সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। যুগ যুগ ধরে এ দেশে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের বাস। মানবতাবাদী, আত্মীয়তা পরায়ণ, সাংস্কৃতিক ও অসম্প্রাদায়িক জাতি হিসেবে আমরা বিশ্ব দরবারে পরিচিত। মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দর্শন এ দেশকে শাসন করছে বহু বছর ধরে। কিন্তু হঠাৎ করে যেন হোঁচট খেল নজরুল-জীবনান্দের বাংলাদেশ। একে একে দ্বিমতের মানুষ, ব্লগার, লেখক, প্রকাশককে হত্যা করছে উগ্রবাদী গোষ্ঠী। সর্বশেষ ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে ও ঈদুল ফিতরে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ঈদগাহ জামাত শোলাকিয়ায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি। স্তব্ধ পুরো দেশ, জাতি, বিশ্ব। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা এ উগ্রপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীর মগজ ধোলাইয়ের শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত ছাত্র, সমাজের অভিজাত শ্রেণীর তরুণ। যাদের কিনা দায়িত্ব ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার। প্রথম দিকে অভিযোগের আঙ্গুল নর্থ সাউথসহ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে থাকলে ধীরে জঙ্গি সন্দেহের তালিকায় খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। গত ৬ আগস্ট কথিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত, অসম্প্রায়িক চেতনার বাতিঘর জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে। জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের এমন বিপদগামীতায় হিসাব মিলাতে পারছে না কেউ। ভুলগুলো কোথায়? নীতি বিবর্জিত রাজনৈতিক চর্চায়, শিক্ষা ব্যবস্থায় নাকি সামজিক অবক্ষয়ে বিপদগামী তরুণরা। নানা জনের নানা ক্যালকুলেশন। হতাশার বাণী, অভিযোগ, পরামর্শ চলছে বুদ্ধিজীবীদের। গত ৩ সেপ্টেম্বর দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠি^ত হয় জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ। কিন্তু কি ভাবছে ছাত্র সমাজ। জঙ্গিবাদের উত্থান ও প্রতিরোধ, কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাবনা জানাচ্ছে, শাহাদত হোসাইন স্বাধীন।
জঙ্গিবাদ কোন দেশের জন্যই কখনোই ভালো নয় এবং প্রতিটি শান্তি প্রিয় দেশের প্রতিটি শান্তি প্রিয় মানুষ কখনোই প্রত্যাশা করে না। কোন সুনিদিষ্ট ধর্ম কে ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা নির্দিষ্ট গ্রুপ আজ যেই হত্যাজঙ্গ কার্যকলাপ চালাচ্ছে তা কোন মানুষ, পরিবার, সমাজ, কোন দেশ মেনে নিতে পারে না। এবং পারবেও না। জঙ্গিসম্পৃক্ত পরিবার, মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনরাও মেনে নিতে পারে না।
মো. ইসমাইল হোসেন, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জঙ্গি নির্মূলে এখন থেকেই আমাদের প্রতিটি মানুষকে সচেতন হতে হবে এবং সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। জঙ্গিবাদ বা জঙ্গি নির্মূলে সবার আগে পারিবারিক শিক্ষা প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। আমি, আপনি, আমরা সবাই যার যার অবস্থা থেকে সচেতন হলেই জঙ্গিবাদ নির্মূল হবে বলে আশা করা যায়। যা হবে আমার-আপনার জাতি পুুরো পৃথিবীর জন্য কল্যাণময় ও সুখীময়। সুখ-শান্তির পৃথিবী নির্মাণে আসুন আমারা এক ও অভিন্ন হয়ে কাজ করি।
হাসান মিজান, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্বে জঙ্গিবাদের উত্থান বহুমাত্রিক, এর অন্যতম কারণ ধর্মীয় উগ্রবাদ। দুর্ভাগ্যবশত শান্তির ধর্ম ইসলামকে জঙ্গিরা নিজেদের সার্থে অপব্যাখ্যা করছে। দেশরতœ শেখ হাসিনার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীরা ছাত্রসমাজকে মগজ ধোলাই করে বিপদগামী করছে। একাত্তরে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ রেখে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম। আজ সময় এসেছে ১৬ কোটি জনতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গিবাদের অপশক্তিকে সমূলে উৎখাত করতে হবে।
মিজানুর রহমান, শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা থেকে ব্লগার হত্যা, ধর্মীয় গুরু হত্যা, বিদেশিদের উপর হামলা প্রত্যেকটা ঘটনা জঙ্গিবাদ উত্থানের ধাপ। সরকারকে অনেক আগে থেকে সচেতন হওয়া উচিত ছিল। সরকার তা না করে বিরোধীদল দমনে ব্যস্ত ছিল। একসময় ধারণা ছিল মাদ্রাসার এতিম ছেলেরা জঙ্গিবাদে জড়িত। কিন্তু হতবাকের বিষয় উচ্চ শিক্ষিত তরুণরা আজ দেশ ধ্বংসের লীলা খেলায় মত্ত। অস্ত্র দিয়ে হয়তো জঙ্গি নির্মূল করা যাবে কিন্তু জঙ্গিবাদ নয়। আর জঙ্গি হয়ে উঠা ও রোধ করাও সম্ভব না অস্ত্রের মুখে। তার জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাতায়ন। পাড়ায় পাড়ায় পাঠশালা গড়ে তুলতে হবে। যে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল আর লালন পড়েছে, সে হবে বাঙালি। বাঙালি কখনো জঙ্গি হতে পারে না।
রাদিয়া রওশন, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
গুলশানের হলি আর্টিজান হোটেলে ইতালীয়, জাপানি, ভারতীয় নাগরিকদের খাবার টেবিলে হত্যা করা হয়েছে। এ রকম নৃশংস এবং জঘন্যতম হত্যাকা-ের ঘটনা যারা ঘটাতে পারে তারা ধর্মপ্রাণ মানুষ হতে পারে না। ঈদের দিনে মুসল্লিদের ওপর হামলা করতে যারা উদ্ধত হয়, কোন ধর্মেই তাদের ঠাঁই নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে শিক্ষার্থীদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যাপারেও মন্তব্য করেন।
শাহীন সরদার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
অসম্প্রাদায়িক চেতনার এ বাংলাদেশে ’৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে উত্থান ঘটেছিল তার চূড়ান্ত ধাপ আজকের জঙ্গিবাদ। গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান হয়েছিল সকল মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু রাজাকারের সাথে আপসকারীরা গণজাগরণ মঞ্চে থামিয়ে দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে থামিয়ে দিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধীরাই আজ জঙ্গিবাদের বীজবপন করে এ দেশকে ইরাক-সিরিয়া বানাতে চায়। তরুণ প্রজন্মকে সঠিক রাজনৈতিক দর্শনের দীক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে হবে। সবার উচিত প্রিয় সন্তান, বন্ধু, ভাই-বোনের প্রতি যতœবান হওয়া। নিজেদের মাঝে নিজেদের স্বপ্ন-জিঘাংসাগুলো নিয়ে আলোচনা করা। আমরা আর একটি তরুণকেও বিপদগামী দেখতে চাই না।
মনসুর আলম, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশকে আজকে তলাবিহীন ঝুড়ি বাননোর পাঁয়তারা চলছে। সাম্রাজ্যবাদীদের নতুন খেলার নাম জঙ্গিবাদ। এই জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত যুদ্ধ রাজনীতি আর অস্ত্রের অর্থনীতি। ১৯৭১ সালে যে অপশক্তি আমাদের হারাতে পারেনি তারা আজ প্রতিশোধের নেশায় মেতেছে। কিন্তু আমরা ’৫২-এ হারিনি, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ আর মহান ১৯৭১ এ হারিনি। আজও হারবো না। কয়েকজন বিপদগামী তরুণের কাছে আমার বাংলাদেশ হারতে পারে না। আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াবো। শুধু প্রয়োজন রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐক্য প্রচেষ্টা। অবশ্যই প্রত্যেককে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে। এ দেশ, মাটি, মা আমার আপনার সবার।
এইচএম রাফসান, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
জঙ্গিবাদের যে ধাক্কা খেল তা প্রতিরোধে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। কিন্তু আমার দেশের রাজনীতিবিদরা শুধু পুত্রের মৃত্যু বা ক্রিকেটে হেরে যাওয়া নয় জঙ্গি হামলার এমন ক্রান্তিমুহূর্তে দাঁড়িয়ে অপরাজনীতি করছে যা খুব দুঃখজনক। এই মুহূর্তে সত্যিকারের জাতীয় ঐক্য ডাক দেয়া উচিত। অথচ একদল বলছে জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে অন্য দল জাতীয় ঐক্যের নামে নির্বাচনী জোট গঠনে ব্যস্ত। এমন ক্রান্তি মুহূর্তেও রাজনীতিবিদরা দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উড়তে পারছেন না, এর চেয়ে পরাজয় আর নেই।
মাইদুল ইসলাম, পরিবেশ বিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
যে তরুণদের হওয়ার কথা ছিল সোনার বাংলা গড়ার কারিগর। সে তরুণরা আজ বিপদগামী, দেশদ্রোহী। আমরা সঠিক সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারিনি। যে রাজনীতি দেশের চালিকাশক্তি সে রাজনীতিকে ঘৃণা করতে শিখছে তরুণ প্রজন্ম। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা স্টুডেন্টদের স্টুপিড বানাচ্ছে। দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি নিয়ে জানার সুযোগ নেই। শিক্ষা ২০০ ফুটের এসি রুমে আটকানো হয়েছে। বাঙালি নয় ওয়েস্টার্ন হতে শিখাচ্ছে এই শিক্ষা ব্যবস্থা। সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। তাই আজ আফগানিস্তান আর সিরিয়া থেকে এসে আমাদের তরুণদের ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে উগ্রবাদী করে তুলতে পারছে। আর জন্য প্রতিটি মসজিদের ইমাম ও ধর্মীয় গুরুদের সঠিক ধর্মীয় বয়ান দেয়া উচিত। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক কর্মকা- বৃদ্ধি করাটা ও জরুরি। আমরা সব দল-মত-ধর্ম-বর্ণের মানুষেরা হাতে হাত রাখলে জঙ্গিবাদের এই অপশক্তিকে নির্মূল করা সম্ভব।
এ এন আলামিন মিয়া, সমাজ কল্যাণ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সমাজের উচ্চবিত্ত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত তরুণরা যে জঙ্গিবাদে জড়িত হচ্ছে তা খুব ভয়ঙ্কর। সমাজের তথাকথিত উঁচু সমাজের লোকজনের ধর্মীয় জ্ঞান অথবা বাঙালি কৃষ্টি-কালচার সংস্কৃতির প্রতি কোন আগ্রহ নেই। তাদের এই জ্ঞান শূন্যতার ফলে মগজ ধোলাই তথা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। প্রত্যেক বাবা-মার উচিত তাদের সন্তানদের সঠিক ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি বাঙালি হিসেবে আমাদের ঐতিহ্য, একাত্তরের ইতিহাস জানানো। যতটুকু সম্ভব ফ্লাটের মধ্যে সন্তানদের আবদ্ধ না রেখে সামাজিক কর্মকা-ে জড়িত রাখা উচিত। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নামক কিন্ডারগার্টেনগুলোতে অবশ্যই রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া উচিত। যে যে দলই করুক একজন রাজনীতি সচেতন ছাত্র দেশবিরোধী হতে পারে না।
আবদুল্লাহ ্আল মামুন, বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন