লকডাউনে বিশাল কওমি মাদরাসার গেইটে ঝুলছে তালা। বাইরে থেকে বুঝাই যাচ্ছে না যে এ মাদরাসায় প্রায় তিন হাজার ছাত্র পড়া-লেখা করেন। কয়েকবার গেইটের কড়া নাড়ালে একজন খাদেম ছুটে এসে বলেন, কাকে চাই? দেখেন না লকডাউন চলছে। ভেতরে যাওয়া যাবে না। অনুমতি নিয়ে ভেতরে নজর দিতেই দেখা যাচ্ছে খাঁ খাঁ করছে মাদরাসার চত্বর। জনমানব শূন্য একটি দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বৃহৎ এ ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র এখন নিস্তরঙ্গ। অফিস রুমে শুধু দু’তিন জন হুজুর পেপার পড়ে সময় কাটাচ্ছেন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টায় ঢাকার অদূরে চিটাগাং রোডস্থ ঐতিহ্যবাহী আলজামি’আতুল ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানীনগর মাদরাসায় সরেজমিনে পরিদর্শনে গেলে এসব দৃশ্য নজরে আসে।
মাদরাসার মুহতামিম আল্লামা মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ স›দ্বীপী ইনকিলাবকে বলেন, লকডাউনে মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করায় সকল ছাত্রদের ছুটি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মুক্ত সুন্দর দ্বীনি পরিবেশে তিন যুগ ধরে মাদরাসাটি ইসলামী শিক্ষা ও দ্বীক্ষার ক্ষেত্রে দেশ ও জাতির জন্য অসামান্য অবদান রাখছে। মাদরাসার এতিমখানায় ৮ শতাধিক হতদরিদ্র এতিম ছাত্রকে গোরাবা ফান্ড থেকে ফ্রি খানা দেয়া হয়। মাহে রমজানে যাকাত ছদকা ও এককালীন অনুদানের মাধ্যমে এতিমখানার ছাত্রদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। লকডাউনের কারণে মাদরাসার আয়ের উৎস প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। মহান আল্লাহপাকের বিশেষ মদদে এ দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চলমান সঙ্কটে ধার-দেনা ঋণ করে মাদরাসা টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। করোনা মহামারি সঙ্কটে ৮০জন শিক্ষকের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। শিক্ষকদের বেতন অর্ধেক কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।
করোনা মহামারিতে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি লন্ডভন্ড। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় গত ২৯ মার্চ থেকে কওমি মাদরাসাসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। চলমান বিধিনিষেধ আরো এক সপ্তাহ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই বিধিনিষেধ ৫ মে পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী এই বিধিনিষেধ ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত চলার কথা ছিল। এর আগে গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনা শনাক্তের পর ১৮ মার্চ থেকে করোনার মধ্যে অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শে কওমি মাদরাসায় পাঠদান চলছিল। করোনা প্রতিরোধে এবার কওমি মাদরাসাও বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কওমি মাদরাসার এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। অধিকাংশ মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষিকা ও স্টাফরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে অনাহার অনিদ্রায় দিন কাটাচ্ছেন। হতদরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরা এসব লিল্লাহ বোডিংয়ে ফ্রি খাওয়া-দাওয়া করে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করছে। লকডাউনে লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মাদরাসার গরিব ও এতিম শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছে। এতিমখানার অনেক অসহায় ছাত্রের কাছে গাড়ি ভাড়া না থাকায় তারা গ্রামের বাড়ি যেতে পারছে না। এতিমখানার অনেক ছাত্র রয়েছে ঠিকানাবিহীন। আটকেপড়া ও ঠিকানাবিহীন নূরানী ও হিফজখানার ছাত্রদের জন্য কতিপয় মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে সীমিত আকারে খানা চালু রাখতে হিমসিম খেতে হচ্ছে।
ঢাকার যাত্রাবাড়ী জামি’আ ইসলামিয়া আশরাফুল উলূম (ছনটেক) মহিলা মাদরাসা ও এতিমখানা ১০৪ জন এতিমসহ তিন শতাধিক হতদরিদ্র ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে দ্বীনি শিক্ষা চালিয়ে যেতে হিমসিম খাচ্ছে। মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মুহাম্মদ মাহমূদুল হাসান গতকাল জানান, ৪৩ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার বকেয়া বেতন ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা এখনো পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের দোকান বাকি ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮৬ টাকা। তিনি বলেন, মাহে রমজানে যাকাত, ছদকা ও অনুদানের আয় দিয়ে মাদরাসা কয়েক মাস চলতো নির্বিঘেœ। তিনি বলেন, মাদরাসা বন্ধ থাকায় এসব আয় থেকে গরিব অসহায় এতিম ছাত্র-ছাত্রীরা বঞ্চিত এবং দ্বীনিশিক্ষা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মাহমূদুল হাসান বলেন, করোনা মহামারি থেকে মুক্তির জন্য কওমি মাদরাসাগুলো এবং হিফজখান ও নূরানী বিভাগ খুলে দেয়া হলে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহপাকের রহমত লাভের আশা করা যায়। তিনি মাহে রমজানেই হিফজ ও নূরানীসহ সকল কওমি মাদরাসা খুলে দেয়ার অনুরোধ জানান। সাইনবোর্ডস্থ ডেমরা থানার ওলামানগরস্থ জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম শায়খুল হাদীস আল্লামা মুখলিছুর রহমান কাছেমী বলেন, করোনা মহামারিতে দীর্ঘ ১৪ মাস যাবত মাদরাসার নূরানী, হিফজখানা ও দাওরায়ে হাদীস বিভাগ বন্ধ রয়েছে। ঋণ করে মাদরাসা চালিয়ে রাখতে খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে অবিলম্বে কওমি মাদরাসা খুলে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।
মাহে রমজানে নিয়মিত ও অনিয়মিত দাতারা মাদরাসাগুলোর এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে যাকাতসহ দান ছদকার প্রচুর অর্থ দান খয়রাত করতেন। রমজানের দান ও কোরবানির চামড়ার আয় দিয়ে বছরের ছয় মাস এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হতো। কিন্ত লকডাউনে মাদরাসার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মাহে রমজানের আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং।
দেশের ঐতিহ্যবাহী ও পুরনো ঢাকার প্রাচীনতম জামিয়া হোসাইনিয়া আশরাফুল উলূম বড় কাটারা মাদরাসার মুহতামিম মুফতি সাইফুল ইসলাম মাদানী জানান, করোনা মহামারির দরুন কওমি মাদরাসাগুলোর এতিমখানাগুলো ঋণে জর্জরিত। মাহে রমজানে নিয়মিত ও অনিয়মিত দাতারা মাদরাসাগুলোর এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে যাকাতসহ দান ছদকার অর্থ প্রদান করতেন। তিনি বলেন, রমজানের দান ও কোরবানির চামড়ার আয় দিয়ে বছরের ছয় মাস এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হতো। আয়ের খাতগুলো বন্ধ থাকায় চুলা জ্বলছে না মাদরাসার এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে। তিনি বলেন, বড় কাটারা মাদরাসায় লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে ১৩শ’ ২০জন ছাত্র ফ্রি খানা খেয়ে দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করছেন। মাদরাসার স্টাফসহ ৬২ জন শিক্ষকের বেতন-ভাতা প্রতি মাসে দশ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া প্রতি মাসে অন্যান্য ব্যয় ৩৫ লাখ টাকা। মাদরাসা বন্ধ থাকায় অনিয়মিত দাতাদের অনুদান পাওয়া যাচ্ছে না। এতিম অসহায় দরিদ্র ছাত্রদের জন্য লিল্লাহ বোর্ডিং চালু রাখতে গিয়ে ঋণ করতে হচ্ছে। দ্বীনি শিক্ষা চালু এবং এতিমদের প্রতিপালনের স্বার্থে রমজানের মধ্যেই কওমি মাদরাসাগুলো খুলে দেয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
রাজধানীর রামপুরার জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম নতুনবাগ মাদরাসার প্রিন্সিপাল শায়খুল হাদিস মাওলানা ড.গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম বলেন, কওমি মাদরাসায় লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে শতকরা ৮০% ছাত্র আছে। তারা সাধারণত গরিব ও দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাদের সমস্ত ভরণপোষণ মাদরাসা বহন করে। মাদরাসা বন্ধ থাকার কারণে লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে। তাই ছাত্ররাও বিপাকে পড়েছে। যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে তারা একসময় অন্য পথে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি কোরআন-হাদিসের সংরক্ষণের জন্য এবং ছাত্রদের ভবিষ্যতের প্রতি লক্ষ্য করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাদরাসাগুলোকে খুলে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।
ঢাকার একটি কওমি মাদরাসার শিক্ষক মুফতি ইমরানুল বারী সিরাজী বলেন, গতবছর কঠোর বিধি নিষেধ চলাকালে যখনই হাফেজি মাদরাসা ও কওমি মাদরাসাগুলো খুলে দেয়া হয়েছিল কোরআন তিলাওয়াতের বরকতে তখন করোনার প্রাদুর্ভাব কমে গিয়েছিল। হিফজ বিভাগের শিক্ষার্থীর হাফেজ ওসমান গনি গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, মাদরাসা বন্ধ থাকার কারণে নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াত করা হচ্ছে না। তাই যা মুখস্ত করেছিলাম আস্তে আস্তে তা’ ভুলে যাচ্ছি। যদি এভাবে চলে থাকে তাহলে আমার জন্য হাফেজে কোরআন হওয়া অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে হিফজ বিভাগ খুলে দেয়া হলে আল্লাহপাকের রহমত বর্ষিত হবে বলেও সে উল্লেখ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন