শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

আমাদের যাকাত বিতরণ ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন জরুরি

প্রকাশের সময় : ২৯ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আলী এরশাদ হোসেন আজাদ
ইসলামের পঞ্চভিত্তির অন্যতম যাকাত, একটি ‘সামাজিক বীমা’ এবং শোষণ-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুদবিহীন সমাজ বিনির্মাণের বাহন। ২.৫% যাকাত দানে ৫% হারে দারিদ্র্য হ্রাস সম্ভব। পবিত্র কুরআনে যাকাতকে ‘বঞ্চিত ও মুখাপেক্ষীর অধিকার’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করায় প্রিয়নবী (স.) মু’য়াজকে (রা.) দেওয়া নির্দেশে বলেন, “এটা হচ্ছে ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করে দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা”। যাকাত নির্ধারণী একককে ‘নিসাব’ বলে। স্বর্ণ, রৌপ্য ও নগদ অর্থকে একক নির্ধারণ করে যাকাত ধার্য করা হয়। তা থেকে ২.৫% বা প্রতি এক লক্ষ টাকায় ২৫০০ টাকা যাকাত আদায় করা ফরজ।
একজন মানুষের সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার জন্য কয়েকটি মৌলিক অধিকার দরকার। যথা: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি। ইসলাম বিশ্বের সব মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে স্বীকৃত, এজন্যই মানবতার ধর্মে সুষ্ঠু যাকাতব্যবস্থা এক বিশেষ উদ্দীপক। পবিত্র রমজানের অনুসঙ্গ ‘যাকাত’ একটি আর্থিক ইবাদত। কাজেই মুসলমানকে তার যাবতীয় আয়-ব্যয়-সম্পদের নিখুঁত হিসেব সংরক্ষণ করতে হয়। হিসেব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাৎসরিক ভিত্তি একটি মৌলিক বিষয়। অর্থাৎ বছরের একটি নির্দিষ্ট তারিখ থেকে পরবর্তী বছরের একটি নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত সময়কালের সব আয়-দায়-সঞ্চয়, সম্পদের যথাযথ হিসেব রাখতে হবে। তবে দিন-তারিখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবু ঐতিহ্যগতভাবে অনেকেই বেশি সওয়াবের আশায় ‘রমজান থেকে রমজান’ হিসেবে বছর ধরে দিন গণনা করে যাকাত আদায় করে থাকেন। সংরক্ষিত হিসেবে, প্রাক্কলিত সম্পদ ‘নিসাব’ পরিমাণে পৌঁছলে এবং তা ব্যক্তির মালিকানায় এক বছর জমা থাকলেই সম্পদের মালিককে যাকাত আদায় করতে হবে এবং তা ফরজ।
যাকাত ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের অনগ্রসর মানুষের সামর্থ্যকে ‘ঃধশব ড়ভভ ষবাবষ’ এ পৌঁছে দেওয়া, যাতে তার ন্যূনতম মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ হয়। ইসলামের সোনালি যুগে এমন সমাজের উত্তোরণ ঘটে যে, সেখানে যাকাত গ্রহণের মতো দরিদ্র মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ বর্তমানে ‘সস্তা শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণে’র প্রচলিত মহড়ায় ‘দারিদ্র্যকে মহান’ করে অনুগত ও মুখাপেক্ষী জনগোষ্ঠী প্রতিপালনের দুঃখজনক উৎসবের উপহাস করা হচ্ছে। এতে গরিব স্বাবলম্বী না হয়ে বরং ধনীর গগনচুম্বি আকাক্সক্ষা, ভুখা মিছিলের দৈর্ঘ্য অবলোকনে বিদ্রƒপ প্রকাশ করছে মাত্র। অন্যদিকে আত্মপ্রচার, রাজনৈতিক পরিচিতি, ভোটবাণিজ্য ইত্যাদি প্রয়োজনে যাকাতের ধর্মীয় আবেদন হারিয়ে তা হয়ে যায় লোকাচারের লৌকিক আকাক্সক্ষা সর্বস্ব ‘লোক দেখানো’র জাগতিকতা মাত্র। ফলে যিনি যাকাত দেন তিনি শুধু আত্মতুষ্টিতে মুখাপেক্ষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজের ‘চেহারার ঔজ্জ্বল্য’ ছাড়া অন্য কিছুই খুঁজে পান না। যারা ‘সস্তা শাড়ি-লুঙ্গি’র জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন তাদেরও যে শাড়ি-লুঙ্গি কেনবার সামর্থ্য নেই এমন নয় বরং কেউ কেউ আবার সংগৃহীত ঐ শাড়ি-লুঙ্গি আরো সস্তায় বিক্রি করে দেন। এমন দান খয়রাতে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ অর্জন হয় সুদূরপরাহত এবং অভাবী মানুষ পায় না বাঁচার মতো নতুন স্বপ্নের ঠিকানা।
যাকাত বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ইচ্ছা ও স্বাধীনতা রয়েছে সত্য। তবে ব্যক্তিকে যাকাত দানের কল্যাণকর দিকগুলো বিবেচনায় আনতে হবে, যাতে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ অর্জিত হয়। অন্যদিকে ‘সস্তা শাড়ি-লুঙ্গি’র জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে কারো যেন মৃত্যু না হয় তা বিবেচনায় রাখা জরুরি। এজন্য বিভ্রান্তিকর যাকাত বণ্টনব্যবস্থায় আধুনিকায়নের জন্য প্রয়োজনÑ
রাষ্ট্রপতি মহোদয়কে প্রধান করে ‘যাকাত বোর্ড’ গঠন এবং ‘যাকাত বোর্ড’ কর্তৃক যাকাত সংগ্রহ তৎপরতা বৃদ্ধি করা। ব্যাংকে যাকাতের অর্থ জমা প্রদানে জনগণকে উৎসাহিত করা।
এলাকাভিত্তিক ও মসজিদকেন্দ্রিক ‘যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণ কমিটি’ গঠন। মসজিদের ইমাম, বয়োজ্যেষ্ঠ-স্থায়ীমুসল্লি, হাজিসাহেবান, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, সমাজস্বীকৃত শ্রদ্ধাভাজন অভিজাতবর্গ হবেন যাকাত কমিটির সদস্য।
দেশে বিদ্যমান দ্বীনি প্রতিষ্ঠান, এতিমখানার ‘লিল্লাহ্ বোর্ডিং’ বা ‘গোরাবা তহবিলে’ যাকাতের অর্থ প্রদান উৎসাহিত করা এবং ঐসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও আধুুনিকায়ন নিশ্চিত করা।
ব্যক্তিগত, সামাজিক, সাংগঠনিক উপায়ে প্রকৃত অভাবী মানুষ শনাক্তকরণ ও দুস্থদের তালিকা প্রস্তুতকরণ।
বিপুল পরিমাণ যাকাত বণ্টনে ‘যাকাত বোর্ড’ বা রাষ্ট্রীয় তদারকি।
যাকাত বিতরণের লক্ষ্য স্থির করা, এতে দারিদ্র্য বিমোচনে কতদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব তা বিবেচনায় রাখা।
কী কী জিনিস দিয়ে যাকাত দেওয়া হবে বা কাকে কাকে দেওয়া হবে তা স্থির করা।
ব্যক্তির প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সম্পদের যাকাত নির্ধারণ।
অধিক পরিমাণ যাকাত বিতরণের ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেওয়া।
মনে রাখতে হবে, নিরাপদে ও সযতেœ গ্রহীতার কাছে যাকাত পৌঁছানো ব্যক্তির একান্ত কর্তব্য।
যাকাত দানের মাধ্যমে আত্ম কর্মসংস্থান, স্বাবলম্বীকরণ, অর্থের গতিশীলতা নিশ্চিতকরণ, শ্রেণি সংগ্রাম ও বৈষম্যহ্রাস ইত্যাদি লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে অগ্রসর হতে হবে।
বুঝতে হবে দান করা পুণ্যের কাজে হলেও ভিক্ষা করা বা অন্যের দান খয়রাত গ্রহণ করা ‘নিন্দনীয় বৈধ কাজ’। অভাবী মানুষের মধ্যে পরমুখাপেক্ষীতার স্থলে আল্লাহমুখিতা ও আত্মনির্ভরশীল চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে, যেন কোথাও কিছু দেওয়া হচ্ছে শুনলেই ওরা তা পাবার জন্য যাতে ঝাঁপিয়ে না পড়ে।
‘জাতীয় যাকাত দিবস’ বা ‘যাকাত সপ্তাহ’ পালন। প্রয়োজনে সারা বছর বণ্টনব্যবস্থা অব্যাহত রাখা।
মনে রাখা ভালো, হারাম সম্পদ-বস্তুর যাকাত নেই এবং এগুলোর যাকাত দিলেই তা হালাল হয়ে যায় না। কেননা, ইসলাম ‘কালো টাকা সাদা করবার’ দর্শন সমর্থন করে না। অন্যদিকে রাষ্ট্র ব্যক্তির প্রকাশ্য ও প্রদর্শিত আয়ের যাকাত আদায় করে। অনিরূপিত, অপ্রকাশ্য সম্পদকে ইসলামে ‘আমওয়ালে বাতিনা’ বলে, এমন সম্পদের যাকাত পরিশোধ ঈমানদারের ব্যক্তিগত দায়িত্ব। রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতির ক্ষেত্রেও ব্যক্তিকে স্বউদ্যোগে যাকাত আদায় করে দায়মুক্ত হতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত ‘স্বনির্ধারণী’ পদ্ধতিতে যাকাত আদায় করে দায়মুক্ত হয়ে থাকেন। মজার ব্যাপার হলো অনেকেই যারা ‘কর ফাঁকি’র নানান ফিকিরে অভ্যস্থ তারাই আবার যাকাত দানে আন্তরিক। এমন কি কিছু কিছু গবেষকের বিশ্লেষণ হলো, দেশে আয়কর দাতা ও আয়করের পরিমানের চেয়ে যাকাতদাতা ও যাকাতের অর্থের পরিমাণ বেশি। কিন্তু যাকাতের অর্থ দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ অর্জনে ব্যবহৃত হয় না বললেই চলে। বরং ‘সস্তা শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণে’র প্রচলিত মহড়ায় অনুগত ও মুখাপেক্ষী জনগোষ্ঠী বছরের পর বছর ফিরে ফিরে আসে এবং তাদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। যেন এটাই নিয়ম ও ঐতিহ্য কিন্তু যাকাতের উদ্দেশ্য কী তাই? অন্যদিকে ভোটের সময় প্রার্থী যেভাবে ভোটারের বাড়ি বাড়ি বারবার যান সেভাবেই যদি যাকাতদাতা যদি যাকাত গ্রহীতার কাছে যেতেন হয় তবে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতো না।
বস্তুত জীবন ধারণের জন্য জীবিকার্জন একটি ফরজ কর্তব্য এবং এর পদ্ধতি হতে হবে ‘হালালান তাইয়্যেবা’ বা ‘বৈধ ও পবিত্র’। অথচ মানুষের কষ্টার্জিত জীবিকাও অবৈধ হয়ে যায় যদি তা থেকে যাকাত পরিশোধ করা না হয়। তবু বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, অবাধ ও অপরিমেয় প্রাচুর্যের মোহ মানুষের সহজাতÑ “পরিতাপ প্রত্যেক পশ্চাতে নিন্দুকের জন্য, যে সম্পদ জমা করে, গণনা করে এবং ধারণা করে এটাই তাকে অমর করবে” (সুরা হুমাযাহ্: ০১-০৩)। তাই যাকাতব্যবস্থা মানুষের ভোগাকাক্সক্ষায় মহান আল্লাহ্র বিধানের তাৎপর্য স্মরণ করিয়ে দেয়। কেননা, প্রাচুর্যের মোহ যতই মানুষকে অস্থির রাখুক না কেন সব সম্পদের প্রকৃত মালিক তো মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিন আর মানুষের মালিকানা হলো সাময়িক ও সীমিত। আলকুরআনের ভাষায় “আল্লাহ্ই সব জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং অতঃপর এর ব্যবহার ও প্রয়োগের জন্য বিধি-বিধানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন” (ত্বা-হা: ৫০)।
অন্যদিকে সম্পদের সুষমবণ্টন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সবার কাম্য চাহিদা পূরণ করা ইসলামের শ্বাশত নীতি। একের ভোগাকাঙ্কায় অন্যের ভোগান্তি ইসলাম সমর্থন করে না। তাই প্রিয়নবী (স.) বলেন “যার ঘর নেই এ দুনিয়ায় সে ঘর পাবে, যার সম্পদ নেই সে সম্পদ পাবে কিন্তু যার বিবেক নেই সে সম্পদ জমা করবে” (আহমদ)। তিনি (স.) আরো বলেন “থাকার জন্য একটি ঘর, লজ্জা নিবারণের জন্য একখ- বস্ত্র, ক্ষুধা নিবারণের জন্য কয়েকটি রুটি, পানি পানের জন্য একটি পাত্রÑ এর অতিরিক্ত কোন সম্পদের অধিকারী হবার হক আদম সন্তানের নেই” (তিরমিযি)।
ষ লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন