দীর্ঘ সাত মাসে অপেক্ষার অবসান ঘটলো। আদালতে গড়াল চাঞ্চল্যকর রায়হান হত্যা মামলার অভিযোগপত্র। চার্জশীটে অভিযুক্তরা হচ্ছেন, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়া, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেকে এলাহি, হাসান উদ্দিন, পুলিশের কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, টিটু চন্দ্র দাস ও কথিত সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান। রায়হান হত্যা মামলার প্রধান আসামি বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া ও ৪ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে গতকাল (বুধবার) বেলা ১১টার দিকে সিলেট কোর্ট ইন্সপেক্টর প্রদীপ কুমার দাসের কাছে অভিযোগপত্রটি হস্তান্তর করে পিবিআই।
কোর্ট ইন্সপেক্টর প্রদীপ কুমার দাস বলেন, রায়হান হত্যা মামলার অভিযোগপত্র পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে পিবিআই। করোনাভাইরাসের কারণে আদালতের কার্যক্রম ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে চলায় আদালতে দাখিল করা হচ্ছে না অভিযোগপত্র। স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর পরই দাখিল করা হবে অভিযোগপত্র আদালতে। তবে এসময়ের মধ্যে পিবিআই প্রদত্ত অভিযোগপত্রে কোন অসংঙ্গতি রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। কোন অসংঙ্গতি পেলো পিবিআইকে জানানো হবে তা সংশোধনে।
এদিকে মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম এ ফজল চৌধুরী সিলেট বলেন, পিবিআই দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে কোন অসংঙ্গতি চোখে পড়লে, আদালতের নজরে দিয়ে প্রতিকার চাইবো।
পিবিআইর প্রেস বিফিং : গতকাল (বুধবার) দুপুরে পিবিআই সিলেটের সদর দফতরে রায়হান হত্যার সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রেসব্রিফ্রিং করেন বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, পিবিআই রায়হান হত্যা মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর মহানগর পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষ্য নেয়া, সাক্ষিদের জবানবন্দিসহ নানা বিষয় পর্যালোচনা করে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। অভিযোগপত্রসহ মোট কেস ডকেট ১ হাজার ৯৬২ পৃষ্ঠা রয়েছে। এরমধ্যে ২২ পৃষ্ঠা হচ্ছে শুধুই অভিযোগপত্র। পিবিআই তদন্ত করার সময় রায়হানের সাথে কোন পুলিশ সদস্যদের শত্রুতা ছিলো কিনা সে বিষয়টি তদন্ত করা হয়। তবে এর সত্যতা মিলেনি।
এছাড়াও পিবিআই আকবরের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ডিভাইসগুলো অ্যানালাইসিস করে প্রাপ্ত তথ্য অভিযোগপত্রে দাখিল করা হয়। তিনি বলেন, ১১ অক্টোবর গোলাগঞ্জের প্রতারক সাইদুল শেখ ও রনি শেখ রাত ১টা ৪৫ মিনিটে কাস্টঘর সুইপার কলোনী থেকে ৪ পিস ইয়াবা ক্রয় করে। ক্রয়কৃত ইয়াবাগুলো আসল নয় তারা বুঝতে পারেন। এরপর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রায়হান আহমদ মারপিট করে সাইদুল শেখের কাছ থেকে মোবাইল ও ৯ হাজার ৭০০ টাকা নিয়ে যায়। পরবর্তীতে কোতোয়ালি থানাধীন মাশরাফিয়া রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সিয়েরা-৪ ও রোমিও-৪ এর কাছে সাইদুল শেখ ও রনি শেখ মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন। পরে পুলিশ কাস্টঘরের চুলাই লালের ঘর থেকে রায়হান আহমদকে আটক করে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। এরপর পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই, পুলিশের সাথে খারাপ আচরণ করায় রায়হানকে ফাঁড়িতে নিয়ে এসআই আকবর বেতের লাঠি দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে মারপিট করেন। এরপর ১১ অক্টোবর সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে ওসমানী মেডিক্যালে রায়হানকে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য আসামিরা ভিকটিম রায়হানকে কাস্টঘরে ছিনতাকালে গণপিটুনিতে মারা হয়েছে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে এবং ঘটনার সংশ্লিষ্ট আলামত ধ্বংস করে।
তিনি আরও বলেন, পিবিআই দাখিল করা অভিযোগপত্রে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবনের দুটি ধরা রয়েছে। তবে অভিযোগপত্রে যেসব আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে তা প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে বলে অভিযুক্তদের এমন তথ্য জানিয়েছেন পিবিআই।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান জানান, অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে ৩০২, ৫০১ ও ৩৪ ধারায়। এছাড়া অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর ১৫(২), ১৫(৩) ধারায়। ওই দুই আইনের একটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও অপরটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের কথা উল্লেখ রয়েছে। ১৯৬২ পৃষ্ঠার এই অভিযোগপত্রে ৬৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে জানিয়ে এসপি বলেন, এরমধ্যে ১০ জন ১৬৪ ধারায় আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। এর মধ্যে পুলিশ রয়েছেন ৭ জন।
রায়হানের মা সালমা বেগমের প্রতিক্রিয়া : চার্জশিট দাখিল প্রসঙ্গে এক প্রতিক্রিয়ায় রায়হানের মা সালমা বেগম চোখের বলেন, চার্জশিট দাখিল করতে এত সময় নিলো পুলিশ। পুলিশ আমাদের বললো- ভালো ফলাফল পেতে গেলে একটু ধৈর্য ধরতে হবে, দেরি হবে। আমরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলাম তো ৮ মাস। কিন্তু শুনলাম- চার্জশিটে ২/৩ জনের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। তাহলে এই অপেক্ষা করে কী হলো লাভ ? সালমা বেগম আরো বলেন, আপনাদের হিসেবে রায়হান না থাকার ৭-৮ মাস। কিন্তু আমার কাছে আমার কলিজার টুকরা সন্তান হারানোর পর একেকটি দিন ছিলো যেন একেকটি বছর। রায়হানের মা সালমা বেগম আরও বলেন, জড়িত সব আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তাহলে আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে। আমি মরে যাওয়ার আগে আসামিদের শাস্তি দেখে যেতে চাই।
রায়হান মৃত্যু পর পুলিশের দাবি : মৃত্যুর বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় কাস্টঘর এলাকায় ছিনতাই করা কালে গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে রায়হানের। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে। বন্দরবাজার ফাঁড়ির কর্মকর্তা ও মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে এমন খবরও প্রকাশ করেছিল গণমাধ্যমে।
জমা হলো অভিযোগপত্র : মামলার তদন্তকাজে দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ে পিবিআই। আদালত থেকেও রায়হান হত্যা মামলার অভিযোগপত্র ৩০ জানুয়ারির মধ্যে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে এই সময়ে তদন্ত শেষ না হওয়ায় পিবিআইয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি জমা দেয়ার সময় বাড়ানো হয় ৩০ কার্যদিবস। তবে করোনা পরিস্থিতিতে এই সময়ের মধ্যেও জমা দেয়া হয়নি অভিযোগপত্র। তবে ধার্যকৃত সময় পার হতে না হতেই চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র জমা হয়েছে আদালতে।
পিবিআইয়ের সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান বলেন, অভিযুক্ত পাঁচজনই কারাগারে। পলাতক শুধু নোমান। তবে এ ঘটনায় গ্রেফতার পুলিশ কনস্টেবল তৌহিদ মিয়ার কোন সংশ্লিষ্টতা পায়নি পিবিআই। অপরদিকে, রহস্যজনক কারনে এ মামলায় ৭ মাসেও গ্রেফতার হয়নি, চার্জশীটভুক্তও হয়নি বন্দরবাজার পুলিশের কর্মরত তৎকালীন এএসআই কুতুবউদ্দিন। অথচ হত্যা ঘটনার রাত ৩ টায় বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির রাত্রিকালীন টহলরত পৃথক ২টি ডিউটি পার্টির ইনচার্জ ছিলেন তিনি ও এএসআই আশেক এলাহি। এই ২টি টিম নগরীর কাষ্টঘরের সুলাইলালের ঘর থেকে আটক করে ফাঁড়িতে নিয়ে আসে রায়হানকে। এ এস আই কুতুুব উদ্দিনের ভূমিকা বা সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি এখনো অন্ধকারে। মামলায় যেমন গ্রেফতার হননি কুতুব উদ্দিন, তেমনি এখনো নিরাপদ অবস্থানে রয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে, আলোচিত কনেস্টবল তৌহিদ মিয়াও বেচে গেছে চার্জশীটে। অথচ কনেস্টবল তৌহিদ মিয়ার ফোন থেকে ফোন করে ১০ হাজার টাকা আনতে বলা হয়েছিলো মর্মে তথ্যও প্রকাশ পেয়েছিল। এই চার্জশীট প্রসঙ্গে নিহত রায়হানের মা সালমা বেগম এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, চার্জশীটে ২/৩ জনের নাম বাদ পড়েছে। সেই ২/৩ জনের নাম হিসেবে কুতুব ও তৌহিদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন বলে অনেকের ধারণা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন