মাদক সেবন এবং ব্যবসা আর খুন-অপরাধ করোনাভাইরাস, লকডাউন কিছুই মানছে না। করোনা ঠেকাতে অনেক কিছু যখন কমে গেছে, নিয়ন্ত্রিত; তখনো অবাধে চলছে মাদকের ব্যবসা ও অপরাধকাণ্ড। লকডাউনের মধ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মাদক কারবারি ও সেবনকারীরা। দেশের অভিজাত এলাকা হয়ে পাড়া-মহল্লা ছাপিয়ে মাদকের ভয়াল থাবা শহর থেকে শুরু করে এখন গ্রামের ঘরে ঘরে। ভয়াল মাদকাসক্তি তারুণ্য, মেধা, বিবেক, লেখাপড়া, মনুষ্যত্ব সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। নষ্ট করে দিচ্ছে স্নেহ-মায়া, ভালোবাসা, পারিবারিক বন্ধন। এছাড়াও উঠতি বয়সীরা নেশাগ্রস্ত হয়ে গড়ে তুলছেন পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং। আর ওই গ্যাংয়ের সদস্যরা একে অপরকে খুন করছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। শুধু তাই নয়, মাদকের সর্বশেষ সংযোজন ভয়ঙ্কর এলএসডি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেও। ওই মাদক সেবন করে সম্প্রতি হাফিজুর রহমান নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুও হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, ইসলামী মূল্যবোধ শিক্ষা কমে যাওয়া, সামাজিক নীতিহিনতা, ন্যায়-বিচারহীনতা এবং অভিভাবক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি কমে যাওয়ায় এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান ইনকিলাবকে বলেন, কিশোর গ্যাং ও মাদকাসক্ত একে অপরের সাথে জড়িত। যে যে কারণে কিশোর গ্যাং করে সেইসব কারণেই মাদকাসক্ত হয় তরুণ-তরুণীরা। এছাড়া দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইনে বেশি সময় কাটাচ্ছে আমাদের সন্তানরা। তাই অনলাইনের মাধ্যমে গ্যাং তৈরি করছে। পরে তারা মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। তাই এ ধরনের অপরাধ থেকে আমাদের সন্তানকে বাঁচাতে হলে এখনই অভিভাবকদের মাস্টার প্ল্যান করা প্রয়োজন।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব শায়খুল হাদীস মাওলানা ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম ইনকিলাবকে বলেন, মাদক ও কিশোর অপরাধ একটা সমাজিক ব্যাধি। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দ্বীনি শিক্ষার প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে দ্বীনি শিক্ষা শুধু সেøাগানের মধ্যে রয়েছে। ইসলামী শিক্ষাকে বাস্তবে রূপান্তিত করে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর শনির আখড়া এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ছুরিকাঘাতে আরাফাত ইয়াসিন নামের এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ইয়াসিনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার কুতুবপুর গ্রামে। বাবার নাম আব্দুল আলীম। কদমতলীর পাটেরবাগ আল-আকসা মসজিদ সংলগ্ন এলাকার একটি বাসায় থাকতেন তারা।
নিহতের ভাই সোহেল বলেন, আমার ভাই একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করত। গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে শনির আখড়া আরএস শপিং কমপ্লেক্সের সামনে প্রিন্স, তানজিল, ডিব্বা শুভসহ ১৫ থেকে ২০ জন তাকে ঘিরে ধরে এবং এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে রাস্তায় ফেলে যায়। খবর পেয়ে আমরা গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসি। পরে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে হৃদরোগ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে আবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল সকাল পৌনে ৬টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
কদমতলী থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাতে কে বা কারা আরাফাত হোসেন নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাত করেছে। পুলিশের একটি টহল দল ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের সহযোগিতায় আরাফাতকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। গতকাল সকাল ছয়টার দিকে তার মৃত্যু হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কিশোর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে জড়িত অভিযোগে আমরা এখন পর্যন্ত মোট ৬ জনকে আটক করেছি। ওই ঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ ঘটনায় সাথে জড়িতরা নিয়মিত মাদক সেবন করতেন। আধিপত্য বিস্তার ও মাদক সেবনের জের ধরেই ওই খুনের ঘটনা ঘটেছে। শুধু শনির আখড়া এলাকায় নয়, রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় দিন দিন মাদকাসক্তের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। প্রভাবশালীরা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে বলে অনেক ভুক্তভোগীই এ বিষয়ে প্রতিকারও চাইতে পারেন না। এছাড়াও প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদকের সাথে জড়িত হচ্ছে। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থেকে নতুন নতুন মাদকও আসছে। মাদকের সর্বশেষ সংযোজন ভয়ঙ্কর এলএসডির (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড) সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। নেদারল্যান্ডস ও সুইডেন থেকে দেশে নিয়ে আসা এই মাদক ছড়িয়ে পড়েছে উচ্চবিত্তের মধ্যে। শুরু হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। হালে এই মাদক ছড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে। ওই মদক সেবন করে সম্প্রতি হাফিজুর রহমান নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তারা এলএসডির সন্ধান পেয়েছে। এলএসডি মাদক সেবনের পর তিনি নিজের গলায় দা চালিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলএসডি ড্রাগ মস্তিষ্কে এমন এক প্রভাব সৃষ্টি করে যা হ্যালুসিনেশনে (সম্মোহন) সাহায্য করে। বিভিন্ন রকম রং এবং আকৃতির জিনিস দেখতে পাওয়া যায়, যার অস্তিত্ব পৃথিবীতেই নেই। শুধু তাই নয়, সেবনকারীর মধ্যে নিজেকে অথবা অন্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে।
ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সারা দেশের মতো রাজধানীতে এখন মাদকের ছড়াছড়ি। এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে মাদক বেচাকেনা হয় না। উঠতি বয়সীদের পাশাপাশি স্কুল পড়ুয়ারাও এখন ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। লকডাউনের মধ্যে বাসা থেকে বাইরে এসে একত্র হয়ে সহপাঠীরা মিলেমিশে হেরোইন-ইয়াবা সেবন করছেন। রাজধানীতে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে গাঁজা, ইয়াবা, ইনজেকশন, হেরোইন, চোলাই মদসহ বিভিন্ন মাদক। এসব না পেলেও পাড়া-মহল্লার দোকানে অনায়াসে পাওয়া যায় উত্তেজক নেশাজাতীয় এনার্জি ড্রিংকস। সম্প্রতি মাদকবিরোধী অভিযানে ধীরগতি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপরা কমিয়ে দেয়ায় এমন অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন অনেকেই।
তবে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ইনকিলাবকে বলেন, গত বছরের তুলানায় এই বছর অনেক বেশি মাদক জব্দ করা হয়েছে। এসব অপরাধে জড়িতদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্তু মাদক কারবারিদের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হচ্ছে। তারা নতুন নতুন মাদক নিয়ে আসছে। তাই সেই অনুযায়ী আমরাও ব্যবস্থা নিচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আগে চাহিদা কমাতে হবে। আর চাহিদা কমাতে হলে আমাদের পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক সাথে কাজ করতে হবে। তাহলে মাদক নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে প্রভাবশালী লোকজন জড়িত। কেউ বেশি সংখ্যক ইয়াবা নিয়ে আটক হলেই ভিআইপি শ্রেণির প্রভাবশালীরা তাদের ছাড়িয়ে নিতে তদবির করে। রাজনৈতিক নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করছে মাদক বাণিজ্য। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে মহানগর, জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড এমনকি ইউনিট পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থক সরাসরি মাদক কেনাবেচা করছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের মেম্বার থেকে শুরু করে ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, কতিপয় জাতীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও মাদক কেনাবেচাসহ সরবরাহ কাজে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর কাওরান বাজার এলাকায় এক ব্যবসায়ী ইনকিলাবকে জানান, তার ছেলে এসএসসি পাস করার পর মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এলাকার সহকর্মীরাই ছেলেকে মাদকাসক্ত বানিয়েছে বলে ওই অবিভাবকের অভিযোগ। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তাই মাঝে মধ্যে বাসার বাইরে ঘুরতে যায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। এক পর্যয়ে সে মাদক সেবন শুরু করে।
পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার এলাকার এক বাড়িওয়ালা আক্ষেপ করে বলেন, আমার ছেলে ইয়াবা সেবন করে একথা শোনার পর আমি বিস্মিত। কারণ আমি নিজে কোনোদিন একটা সিগারেটে টান দেইনি। কিন্তু বাস্তবতা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আসলেই সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ঘরের চার দিকে যেভাবে প্রকাশ্যে ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি হচ্ছে তাতে নেশাগ্রস্ত ছেলেকে ঠেকানো খুবই কষ্টকর।
শুধু কাওরান বাজার ও পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার নয়, রাজধানীর প্রতিটি এলাকার চিত্র একইরকম। মিরপুর এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তার মেয়ে নেশাসক্ত হয়ে পড়েছে। কিভাবে হয়েছে তা তিনি জানেন না। তাই বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে সে নিয়মিত বাসা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে বলেও জানান তিনি। ওই অভিভাবক হতাশা প্রকাশ করে বলেন, বিষয়টা এতটাই স্পর্শকাতর যে, কাউকে বলতেও পারছি না। আবার নিজেও সহ্য করতে পারছি না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমার ঘর-সংসার সব তছনছ করে দিয়েছে আমার এই মেয়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকই এখন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শেষ করে ফেলছে। তাদের ধ্বংসের পাশাপাশি সমাজকেও কলুষিত করছে। মরণনেশা ইয়াবা ও নতুন নুতন মাদক এখন সারা দেশের আনাচে-কানাচে পাওয়া যায় বলে অনেকেই এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছু ত্রুটি বিচ্ছুতির কারণে অনেকেই অপ্রতাশিত ব্যবহার করে। এর নানা রকম কারণ হতে পারে। যেমন- কখনো মাদকের সেবন, কখনো বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা, কখনো পিতা-মাতার সঠিক দায়িত্ব পালন না করার সন্তান অপ্রত্যাশিত আচরণ করতে পারে। বিচ্যুতি আচরণ করাটা স্বাভাবিক জানিয়ে তিনি বলেন, ওই বিচ্যুতি কারণগুলো যখন অপরাধজনিত হয় তখন আমাদের মনে আতঙ্ক কাজ করে। সুতারং মূলধারায় ইসলাম ধর্ম, সমাজ, সাংস্কৃত চর্চা করলে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন