে দিয়েছে। আর যাকাতের অর্থ কোন কোন খাতে ব্যয় করতে হবে, সেটাও ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইসলামী পরিভাষায় যাকাত হচ্ছে সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ কোনো অসহায়কে মুসলমানকে দুনিয়াবী স্বার্থ ছাড়া প্রদান করা। যাকাত হচ্ছে অসহায়, অভাবী, অক্ষম এবং সুবিধা বঞ্চিত মুসলিম জনগোষ্ঠির সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মূল হাতিয়ার। যাকাত হচ্ছে একটি মানবিক সমাজ গঠনের হাতিয়ার এবং মানবকল্যাণই যাকাতের মূলমন্ত্র। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে একজন মানুষের সম্পদ পবিত্রতা অর্জন করে, আর সেই যাকাতের অর্থ দিয়ে বঞ্চিত মানুষের সমস্যা সমাধান হয়। যাকাত হচ্ছে ধনীদের সম্পদে গরিবের অধিকার, যা আদায় করতে ধনীরা বাধ্য। মহান আল্লাহতায়ালা কোরান শরীফে সালাত আদায়ের সাথে সাথে যাকাত আদায়েরও নির্দেশ দিয়েছেন। কোরান শরীফে তিনি মোট ৩২ বার যাকাত আদায়ের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ এককভাবে ৭ বার আর সালাতের সাথে ২৫ বার, যাকাত আদায়ের কথা বলেছেন।

ঈমান আনার পর ইসলামের বিধাসমূহকে পূর্ণাঙ্গভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং পালন করতে হবে। আপনি কিছু বিধান পালন করলেন আর কিছু বিধান পালন করলেন না- এমন সুযোগ ইসলামে নেই। স্বাভাবিকভাবেই নামাজ আদায়ের মতো যাকাতও আদায় করতে হবে। পবিত্র কোরানে বর্ণিত যাকাত আদায় সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে এখানে কয়েকটি আয়াত তুলে ধরছি। ‘তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রান কর এবং রকুকারীদের সাথে রুকু কর’ (বাকারা-৪৩)। ‘তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ’ (মুজাম্মিল -২০)। ‘তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করো’ (মুজাদালাহ-১৩)। যারা যাকাত দেয় না তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যারা যাকাত দেয় না, তারাই আখিরাতের অস্বীকারকারী কাফির’ (হা-মীম সাজদা-৭)। কোরান শরীফে আল্লাহতায়ালা কর্তৃক বর্ণিত এই কয়েকটি আয়াত থেকে আমরা সহজেই যাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। মনে রাখতে হবে, যাকাত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি বিধান। আর এটা হচ্ছে ধনীদের সম্পদে বঞ্চিতদের অধিকার। এটা বঞ্চিতদের প্রতি ধনীদের কোনো করুনা বা অনুগ্রহ নয়। আবার এটা দানও নয়। এটা হচ্ছে ধনীদের সম্পদে গরীবদের এমনই এক অধিকার, যা প্রতি বছর ধনী ব্যক্তিরা গরীবদের প্রদান করতে বাধ্য এবং সেটা গরীবদের ঘরে পৌঁছে দেয়াটা ধনীদের দায়িত্ব। এভাবে যাকাত প্রদানকে আল্লাহতায়ালা ফরজ করে দিয়েছেন, যাতে একদিকে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা তাদের ধর্মীয় বিধান পালন করবে, অপরদিকে যাকাতের অর্থ দিয়ে অটোমেটিক্যালি সমাজ থেকে দারিদ্র্য এবং সমস্যা দূর হবে। এভাবে যাকাত সিস্টেমের মাধ্যমে ইসলাম সার্বজনিন এবং কল্যাণমুখী অর্থনীতি চালু করেছে, যার মাধ্যমেই কেবল একটি আলোকিত এবং মানবিক সমাজ গড়া সম্ভব।

অনেকে মনে করেন, যাকাতের টাকা প্রদান করলে সম্পদ কমে যাবে। কিন্তু প্রকৃত চিত্রটা ঠিক উল্টো। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহপাক বলেন, যাকাত দিলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘তোমরা যে সুদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদে বৃদ্ধি পাবার জন্য তা মূলত আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে তাই বৃদ্ধি পায় এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত হয়’ (রূম-৩৯)। একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন একজন মানুষ সুদ খায় সম্পদ বাড়ানোর জন্য। কিন্তু যে ব্যক্তি সুদ খায় তার সম্পদ বাড়ে না। কারণ সুদি সিস্টেমে গরীবের টাকা ধনীদের হাতে চলে আসে। ফলে যারা সুদ প্রদান করে তাদের হাতে টাকা থাকে না, এতে তাদের ক্রয় ক্ষমতা থাকে না। এ অবস্থায় অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে, সমাজে দারিদ্র্য সৃষ্টি হয় এবং সমাজে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ে। অপরদিকে যাকাত আদায়ের ফলে ধনীদের সম্পদ দরিদ্রদের হাতে যায়। ফলে গরীবদের হাতে টাকা থাকে এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। ফলে অর্থনীতির চাকা সচল হয়, সমাজে দরিদ্রের সংখ্যা কমে এবং সমাজে ধনী গরীবের বৈষম্যও কমে, সমাজে সাম্য সৃষ্টি হয়। এভাবে যাকাত ব্যবস্থার কল্যাণে সমাজ উন্নত হয়। অপরদিকে সুদ গ্রহণের ফলে মানুষ আল্লাহর অসন্তুষ্টি অর্জন করে আর যাকাত প্রদানের ফলে মানুষ আল্লাহর সস্তুষ্টি অর্জন করে। এভাবে সুদের কারণে মানুষ ইহকাল এবং পরকাল উভয় অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে যাকাত প্রদানের ফলে মানুষ ইহকাল এবং পরকাল উভয় ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করে। যাকাতের অর্থ প্রদানের পর সেই অর্থ আবার যেন তেন খাতে ব্যয় করা যাবে না। কারণ, যাকাত প্রদনের আটটি খাত আল্লাহ নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই সদাকা হচ্ছে (যাকাত পাবে আট প্রকার লোক) ১. ফকীর, ২. মিসকিন, ৩. ঐসব লোক যারা সদাকা উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত ৪. ঐ সমস্ত কাফির, যাদের অন্তর আকৃষ্ট করা প্রয়োজন, ৫. দাস আযাদ করা ৬ ঋনগ্রস্তদের সাহায্য করা, ৭. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী এবং ৮. মুসাফিরদের প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুনির্ধারিত। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, তিনি প্রজ্ঞাময়’ (তওবাহ -৬০)। সুতরাং যাকাতের আদায়কৃত অর্থ সঠিক খাতেই ব্যয় করতে হবে।

যাদের ওপর ইসলাম নির্ধারিত যাকাত আদায় ফরজ হয়েছে, তারা সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্ধারিত যাকাত প্রদান করুন। এর মাধ্যমে আপনি আল্লাহর বিধান পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করলেন আবার সমাজ থেকে দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ভূমিকা রাখলেন। তাই অনুগ্রহ করে যাকাত প্রদানে কার্পণ্য করবেন না। প্রয়োজন হলে, আপনি যাকাতের অর্থ দিয়ে একটি যাকাত ফান্ড গঠন করুন। সেই ফান্ড থেকে যাকাতের টাকা সমাজের অসহায় এবং বঞ্চিত মানুষের সমস্যা সমাধানের কাজে ব্যয় করুন। ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানব কল্যাণই ইসলামের মূলমন্ত্র। তাই ইসলাম তার যাবতীয় কর্মই মানব কল্যাণের সাথে সংযুক্ত করেছে। মানব কল্যাণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ইসলামের মূল লক্ষ্য। যাকাত তার জ¦লন্ত উদাহরণ। আল্লাহতায়ালা যাকাতকে অবশ্যই পালনীয় ধর্মীয় বিষয় হিসাবে মুসলমানদের ওপর ফরজ করেছেন। অপরদিকে এর মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের স্থায়ী সিস্টেম চালু করেছেন। এর মাধ্যমে গরীবের প্রতি ধনীদের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করেছেন। ফলে সমাজে সাম্য, সম্প্রীতি এবং মানবতা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং আসুন, আমরা সবাই যাকাত প্রদান করি। যাদের ওপর যাকাত ফরজ হয়নি তারাও যে কোনো পরিমাণ অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করুন। মুসলমানদের পাশাপাশি অমুসলিমরাও কিন্তু যাকাতের সিস্টেমে গরীবদের জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারে। এমনকি যে কোনো ব্যক্তি তার সামর্থ্য অনুযায়ী মানব কল্যাণে অর্থ ব্যয় করতে পারে, যা দান এবং সদকা হিসাবে গণ্য হবে। কারণ এই অর্থ তো মানব কল্যাণেই ব্যয় হবে। আসুন, এর মাধ্যমে সমাজ থেকে ক্ষুুধা, দারিদ্র্য এবং অভাবকে দূর করি আর মানবিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করি। আর বর্তমান সময়টা হচ্ছে তার উপযুক্ত সময়।
লেখক: প্রকৌশলী, আহবায়ক, যাকাত ফর হিউমিনিটি।
omar_ctg123@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
শওকত আকবর ২৭ এপ্রিল, ২০২১, ৮:১৯ এএম says : 0
সম্পদের হিসাব করে জাকাত প্রদান করুন।যারা পায়নেওয়ালা তাদের মধ্যে বিতারন করুন।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন