কেহ কেহ মনে করতে পারেন যে নফল এবাদত কোন মর্যাদা সম্পন্ন এবাদত নয় - আসলে ইহা একটি নিতান্ত ভুল ধারণা। কারণ হাদীস শরীফে এসেছে ফরয, ওয়াজিব এবাদতে ত্রুটি ধরা পড়ে হাশরের দিন যখন ওজনে কম পড়বে, আল্লাহ পাক নিজগুণে তার নফল এবাদত দ্বারা উহা পূর্ণ করে তাকে রেহাই দেয়ার ব্যবস্থা করবেন (আবু দাউদ হাদীস নং: ৮৬৪)। অতএব ফরয ওয়াজিব ছাড়াও যথেষ্ট পরিমাণে রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তরিকা মতে নফল নামায, নফল রোযা, নফল ছদকা, তাছবিহ ও তেলাওয়াত ইত্যাদি করা আমাদের পক্ষে একান্ত জরূরী। এসব নফল এবাদত দ্বারা মাতা-পিতা, ভাই-বোনসহ আত্মীয় স্বজন মুর্দেগাণের রোহে বখসে দেয়া তাঁদের পক্ষে বড়ই উপকারী হয়।
নফল রোযার ফদ্বিলত
রোযা মানুষের গুনাহমাফির মাধ্যমে নিষ্কলুষ ও নির্ভেজাল করে। রোযার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমান যাতে শুধু মাহে রামাদ্বানের ফরয রোযা রেখে থেমে না যান, বরং কীভাবে সহজেই পূর্ণ বছরটা মহান আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা ও ভালোবাসার পাত্র হয়ে থাকতে পারেন এবং কী করে চিরস্থায়ী জান্নাতের বাসিন্দা হতে পারেন এবং পরকালে কীভাবে সফলকাম থাকতে পারেন রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের সামনে এই পথ সুস্পষ্ট করে দিয়ে গেছেন।
ফরয ও ওয়াজিব রোযা ছাড়া অন্যান্য রোযাকে নফল রোযা বলা হয়; নফল মানে অতিরিক্ত, ফরয বা ওয়াজিব নয়। মূলত এই নফল রোযা দুইপ্রকার। প্রথম প্রকার হলো নির্ধারিত বা রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক গুরুত্ব সহকারে পালনকৃত, এই প্রকার রোযা সুন্নাতে মুআক্কাদা। দ্বিতীয় প্রকার হলো অনির্ধারিত, এগুলো মুস্তাহাব। এই উভয় প্রকার রোযাকে সাধারণভাবে নফল রোযা বলা হয়ে থাকে।
হযরত রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নফল রোযার মধ্যে সওমে দাউদ বা দাউদ আলাইহিস সাল্লাম এর রোযার চেয়ে উত্তম আর হতে পারে না । তিনি এক দিন রোযা রাখতেন আর এক দিন বিরত থাকতেন। এভাবে তিনি বছরের অর্ধেক সময় রোযা রাখতেন।’ (বুখারি হাদীস নং:১৯৭৬, মুসলিম হাদীস নং:১১৫৯, আবু দাউদ হাদীস নং:২৪৪৮, তিরমিজি হাদীস নং:৭৭০) ।
হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআ’লার সন্তুষ্টির জন্য একটি রোযা রাখবে, আল্লাহ তাআ’লা তার মুখমন্ডল দোজখের আগুন থেকে ৭০ বছরের রাস্তা দূরে রাখবেন।’ (মুসলিম হাদীস নং:১১৫৩, নাসায়ী হাদীস নং:২২৫২ )।
রোযার ফদ্বিলত সম্পর্কে হাদীস শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যক বস্তুর যাকাত আছে, শরীরের যাকাত রোযা।’ (ইবনে মাজাহ হাদীস নং:১৮১৭)। রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘রোযা ঢাল স্বরূপ এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচার সুদৃঢ় দুর্গ।’ (নাসায়ী হাদীস নং:২২৩০)।
হযরত আবু উমামা বর্ণনা করেন, রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি আমাদের কিছু আমল করার উপদেশ দান করুন। তখন রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘রোযা রাখ, এর সমকক্ষ কোনো আমল নেই।’ তাঁরা পুনরায় বললেন, আমাদের কোনো আমল বলে দিন। রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘রোযা রাখ, এর সমতুল্য কোনো আমল নেই।’ তাঁরা পুনরায় একই প্রার্থনা করলেন। রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় একই আদেশ করলেন। (নাসায়ী হাদীস নং:২২২৩)।
হযরত আব্দুুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রোযাদার ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়। (বায়হাকি)।
শাওয়ালের নফল রোযা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বছরের মধ্যে কয়েকটি দিনের নফল রোযা রাখা অত্যন্ত ফদ্বিলত বলে স্বীয় উম্মতকে তাকিদ করেছেন। তন্মধ্যে শাওয়াল মাসে ৬ টি রোযা রাখা পূর্ণ এক বছরের রোযা রাখার সমতুল্য। তাছাড়া এ রোযার বরকতে পাপ হতে মুক্তি লাভ হয়। এ রোযা গুলো একাধারে বা দু একদিন অন্তর অন্তর, শাওয়াল মাসের শুরু-শেষ-মাঝামাঝি সব সময় রাখার এখতিয়ার আছে। ধারাবাহিকভাবে বা বিরতি দিয়ে যেভাবেই করা হোক, রোযাদার অবশ্যই এর সওয়াবের অধিকারী হবেন।
হযরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রামাদ্বানের রোযা রাখল, অতঃপর তার সঙ্গে সঙ্গে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা রাখল, সে যেন পূর্ণবছরই রোযা রাখল।’ (মুসলিম হাদীস নং:১১৬৪, আবু দাউদ হাদীস নং:২৪৩৩, তিরমিজি হাদীস নং:৭৫৯, ইবনে মাজাহ হাদীস নং:১৭৮৭, আহমাদ: ৫/২৮০, দারেমি: ১৭৫৫)
অন্য বর্ণনায় আছে- “আল্লাহ এক নেকিকে দশগুণ করেন। সুতরাং এক মাসের রোযা দশ মাসের রোযার সমান। বাকী ছয় দিন রোযা রাখলে এক বছর হয়ে গেল।” নাসায়ী হাদীস নং:২২১৫, ইবনে মাজাহ হাদীস নং:১৭০৭)। হাদীসটি সহিহ আত-তারগীব ও তারহীব (১/৪২১) গ্রন্থেও রয়েছে। সহিহ ইবনে খুজাইমাতে হাদীসটি এসেছে এ ভাষায়- “রামাদ্বান মাসের রোযা হচ্ছে দশ মাসের সমান। আর ছয় দিনের রোযা হচ্ছে- দুই মাসের সমান। এভাবে এক বছরের রোযা হয়ে গেল।”
এ ছাড়া শাওয়ালের ছয় রোযা রাখার আরও ফায়দা রয়েছে - অবহেলার কারণে অথবা গুনাহর কারণে রামাদ্বানের রোযার উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে থাকে সেটা পুষিয়ে নেয়া। যদি কোনো ব্যক্তি রামাদ্বান মাসের ৩০টি রোযা রাখে, তাহলে তার ১০ গুণ তিন শ’ রাত হবে। আর শাওয়ালের ৬ রোযার ১০ গুণ ৬০ হবে। এমনিভাবে সব রোযার সওয়াব মিলে ৩৬০ দিন হয়ে গেল। আর আরবি দিনপঞ্জী হিসাবে ৩৬০ দিনেই তো বছর পূর্ণ হয়।
একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, শাওয়ালের ৬ রোযার সাথে রামাদ্বানের কাযা রোযা আদায় হবে না। উভয় রোযাই আলাদা আলাদা রাখতে হবে। যদি কাযা রোযা থাকে তবে শাওয়ালের ৬ রোযা প্রথমে রেখে পরে কাযা রোযা রাখা শুরু করতে পারবেন যাতে করে শাওয়ালের রোযার সওয়াব থেকে বঞ্চিত না হন, কারণ কাযা রোযা বছরের যে কোন সময় রাখা যাবে। উল্লেখ্য, রামাদ্বানের কাযা রোযা আদায় করা ফরয। কেউ নফল রোযা রেখে ভেঙে ফেললে তার ও কাযা আদায় করা ওয়াজিব। কোনো মুমিন মুসলমান যদি তার অপর কোনো ভাই-বোনকে এই রোযা রাখতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সে যদি তার পরামর্শে রোযা রাখে, তবে উদ্বুদ্ধকারীও সমান সওয়াবের অধিকারী হবেন।
এ রোযা ফরয নামাজের পর সুন্নাতে মুআক্কাদার মতো। যা ফরয নামাজের উপকারিতা ও তার অসম্পূর্ণতাকে পরিপূর্ণ করে। অনুরূপভাবে শাওয়াল মাসের ৬ রোযা রমযানের ফরয রোযার অসম্পূর্ণতা সম্পূর্ণ করে এবং তাতে কোনো ত্রুটি ঘটে থাকলে তা দূর করে থাকে। সে অসম্পূর্ণতা ও ত্রæটি কথা রোযাদার জানতে পারুক আর নাই পারুক।
তাছাড়া রামাদ্বানের ফরয রোযা পালনের পরপর পুনরায় রোযা রাখার মানেই হলো রামাদ্বানের রোযা কবুল হওয়ার একটি লক্ষণ। যেহেতু মহান আল্লাহ কোনো বান্দার নেক আমল যখন কবুল করেন, তখন তার পরেই তাকে আরও নেক আমল করার তাওফিক দান করে থাকেন। যেমন উলামায়ে কেরাম বলে থাকেন, ‘নেক আমল কবুল হওয়ার আলামত হলো, তার পরে পুনরায় নেক কাজ করা (আহকামুস সিয়াম)। (চলবে)
লেখক: ইমাম এবং ইসলামী গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন