শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

কওমি মাদরাসার অর্থসঙ্কট দূর করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

করোনাকালীন বাস্তবতায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নানামুখী সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকরা নিয়মিত সরকারি বেতন-ভাতা পেলেও স্কুল-কলেজ-মাদরাসা বন্ধ থাকায় প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর্থিক সংকটের কারণে কিন্ডারগার্টেনসহ ননএমপিও ও অনিবন্ধিত অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। তবে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে দেশের কওমি মাদরাসাগুলো। বিশ হাজারের বেশি কওমি মাদরাসা একদিকে যেমন ধর্মীয় নৈতিক ও মানবিক শিক্ষায় বিশাল ভ‚মিকা রাখছে, অন্যদিকে সরকারি সাহায্য ছাড়া শুধু সাধারণ মানুষের দান-দাক্ষিণ্যে পরিচালিত এসব মাদরাসা দেশের অতি দরিদ্র, পিতৃ-মাতৃহীন ও এতিম সন্তানদের শিক্ষা ও ভরণ-পোষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। করোনাকালে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকাসহ মাদরাসার সামগ্রিক কার্যক্রম স্থগিত থাকায় এসব মাদরাসার এতিমখানা ও লিল্লাহ্ বোর্ডিংয়ে থাকা এতিম ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া ও জীবনধারণে কঠিন সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং বন্ধ হয়েগেছে। বেশিরভাগ কওমি মাদরাসার মোহতামিম-শিক্ষকরা ধার-দেনা করে কোনোমতে তাদের প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে মাদরাসাসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর কওমি মাদরাসাগুলোর আর্থিক দৈন্যদশা লক্ষ্যনীয় হয়ে উঠেছে। অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

বাস্তব কারণেই কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা করোনার মধ্যেও প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। একটা সময় পর্যন্ত কিছু কিছু মাদরাসা চালু থাকলেও সেখানে করোনা সংক্রমণের কোনো প্রভাবের কথা শোনা যায়নি। এমনিতেই কওমী মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ওজু-গোসল, খাওয়া-দাওয়া, ৫ ওয়াক্ত নামাজসহ দৈনন্দিন কর্মকান্ডে কঠোর নিয়ানুবর্তিতা মেনে চলতে অভ্যস্থ। চালু হওয়ার পর থেকে কওমি মাদরাসাগুলো স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতা মেনে পরিচালিত হলেও আর্থিক সঙ্কট তাদের কাছে করোনার চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকারি অনুদান না থাকা এবং ব্যক্তিগত দান-অনুদান সংগ্রহের সুযোগ না থাকায় হঠাৎ চালু হওয়া মাদরাসাগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করা, শিক্ষক ও স্টাফদের বেতন এবং আবাসিক শিক্ষার্থী তথা লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের জন্য চাল-ডালসহ নিত্যপণ্য কেনাকাটার আর্থিক সঙ্গতি অনেক প্রতিষ্ঠানেরই নেই। বাধ্য হয়েই বাকিতে কেনাকাটা করা ছাড়াও নানাভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে মাদরাসাগুলো। রমজান মাসের যাকাত-ফিতরা, দানশীল ব্যক্তিদের অনুদান এবং কোরবানির পশুর চামড়ার দান কওমি মাদরাসাগুলোর আয়ের প্রধান উৎস। করোনালকডাউনে সবকিছু বন্ধ থাকার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারছে না কওমি মাদরাসাগুলো। দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন সংকট মোচনে স্থানীয় সাধারণ মানুষ ও সামর্থ্যবানদের উদার হস্তে এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি।

স্বতন্ত্র ধারার দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের কওমি মাদরাসাগুলো প্রায় ২’শ বছর ধরে আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা, সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধ সংরক্ষণ এবং জাতীয় চেতনাকে শাণিত রাখতে ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা পালন করে চলেছে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গির একশ্রেণীর মানুষকে কওমি মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। কিছু শিক্ষকের বিচ্ছিন্ন অপরাধে অভিযোগ তুলে কেউ কেউ মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে জঙ্গিবাদী তৎপরতার অভিযোগও তুলেছিল। তবে এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঢাকার হলি আর্টিজান হামলাসহ জঙ্গিবাদী তৎপরতার সাথে জড়িত সন্দেহে যাদেরকে ধরা হয়েছে তারা কেউই কওমি মাদরাসার শিক্ষক বা শিক্ষার্থী নন। তবে কওমি মাদরাসা নিয়ে এক শ্রেণীর মানুষের অহেতুক বৈরিতা-বিষোদ্গারের পাশাপাশি পুলিশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন মাদরাসার শিক্ষক-মোহতামিমরা। গত কয়েক বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্যে ধস নামিয়ে কওমি মাদরাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোর অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারি অনুদান না নিয়ে সাধারণ মানুষের দান-ছদকার উপর নির্ভরশীল মাদরাসাগুলোকে জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতা সন্দেহে দান-অনুদান নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি, দানশীল ব্যক্তিদের পরোক্ষভাবে ভয়ভীতির শঙ্কায় ফেলে কওমি মাদরাসার অর্থের উৎসগুলোকে বন্ধ করে দেয়াই যেন এসব তৎপরতার মূল লক্ষ্য। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, কওমি মাদরাসাগুলোর সাথে লাখ লাখ শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কোরআনে হাফেজ, মুফতি-মোহাদ্দেস এবং সমাজে অবহেলিত-ছিন্নমূল ও এতিম শিশু-কিশোরের শিক্ষা ও জীবন-জীবিকার স্বার্থ জড়িত। সরকারি সহায়তা ছাড়াও এতবড় জনহিতকর ও সামাজিক নিরাপত্তার এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সর্ব মহলের আন্তরিক প্রয়াস জরুরি।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন