পূর্ব প্রকাশিতের পর
আল্লামা ইবনে রজব (রহ.) বলেন, শাওয়াল মাসে রোযা রাখার তাৎপর্য অনেক। রামাদ্বানের পর রোযা রাখা রামাদ্বানের রোযা কবুল হওয়ার আলামত স্বরূপ। কেননা আল্লাহ তাআ’লা কোন বান্দার আমল কবুল করলে, তাকে পরেও অনুরূপ আমল করার তৌফিক দিয়ে থাকেন। নেক আমল কবুলের আলামত ও প্রতিদান ভিন্নরূপ। তার মধ্যে একটি হলো পুনরায় নেক আমল করার সৌভাগ্য অর্জন করা।
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের নফল রোযা
৯ই জিলহজ তারিখে রোযা রাখা বড়ই সওয়াব। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আরাফার দিনের রোযা সম্পর্কে আল্লাহর কাছে আশা করি যে তা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহর কাফফারা হিসাবে গ্রহণ করা হবে।’ (মুসলিম হাদীস নং:১১৬২, তিরমিজি হাদীস নং:৭৪৯)।
মহররম মাসের রোযা
রামাদ্বানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে আশুরার রোযা ফরয ছিল, রামাদ্বানের রোযা ফরয হওয়ার পর আশুরার রোযা রহিত হলো কিন্তু কিয়ামত পর্যন্ত সুন্নাত হিসাবে বাকী থাকবে।
মহররম মাসের ১০ তারিখে রোযা রাখাও তদরূপ বিশেষ সওয়াব। হাদীস শরীফে আছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘রামাদ্বান মাসের পর সর্বোত্তম রোযা হলো মহররমের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হলো তাহাজ্জুদের নামায ।’ (মুসলিম হাদীস নং:১১৬৩)।
হযরত আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, এক প্রশ্নের জবাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আশুরার এক দিনের রোযা বিগত এক বছরের গুনাহর কাফফারা হিসাবে গৃহীত হয়।’ (মুসলিম হাদীস নং:১১৬২)। উল্লেখ্য, আশুরার রোযা রাখার ক্ষেত্রে মহররম মাসের ১০ তারিখের রোযার সঙ্গে আগে বা পরে একটি রোযা মিলিয়ে রাখতে হবে। শুধু ১০ তারিখ রোযা রাখা মাকরূহ। (মুসলিম হাদীস নং:১১৩৪)
শাবান মাসের নফল রোযা
হযরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদ্বান শরীফের অভ্যর্থনা অনুসারে প্রায় পূর্ণ শা’বান মাসই রোযা রাখতেন, এবং এরশাদ করেছেন শা’বানের ১৫ তারিখের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত কর এবং দিনে রোযা রাখ, কারণ সে রাতে আল্লাহর দরবারে বান্দাগণের বিগত এক বছরের আমল সমূহ পেশ করা হয়। আমার আমলগুলি আমার রোযা রাখা অবস্থায় আল্লাহর দরবারে পেশ হওয়া আমি ভাল বোধ করি। তাছাড়া এক শা’বান হতে অন্য শা’বান পর্যন্ত যত লোক মারা যাবে, তাদের নাম মৃতগণের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হয়। হুজুরে পাক বলেন, আমার রোযা থাকাবস্থায় আমার নাম মৃত গণের তালিকা ভুক্ত হওয়া আমি পছন্দ করি। এ উদ্দেশ্যে প্রায় শা’বন মাসই আমি রোযা রাখি।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শাবান মাস ছাড়া অন্য মাসে এত অধিক পরিমাণে নফল রোযা পালন করতে দেখিনি।’ (বুখারি হাদীস নং:১৯৬৯, নাসায়ি হাদীস নং:২৩৫৪)। রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রজব মাস এলে বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিন (১৫ তারিখ) আসবে, তখন তোমরা রাতে ইবাদত করো এবং দিবসে রোযা রাখো। (বায়হাকি)।
আইয়ামে বিজের নফল রোযা
প্রত্যেক চাঁন্দের ১৩, ১৪ এবং ১৫ তারিখকে আইয়ামে বিজ (উজ্জ্বল জোস্না প্লাবিত তারিখ গুলো) বলে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং সর্বদা এই তিনটি রোযা রাখতেন । এ তিনটি রোযা আদায় করলে পূর্ণ বছর নফল রোযা আদায়ের সওয়াব লাভের কথা এসেছে। একটি নেক আমলের সওয়াব কমপক্ষে দশগুণ দেয়া হয়। তিন দিনের রোযার সওয়াব দশগুণ করলে ত্রিশ দিন হয়। যেমন আবু কাতাদা (রা.) হতে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে প্রত্যেক মাসে তিনটি রোযা ও এক রামাদ্বানের পর পরবর্তী রামাদ্বানে রোযা পালন পূর্ণ বছর রোযা পালনের সমান (মুসলিম হাদীস নং:১১৬২)। হযরত আবু জর গিফারি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে এভাবে বলেছেন : ‘হে আবু জর, যদি তুমি প্রতি মাসে তিন দিন রোযা পালন করতে চাও, তাহলে প্রতি চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে তা পালন করো।’ (তিরমিজি হাদীস নং:৭৬১)। এই রোযাকে সওমে আদম বা আদম (আ.)-এর রোযা বলা হয়। হযরত আদম আলাইহিস সাল্লাম ও মা হাওয়া আলাইহাস সাল্লাম দুনিয়ায় আসার পর প্রথম এই তিনটি রোযা পালন করেন; যার বদৌলতে তাঁরা আগের মতো জান্নাতি রূপ লাবণ্য ও উজ্জ্বল্য ফিরে পান এবং এই দিনগুলোতে চাঁদ পূর্ণ শশীতে পরিণত হয়, রাতভর পূর্ণিমার জ্যোত্স্নালোক বিকিরণ করে বলে এই নামকরণ করা হয়েছে।
সোমবার ও বৃহস্পতিবারের নফল রোযা
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক সোমবার ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখতেন । রাখার কারণ বর্ণনা করেছেন যে, উক্ত দু’দিন মানবের সাপ্তাহিক কার্যাবলী আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। আরও বলেন, এ দু’দিনে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাপ্রার্থী মুসলমানগণকে মাফ করে থাকেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। উম্মতকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে নবী (সা) বলেন, কাজেই আমি পছন্দ করি যখন আমার আমল পেশ করা হবে তখন আমি রোযা অবস্থায় থাকব।’ (নাসায়ী হাদীস নং:২৩৫৮ ও তিরমিজি হাদীস নং:৭৪৭।)
হযরত আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সোমবারে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন এ দিনে আমার জন্ম হয়েছে এবং এ দিনে আমাকে নবুওয়াত দেয়া হয়েছে বা আমার উপর কোরআন নাজিল শুরু হয়েছে (মুসলিম হাদীস নং:১১৬২)।
রামাদ্বান মাসের রোযা ও অন্যান্য রোযার নিয়তের তারতম্য
রোযার জন্য যেমন পানাহার পরিত্যাগ করা ফরয, তেমনি নিয়ত করা ও ফরয, কিন্ত মুখে পড়া ফরয নয়, শুধু মনে মনে চিন্তা করে নিয়ত করে যে, আমি আজ বা আগামীকল্য রোযা রাখব, তাতে রোযা হয়ে যাবে। যদি রাত থেকে রামাদ্বানের রোযার নিয়ত করে তবে ফরয আদায় হয়ে যাবে, এমন কি দিনের দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত রামাদ্বানের রোযা নির্দিষ্ট, মান্নাতের রোযা এবং নফল রোযার নিয়ত করা জাইয আছে। আর কাফফারা এবং অনির্দিষ্ট রোযার নিয়ত সুবহে সাদিক হওয়ার পর জাইয নেই। বরং এর পূর্বেই করতে হবে (মালাবুদ মিনহু, শামী)।
নফল রোযা পালন অবস্থায় যদি অতিথি আপ্যায়ন করাতে হয় বা আপ্যায়ন গ্রহণ করতে হয়, তাহলে নফল রোযা ছেড়ে দেওয়া জাইয আছে এবং পরবর্তী সময়ে এই রোযা কাযা আদায় করা ওয়াজিব হবে।
রোযা রাখার নিষিদ্ধ দিবসসমূহ
সারা বছরে মাত্র পাঁচ দিন রোযা রাখা হারাম। দু’ঈদে দু’দিন এবং বক্বরা ঈদের পরে ১১, ১২, ১৩ ই জিলহজ্ব। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরবানির ঈদের দিন ও রোযার ঈদের দিন রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম হাদীস নং:১১৩৮)। হযরত নুবায়শা হুজালি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আইয়ামে তাশরিক (জিলহজ মাসের ১১ থেকে ১৩ তারিখ) হলো খাওয়া, পান করা ও আল্লাহর নেয়ামতের শুকুর আদায় করার জন্য।’ (মুসলিম হাদীস নং:১১৪১, তিরমিজি হাদীস নং:৭৭৩)।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন শুধুমাত্র শুক্রবারকে বিশেষ করে রোযার জন্য খাছ করা ভাল নয়। শুক্রবারে রোযা রাখতে হলে এর পূর্বে বা পরে আরও একদিনের রোযা সংযোগ করবে (মুসলিম হাদীস নং:১১৪৪)।
প্রকাশ থাকে যে, এবাদত সমূহ হতে সামর্থানুযায়ী কিছু পরিমাণ এবাদত স্বীয় অব্যস্ত করে নিলে শয়তান মরদুদ সে ব্যক্তিকে অলসতা, অবহেলা, বা অমনোযোগিতার মধ্যে ফেলে কোনো প্রকার ছুতানাতার আড়ালে তাকে এবাদত হতে বঞ্চিত রাখতে সক্ষম হয় না। এ উদ্দেশ্যেই আল্লাহর অলীগণ নফল এবাদতের কিছু পরিমাণকে দৈনিক অজিফারূপে নির্দিষ্ট করে নেন, এবং ইহাকে আদায় করা এত জরূরী মনে করেন যেন কোন বিশেষ কারণে সময় মত আদায় করতে না পারলে উহাকে ক্বাজার ন্যায় অন্য সময় আদায় করে নেন। তাহলে শয়তান কর্তৃক অবহেলা, অমনোযোগিতা ও অলসতায় টেনে আনার ছিদ্রপথ বন্ধ থাকবে। যেমন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কারো তাহাজ্জুদ বা রাত্রের কোন অজিফা কোন দিন ছুটে গেলে দ্বি-প্রহরের পূর্বে আদায় করে নিবে।
আল্লাহ তা’আলা আমাদের নফল রোযা রাখার মাধ্যমে সারা বছর রোযা পালনের সওয়াব হাসিলের দ্বারা ইহকাল ও পরকালে সফলকাম হওয়ার তাওফিক দান করুন।হে করূণাময় আল্লাহ তা’আলা! আমাকে ও পাঠকবৃন্দকে বর্ণিত মাসআলা সমূহের উপর আমল করার তৌফিক দান করুন। (আমীন)!
লেখক: ইমাম এবং ইসলামী গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন