সুস্থতা-অসুস্থতা আল্লাহরই নেয়ামত। সুস্থতা যেমন আল্লাহর নেয়ামত ঠিক তেমনি অসুস্থতাও আল্লাহর নেয়ামত।বাংলায় একটা প্রবাদবাক্য আছে,›সুস্থতাই সকল সুখের মূল›।
সুস্থতা মহান আল্লাহ পাকের এক বিশেষ নেয়ামত।যা আল্লাহ তায়া’লা বান্দাদের দান করে থাকেন।
কেননা সুস্বাস্থ্য মুমিনের জন্য রহমত স্বরূপ। তাইতো রাসূল (সা.) বলেন, ‘একজন ভগ্ন স্বাস্থ্যবান মুমিন থেকে স্বাস্থ্যবান মুমিন আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠ ও প্রিয়’।
হাদীস শরীফে এসেছে, ইবনে আব্বাস রা: বলেন, রাসূল সা: বলেন, দু’টি নিয়ামতের ব্যাপারে অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। নিয়ামত দু’টি হলো; ‹সুস্থতা› ও ‹অবকাশ। (সহিহ বুখারি)
সুস্থতা কতো বড়ো নেয়ামত তা এই হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়।কারণ, হাদীসে বর্ণিত দুইটি নেয়ামত মানুষের কাছ থেকে চলে গেলে মানুষ এর কদর বুঝে।তখন বুঝা যায় সুস্থতা কতো বড়ো নেয়ামত ছিলো।
অন্য হাদীসে নবী করিম (সাঃ) বলেন, অবশ্যই মানুষকে সুসাস্থ্য ও সুস্থতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত আর কিছু প্রদান করা হয় নি। (সুনানে নাসায়ি ১০৭২)
ইবাদতে মনোনিবেশের জন্য দেহ ও মনের সুস্থতা প্রয়োজন অনিস্বীকার্য। যে কারণে ইসলামে সুস্থ্য থাকার উৎসাহ সৃষ্টি করা হয়েছে। নবিজী (সাঃ) বলেছেন, ্রদূর্বল মুমিনের তুলনায় শক্তিশালী মুমিন বেশি কল্যাণকর ও আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়। তবে উভয়ের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ৬৯৪৫)।
অপর হাদীসে মহানবী (সাঃ) বলেন ্রযে ব্যাক্তি প্রত্যুষে সুস্থতা নিয়ে ঘুম থেকে উঠে, বাসায় নিরাপদে থাকে এবং সারাদিনের খাদ্য সামগ্রী তার নিকট মজুদ থাকে তাহলে তাকে পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ দেয়া হয়েছে। (জামে তিরমিজি: ২৩৪৬)
সুস্থতা যে কতো বড়ো নেয়ামত তা একজন অসুস্থ ব্যক্তিই ভালো জানে।
সুস্থতা অবস্থায় তো আল্লাহকে আমরা অনেক ডাকি, কিন্তু অসুস্থ্য অবস্থায় ডেকেছি কখনও?
একবার ডেকে দেখুন কতটা প্রশান্তি অনুভব হয়!একবার চলে যান যে কোন সরকারি বা বেসরকারী হসপিটালে!গেলে বুঝতে পারবেন সুস্থতা যে কত বড় নেয়ামত সেখানে গেলে কঠিন হৃদয়ও নরম হয়ে যায়। কারণ, হসপিটালে এমন কিছু রুগী আছে যেগুলো দেখলে নিজের প্রতিটা অঙ্গের কথা অটোমেটিক স্মরণ হয়ে যায়! মনে হয়ে যায় আমার আল্লাহ আমাকে কত সুখে রেখেছেন কতটা সুস্থ রেখেছেন। কতো ধরণের নেয়ামত দ্বারা ভরপুর করে রেখেছেন।
ঠিক তেমনিভাবে অসুস্থতাও আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেআমত। বিভিন্ন হাদীসে রোগ-শোক ও বালা-মসিবতের তাৎপর্য ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। অসুস্থতা দেহের যাকাত স্বরূপ। এর দ্বারা শরীর গুনাহমুক্ত হয়, পাক-পবিত্র হয়। আল্লাহর কাছে বান্দার মর্যাদা বুলন্দ হয়। ভবিষ্যত জীবনের জন্য উপদেশ গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়।
জামে তিরমিযীর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, কিয়ামতের দিন বিপদগ্রস্ত লোকদেরকে যে মহা পুরস্কার দেয়া হবে তা দেখে আফিয়াতের অধিকারী লোকেরা কামনা করবে, হায়! দুনিয়াতে যদি তাদের দেহ কাঁচি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করা হত (আর তার বিনিময়ে আখেরাতের এ মহা পুরস্কার লাভ হত) -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪০২।
অসুস্থতা মোমেনের জন্য নেয়ামত।কেননা সুস্থতা-অসুস্থতা উভয়টি আল্লাহর নেয়ামত। উভয়টিই আল্লাহর দান।এই অসুস্থতা কোন বান্দার জন্য গজব না।বরং বান্দার জন্য নেয়ামত স্বরূপ। মোমেনের কাছে যখন অসুস্থতা আসে আর সে ধৈর্য ধরে তখন এর ফল অসাধারণ হয় আল্লাহর পক্ষ হতে।
আল্লাহ বলেন, অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, জান ও মালের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে’ (বাক্বারাহ ১৫৬)। যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস আনয়ন করে তারা মাওলার দেয়া সমস্ত কঠিন মসিবতকে সহজ ভেবে শুকরিয়া আদায় করে,তাদের জন্য অসুস্থতা-ও সুস্থতার মতো মনে হয়। কারণ, খোদাভীতিহীন ময়দান তো আল্লাহর তাজাল্লীর উপযোগী নয়। আর আল্লাহ-পাকের তাজাল্লী ও রহমত ব্যতিত শান্তি আসতে পারে না। ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষমতা ও রং-তামাশা উপকরণের কোন অভাব নেই, কিন্তু তাদের অন্তর অন্ধকারে নিমজ্জিত ও শান্তি থেকে বঞ্চিত। মানুষ তো ভুলে যায় আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের কথা, যখন সে সুস্থ থাকে তখন।
তাই আমাদের ভাবতে হবে সুস্থতা-অসুস্থতা উভয়টি আল্লাহর নেয়ামত । এবং আমাদেরকে এই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে হবে। আমরা তো অনেকে এরকম করি যে,যখন অসুস্থ থাকি তখন আল্লাহকে প্রচুর স্মরণ করি,গোনাহ করা ছেড়ে দেই,চুপ থাকি,মানুষের সাথে সদ্ব্যাবহার করি।আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করি।তখন আমরা সুস্থতার কদর বুঝি এবং নিয়ত করি সুস্থতার শুকরিয়া আদায় করবো,ঠিকমতো নামাজ পড়বো,আল্লাহর হুকুম মেনে চলবো।কিন্তু অত্যন্ত আফসোসের বিষয় আমাদের মাঝে তা দেখা যায়না।আমরা সুস্থ হলে আল্লাহকে ভুলে যাই।আবার গোনাহ করা শুরু করি। মানুষকে কষ্ট দেই।সমাজে অনেককে দেখতে পেয়েছি,যারা অসুস্থ হলে সেরা বুযুর্গ হয়ে যায়,প্রতিবেশীর কাছে ক্ষমা চেয়ে আল্লাহ ওয়ালা হয়ে যায়।কিন্তু তারা যখন আবার সুস্থ হয়ে যায় তখন শুরু হয়ে গোনাহের দরজা,মানুষকে কষ্ট দেয়া।তখন আর আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়ার কথা ভুলে যায়।
এজন্যই আল্লাহ তায়া’লা বলেন; ‹মানুষকে যখন বিপদ স্পর্শ করে তখন শুয়ে-বসে-দাঁড়ানো অবস্থায় আমাকে ডাকতে থাকে। আর যখন তাকে বিপদ মুক্ত করে দেই তখন এমনভাবে চলে যায় যেন সে বিপদে পড়ে আমাকে ডাকেইনি›। -সূরা ইউনুস (১০)
শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানী রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন- ‘অর্থাৎ মানুষ মূর্খতাবশত নিজেই আযাব চাইতে থাকে, কিন্তু যখন বিপদের সামান্য ঝাঁকুনি খায় তখন হতবিহ্বল হয়ে আমাকে ডাকা শুরু করে। মসিবত যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে-বসে-শুয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ডাকতে থাকে। আর যখন বিপদ সরিয়ে নেয়া হয় তখন সবকিছু ভুলে যায়। তখন আর আল্লাহর কথা মনে থাকে না। সেই গাফলত, সেই উদাসিনতা, সেই পাপাচারে আবার মেতে ওঠে। ইতিপূর্বে যেগুলোর মাঝে সে আকণ্ঠ ডুবে ছিল।
এজন্য বলি একজন মোমেনের জন্য উচিৎ হলো সে সর্বদা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা,সুস্থ অবস্থায়ও আবার অসুস্থ অবস্থায়ও।এগুলোকে আল্লাহর নেয়ামত মনে করে শুকরিয়া জ্ঞাপন করা।তখনই একজন মোমেন সফল হতে পারে।
পরিশেষে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি এর একটি হাদীস দ্বারা শেষ করতে চাই।
আল্লাহর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)ইরশাদ করেন ‹হে আমার উম্মাহ! পাঁচটি সম্পদ হারানোর আগে যথাযথ মূল্যয়ন করোঃ
১.মারা যাওয়ার আগেই তোমার জীবনের প্রতি মূহুর্তকে কাজে লাগাও। ২.বুড়ো হওয়ার আগে যৌবনকে কাজে লাগাও। ৩.দারিদ্র্যের আগে সচ্ছলতার মূল্য দাও। ৪.অসুস্থতার আগে সুস্থতার মূল্য দাও। ৫.ব্যাস্ততার আগে অবসরকে কাজে লাগাও। (মুসতারেকে হাকিম: ৭৮৪৬)
আল্লাহ তায়া’লা আমাদেরকে সঠিক বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুক, আমিন।
লেখিকা: শিক্ষার্থী, মাহমুদিয়া মহিলা মাদ্রাসা ডেমরা, ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন