উপকূলে ৬৫দিনের মৎস্য অবরোধ শুরু ২০ মে থেকে। ৬৫দিনের মৎস্যনিধন নিষেধাজ্ঞায় প্রতি জেলে পরিবার ইতোমধ্যে সরকারি সহায়তা পেয়েছে ৫৬ কেজি করে শুধুমাত্র চাল। মাত্র ৮শ’ ৬০ গ্রাম চাল একটা জেলে পরিবারে একদিনের জন্য। যা গড়ে ৫সদস্যের জেলে পরিবারের জন্য নিতান্তই অপ্রতুল মনে করছেন জেলেরা। জলবায়ু পরিবর্তন, উপকূলে নোনাপানির আধিক্য, নিত্যনতুন ডুবোচরের বিস্তার, ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ডাকাত-জলদস্যুদের অপতৎপরতা, কাঙ্খিত মৎস্য আহরণ করতে না পারায় জেলেপরিবারগুলোতে দীর্ঘদিন যাবতই বিরাজমান অভাব-অনটন আর দৈন্যতার প্রকট ছাপ। আয়-রোজগারের বিকল্প কোন সুযোগ না থাকায় বিশ্বজুড়ে মহামারী করোনাভাইরাসজনিত লকডাউন ও বঙ্গোপসাগরে ৬৫দিনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধের কারণে বরগুনার জেলেপল্লীতে চলছে নিরব দুর্ভিক্ষ। ঋণ, ধার-দেনা ও দাদনের জালে আটকিয়ে বহু কষ্টে জীবনযাপন করছেন সমুদ্র উপকূলীয় জেলেসম্প্রদায়।
প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের সমুদ্রে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। দীর্ঘদিন যাবত বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় নোনাপানি বিদ্যমান থাকায় মৎস্যসংকটে অভাব অনটনে দিশেহারা জেলে পরিবারগুলো। খাদ্য সহায়তা হিসেবে জেলেদেও দেয়া হয়েছে চাল। মহামারি করোনার কারণে বিকল্প কোন কর্ম না থাকায় শুধু চাল নয়, চালের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তার দাবী করছেন জেলেরা। অসংখ্য জেলে এখনো নিবন্ধনের তালিকায় না আসায় বঞ্চিত হচ্ছে সরকারি সহায়তা থেকে। মানবেতর জীবনযাপন করছে সহায়তা বঞ্চিত জেলে পরিবারগুলো। ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন না ক্ষতিগ্রস্ত জেলে ও ট্রলার মালিকরা। বরাবরের মতো এবারও ট্রলার মালিক ও জেলেদের অভিযোগ ভারত ও বাংলাদেশে একই সময় নিষেধাজ্ঞা না থাকায় বিগত সময়ের মতো বাংলাদেশের জল সীমানায় ঢুকে মাছ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় জেলেরা।
৬৫ দিনের জন্য সমুদ্রে মৎস্য শিকার নিষেধাজ্ঞা থাকায় সাগর উপকূলীয় বরগুনার পাথরঘাটায় বলেশ্বর থেকে বিষখালী নদীর ভারানি খালের দুপাড়ে শত শত ট্রলার নোঙ্গর করে রাখা হয়েছে। সমুদ্রগামী জেলেরা হয়ে পড়েছে বেকার। মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রসাররোধে দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন, ৯৫% জেলের মাথায় ঋণের বোঝা, রোজগারে টানাপোড়েন, পরিবার-পরিজন নিয়ে সংসার চালানোর হতাশার ছাপ বিরাজ করছে জেলেদের চোখমুখে। জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত ধরা হয় ইলিশ মৌসুম হিসেবে কিন্তুু মৌসুমের অর্ধেক সময়ই আটকে যায় নিষেধাজ্ঞায়। ৬৫দিনের নিষেধাজ্ঞার সময় নিবন্ধিত জেলেদের দেয়া হয় মাত্র ৫৬ কেজি চাল। চালের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তার দাবি প্রান্তিক জেলেদের। বার্ধক্যে উপনীত জেলেদের দেয়া হচ্ছেনা খাদ্য সহায়তা। উপকূলীয় সমুদ্রগামী জেলে ও ট্রলার মালিকরা বলছেন, ‘৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার এদীর্ঘসময়ের জন্য সরকার থেকে প্রতি পরিবারের জন্য মাত্র ৫৬ কেজি চাল প্রদান করা হয়েছে। যা একটা জেলে পরিবারের জন্য খুবই অপ্রতুল। কোন আর্থিক সহায়তা না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছে জেলেরা।’ তারা আরো বলছেন, ‘ঋণ, দাদন, ধারদেনা ইত্যাদির প্রভাবে এ অবরোধ মানতে চাচ্ছে না উপকূলীয় এলাকার জেলেরা। ভারত-বাংলাদেশ একই সময়ে সমুদ্রে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা না থাকায় বাংলাদেেেশর জল সীমানায় ঢুকে মাছ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে।’
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার অর্ধশতাধিক জেলেপাড়ায় আট হাজার ২২৭টি জেলে পরিবারের ৩৭ হাজার ২২ জন সদস্য রয়েছে। এসময়ে উপকূলীয় এলাকার জেলেদের জন্য বিশেষ খাদ্য সহায়তার স্বল্প পরিমানের চাল প্রদানের বিষয়টি খুবই অপ্রতুল বলে মনে করছেন জেলেরা। জেলেদের অধিকাংশের নিবন্ধন না থাকায় বঞ্চিত হচ্ছে সরকারি খাদ্য সহায়তা থেকে। দীর্ঘকর্মহীনতায় অনিবন্ধিত জেলেরা পরিবার- পরিজন নিয়ে কাটাচ্ছেন মানবেতর জীবন।
বিভিন্ন মৎস্য পল্লী সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপকূলীয় এলাকা সাগর ও নদ নদী ঘেষা জনপদের বেশি ভাগ পরিবার জেলে। সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় ইলিশ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের স্বার্থে জেলেরা নৌকা ডাঙ্গায় তুলে রেখেছেন। বিভিন্ন ঘাটে জেলেদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বরাদ্দকৃত চাল দিয়ে তিনবেলা কাটানো সম্ভব নয় বিধায় জেলেরা বাধ্য হয়ে নদীতে নামছেন মাছ শিকারে। এমন দুর্দশার সুযোগ নিয়ে কিছু সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী জেলেদের উৎসাহিত করছে সাগরে মাছ শিকার করতে। ফলে পরিবারের খাদ্যের যোগান দিতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গোপনে মৎস্য শিকারে যাচ্ছে অনেক জেলে।
স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ, ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে ইলিশ মাছ শিকার করে। তারা বাংলাদেশী পতাকা ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ মাছ শিকার করে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ইলিশ রক্ষার জন্য অবরোধ দিলেও ভারতীয় জেলেরা তা না মেনে ইলিশ শিকারে নেমে পড়েন।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় প্রতিজেলে সরকারি চাল পেয়েছেন ৫৬ কেজি। প্রাপ্ত এচাল দিয়ে একটা জেলে পরিবারের সংসার চালানো দুঃসাধ্যবিষয়। তিনি আর্থিক সহায়তারও জোর দাবী জানান। তিনি আরো বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ একই সময়ে সমুদ্রে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক।’ অনেক জেলে আসেনি এখনো নিবন্ধনের তালিকায়। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ট্রলার মালিক ও জেলেদের ঋণ সহায়তার দাবি জানান।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব জানান, বরগুনা জেলায় মোট নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ৩৬ হাজার ২২ জন। তার মধ্যে সমুদ্রগামী ২৭ হাজার ২ শ ৭৭ জেলে পাবে খাদ্য সহায়তা ৮৬ কেজি করে চাল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন