জেরুজালেম সুন্দর সুশোভিত প্রাচীন নগরী। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহুর শাসনামলে মুসলিমরা জেরুজালেমজয় করেন। পালাক্রমে পুরো ফিলিস্তিন শহর বিজিত হয়। এর বহুকাল পর খ্রিষ্টান বাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিন আক্রান্ত হয়। ক্রুসেডারদের নির্মম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন মুসলিমদের হাত ছাড়া হয়ে যায়। সে যাত্রায় সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ফিলিস্তিন মুক্ত করেন। তারও অনেকদিন পর আবার জেরুজালেম খ্রিষ্টানদের দখলে চলে গেলে নাজিমুদ্দিন আইয়ুব রাহিমাহুল্লাহ জেরুজালেম মুক্ত করেন। তৎপরবর্তীকালে কুখ্যাত রক্ত খেকুর দল মঙ্গোল বাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিন আক্রান্ত হলে সাইফুদ্দিন কুতুজ ও রুকনুদ্দীন বাইবার্স র. ফিলিস্তিন হেফাজত করলেও তা পুণরায় খ্রিষ্টানদের দখলে চলে যায়। সর্বশেষ ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে খ্রিষ্টান বাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিন ইহুদিদের দখলে চলে যায়।
এরপর ত্রিশ বছর পর্যন্ত মুসলিমরা ইহুদিদের অস্তিত্বকেই স্বীকার করেনি বরং ইহুদিদেরকে চোরের দল বলে বিশেষায়িত করা হয়েছে। এর আরও কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর আরবের পূর্ববর্তী অস্বীকারকারীরাই দখলকৃত ভূমির ৭৮% এর উপর ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়। এটা ছিলো গাজা ও পশ্চিম তীর ব্যতিত ফিলিস্তিনের সম্পূর্ণ ভূমি। অতঃপর মূল দখলদারির ৭৮% ছাড়াও ইহুদিরা পশ্চিম তীর ও গাজার ৬০% ভূমির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে চলছে নতুন ধাপ,ইহুদিরা ফিলিস্তিন থেকে মুসলিমদের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। খোদ রমজান মাসেও ইহুদি স¤প্রদায় ফিলিস্তিনিদের উপর দখলদারিত্বের হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের আজকের পরিস্থিতি যেন আন্দালুসিয়ার বাস্তব প্রতিচ্ছবি।মুসলমানদের ভূমি আন্দালুসিয়া দীর্ঘদিন যাবৎ মুসলমানদের শাসনামলে থাকার পর সর্বশেষ দুর্গ গ্রানাডা অঞ্চলে সংঘটিত প্রতিরোধ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর ১৪৯২ খ্রীস্টাব্দে মুসলিমরা আন্দালুসিয়া হারায়। কালক্রমে সেই আন্দালুসিয়া মুসলমানদের স্মৃতিপট থেকেই যেন হারিয়ে গেছে।মুসলমানগণ বর্তমানে স্পেন থেকে পর্যটন ভিসা নিয়ে আন্দালুসিয়ার কর্ডোভা মসজিদে ভ্রমণে যায়।ফিলিস্তিনের ব্যাপারটাও আজ সেদিকেই যাচ্ছে। ফিলিস্তিনরা প্রতিনিয়ত নির্মম নির্যাতনের স্বীকার হলেও বিশ্ব মুসলমানের টনক নড়ছে না। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় আমাদেরকে ইসরায়েলের ভিসা নিয়ে আল-আকসা ভ্রমনে যেতে হবে। ফিলিস্তিনের সমস্যাটা মুসলিম উম্মাহর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এই সংকট মুসলিম উম্মাহর আত্মমর্যাদার বিষয়। এই সংকট উত্তরণে মুসলিম উম্মাহর কতিপয় করণীয় দিক রয়েছে।
১. ফিলিস্তিন জাগরণ সৃষ্টি করা : ফিলিস্তিন ইস্যুটা যেন কখনোই স্তিমিত না হয় সেজন্যফিলিস্তিন ইস্যুটাকে সঠিকভাবে বুঝতে হবে এবং এব্যাপারে মুসলমানদের মাঝে চেতনা ও জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। ইজরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনে সংঘটিত হামলার দৃশ্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। এলক্ষ্যে নিজেদের আলাপনে,মসজিদের খুতবায়,সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে,সোশ্যাল মিডিয়া,প্রিন্ট মিডিয়ায় সরব থাকতে হবে। মুসলমানদের জাগিয়ে তুলতে নতুন নতুন মাধ্যম আবিষ্কার করতে হবে। যেমন,গল্প-নাটক তৈরী,বাচ্চাদের মাঝে ফিলিস্তিন মুক্তি চেতনা সৃষ্টির জন্য ভিডিও গেম,ফিলিস্তিনের ইতিহাসের উপর রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজন করা যেতে পারে।
২. দৃঢ় প্রত্যয়ী হওয়া : মুসলমানদের অন্তর আজ মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম উম্মাহকে ঘুরে দাড়ানোর জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে হবে। মুসলমানরা কখনো শক্তি সামর্থ্যের কাছে পরাজয় বরণ করেনি বরং পরাজয় বরণ করেছে নিজেদের দূর্বলতার কাছে। তাই ফিলিস্তিন বিজয়ের জন্য মুসলমানদেরকে সকল দূর্বলতা কাটিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে দৃঢ় থাকতে হবে।
৩. অর্থের যোগান দেয়া : বর্তমানে ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আর্থিক সহায়তা। ভয়ংকর অর্থনৈতিক অবরোধ,কর্মহারা,ক্রসিং বন্ধ হওয়া,কৃষি জমি উজাড়, ঘরবাড়ি ধ্বংস,খাদ্য-বস্ত্র-অস্ত্রশস্ত্রের ঘাটতি,যুবকদের শাহাদাত বরণ,অসংখ্য নারী বিধবা হওয়ার ফলে তারা আজ দিশেহারা। সকল মুসলমান চাইলেই স্ব শরীরে জিহাদে অংশগ্রহণ করা সম্ভব না হলেও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে জিহাদে অংশগ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। আমাদেরকে আর্থিক সহায়তার নজির স্থাপনের মধ্য দিয়ে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতার প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,যে ব্যাক্তি আল্লাহর রাহে জিহাদকারী কোনো যোদ্ধাকে যুদ্ধসাজে সজ্জিত করে দিল,সেও যেন জিহাদ করলো (বুখারী-২৮৪৩)। ফিলিস্তিনের জন্য আজ এক টাকা দান আল্লাহর কাছে সাতশ টাকা দানের চেয়েও অধিক সমতূল্য হবে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন,হজ্জ ও জিহাদের ক্ষেত্রে এক দিরহামকে সাতশ গুণ বাড়িয়ে প্রতিদান দেয়া হবে।
৪. ইহুদিদের বয়কট করা : ফিলিস্তিন ইস্যুকে দাঁড় করিয়ে মুসলিম উম্মাহ ইহুদি স¤প্রদায় এবং তাদেরকে সাহায্য কারী পশ্চিমাদেরকে বয়কট করতে হবে। বয়কটের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষা বিষয়ক অনেক প্রভাব রয়েছে। পশ্চিমাদের উৎপাদিত পণ্যের সবচেয়ে বড় ভোক্তা হলো মুসলিম স¤প্রদায়। মুসলমানগণ সম্মিলিত ভাবে কাফেরদেরকে বয়কট করতে পারলে তাদের টনক নড়বে। বিশ্ব ভূখন্ডের প্রকৃতিক সম্পদের প্রায় ৭০ শতাংশ মুসলমানদের দখলে। তাই কাফেরদের বয়কট করার মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহ নিজেদের সম্পদের যথার্থ ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে হবে।
৫.উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্য সাধন : মুসলমানগণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে আজ দ্বিধা বিভক্ত। ফলশ্রæতিতে ফিলিস্তিনসহ সারা বিশ্বে মুসলমানগণ মার খাচ্ছে। ফিলিস্তিন ইস্যুকে কেন্দ্র করে মুসলিম রাষ্ট্র গুলো নিজেদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য স্থাপন করতে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে একটি দেহের ন্যয় তুলনা করেছেন। দেহের এক অঙ্গে আঘাত পেলে যেমনিভাবে পুরো দেহ আঘাত প্রাপ্ত হয় তেমনিভাবে মুসলমানদের যেকোনো সংকটেই পুরো উম্মাহকে জেগে উঠতে হবে।
৬. সম্মিলিত জিহাদ ঘোষণা : ইহুদী স¤প্রদায়কে আজ পুরো কাফের বাহিনী সহায়তা করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ নিজেদেরকে মানবাধিকার রক্ষা কবচ বলে ঘোষণা দিলেও তারা শুধুমাত্র খ্রিস্টান ও স্বজাতির পক্ষেই কাজ করছে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী। আজ ইহুদি স¤প্রদায়ের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া মানে পুরো কাফের স¤প্রদায়ের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। তাই মুসলিম উম্মাহকে আজ সম্মিলিত ভাবে জিহাদ ঘোষণা করতে হবে। আমরা অনেকে মনে করি,ফিলিস্তিনে জিহাদের দরজা খুলে গেলেই সবাই জিহাদে ঝাপিয়ে পড়বে এবং বিজয় ছিনিয়ে আনবে। বাস্তবে বিষয়টা অতো সোজা নয়,তাই প্রথমে মুসলিম উম্মাহকে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রস্তুত করত সম্মিলিত জিহাদ ঘোষণা করতে হবে।
৭. মাবুদের সাহায্য কামনা : কাফেরদের সাথে লড়াইয়ে মুসলমানদের একটি শক্তিশালী অস্ত্র হলো মাবুদের দরবারে দোয়া করা। আল কুরআন ও হাদিসে বিপদাপদ ও কঠিন পরিস্থিতিতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য অনেক দোয়া শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। সূরা ইউনুসের ৮৫-৮৬ নাস্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন, হে আমাদের রব,আপনি আমাদেরকে জালিম কওমের ফিতনার পাত্র বানাবেন না। আর আমাদেরকে আপনার অনুগ্রহে কাফির স¤প্রদায় থেকে নাজাত দিন। সূরা কাসাসের ২১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন, হে আমার রব,আপনি জালেম স¤প্রদায় থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন। হযরত আনাস থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে আল্লাহ, আপনিই আমার শক্তির উৎস ও সাহায্যকারী,আপনার সাহায্যেই আমি কৌশল অবলম্বন করি,আপনার সাহায্যেই বিজয়ী হই এবং আপনার সাহায্যেই যুদ্ধ করি ( আবু দাউদ-২৬৩২)। দোয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে, তাই সর্বত্র আল্লাহর নিটক দোয়া করতে হবে,বিশেষ করে সকল ফরজ নামাজ এবং রাত্রিকালীন নামাজে।
সবিশেষে উল্লেখ্য যে,বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ফিলিস্তিন অনেক বড় ব্যাপার। জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদের প্রথম কিবলা। আল-আকসা আমাদের আবেগের জায়গা। তাই মসজিদে আল-আকসাকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিন জয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ব জয়ের সীদ্ধান্ত নিতে হবে। এজন্য প্রতিটি মুহূর্তেই আমাদেরকে সরব ও সচেতন থাকতে হবে। মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহর জয় সুনিশ্চিত করুন, আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন