কোনো রকম গৌরচন্দ্রিকায় যাব না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিরা যে কেমন খোলাখুলিভাবে হস্তক্ষেপ করে তার একটি বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি। ২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে একটি খবর ছাপা হয়। খবরটির শিরোনাম ছিল, ‘আলোচিত ওয়ান ইলেভেন আজ।’ খবরে বলা হয়, আজ ১১ জানুয়ারি। ২০০৭ সালের এই দিনে ঘটেছিল বেসামরিক মোড়কে সামরিক সরকারের আবির্ভাব। দেশে জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। দেশি-বিদেশি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আগত সেই ঘটনা পরবর্তী সময়ে কলঙ্কিত ওয়ান ইলেভেন নামে পরিচিতি পায়। ইয়াজউদ্দিন, ফখরুদ্দিন, মইনুদ্দিনদের সেই সরকার ৩ মাসের স্থলে ২ বছর ক্ষমতায় থেকে নানা বিতর্কের জন্ম দেয়।
খবরে আরো বলা হয়, ওই দিন চারিদিকে ছিল নানা গুজব, গুঞ্জন। সাথে আতঙ্ক ও অনিশ্চিত অবস্থা। সার্বিক পরিস্থিতি ছিল থমথমে। এই অবস্থায় বিকাল ৪টার দিকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আমীর হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও কাজী জাফরুল্লাহ্ ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল যোগ দেন কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় এক বৈঠকে। কূটনীতিকদের মধ্যে বৈঠকে ছিলেন মর্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস্, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার ডগলাস ফসকেট, জাপানের রাষ্ট্রদূত ইনোওয়ে মাসাইয়েবি, ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত ড. স্টিফেন ফ্রোইন ও জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রেনাটা ডেসালিয়েন। বিকাল পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত বৈঠক শেষে অনেকটা হতাশ হয়ে বেরিয়ে আসেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে সাংবাদিকদের কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান তারা। কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসা থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা সরাসরি চলে যান দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সুধা সদনের বাসায়।
আওয়ামী লীগ নেতারা বের হওয়ার আধাঘণ্টা পর বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় কূটনীতিকদের সাথে বৈঠকে বসে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। এর নেতৃত্বে ছিলেন, বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। বৈঠক শেষে তারাও মুখ খোলেননি। সোজা চলে যান গুলশানের হাওয়া ভবনে। সেখানে তারা বৈঠক করেন দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। এর আগে দুপুর পৌনে ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের সঙ্গে তার বারিধারার বাসায় বৈঠক করেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী।
ওই দিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমদ এবং তার উপদেষ্টাবৃন্দ পদত্যাগ করেন। দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় এবং রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। বস্তুত: জোট সরকারের মেয়াদপূর্তির বেশ আগে থেকেই বিদেশি কূটনীতিকরা ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কয়েকজন কূটনীতিক সরাসরি ভূমিকা রাখেন ১১ জানুয়ারির ঘটনা পর্যন্ত।
দুই
২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি বিবিসি বাংলা একটি রিপোর্ট সম্প্রচার করে। রিপোর্টটি রচনা করেন কাদির কল্লোল। রিপোর্টের এক জায়গায় তিনি বলেন, দেশে জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে- এমন ধারণা পেলেও বিষয়টি নিয়ে ১১ জানুয়ারি (২০০৭) সারাদিনই নিশ্চিত হতে পারছিল না আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা।
সেদিন দুপুরে প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতের সাথে বৈঠক হয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের। সে বৈঠকটি হয়েছিল ঢাকাস্থ কানাডীয় হাইকমিশনারের বাসায়। সেখানে ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের পাশাপাশি আমেরিকার রাষ্ট্রদূত এবং ভারতের হাইকমিশনার উপস্থিত ছিলেন। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সে বৈঠকের বর্ণনা দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বিভিন্ন কথার এক পর্যায়ে তারা বলল, ‘এভাবে হলে তো দেশ চলতে পারে না। এভাবে হলে তো বিশৃঙ্খলা অরাজকতা বাড়বে। আপনারা দুই দল যদি সমঝোতায় না আসেন, তাহলে অন্যরকম ঘটনা ঘটতে পারে। ওনাদের কথায় মনে হলো, কী যেন একটি হচ্ছে। কারণ, ওনারা পজিটিভ কিছু বলছেন না। একদিকে রাস্তায় আওয়ামী লীগের আন্দোলন এবং অন্যদিকে বঙ্গভবনে সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা চলছিল। একই সাথে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকরা।
পর্দার অন্তরালে কী ঘটেছিল সে বিষয়ে অনেকটা অন্ধকারে ছিল সদ্য ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া দল বিএনপি। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ১০ জানুয়ারি গভীর রাত পর্যন্ত কুমিল্লায় নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন। তখন খালেদা জিয়ার সাথে ছিলেন বিএনপির সিনিয়র নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
মি. হোসেন বলেছিলেন, আমরা রাত ১টার সময় কুমিল্লা থেকে ঢাকা ফিরে আসি। ১১ তারিখ বিকেলের দিকে জানতে পারলাম যে, সেনাবাহিনী প্রধান প্রেসিডেন্ট ভবনে গিয়েছিলেন এবং সেখানে কিছু একটা হচ্ছে। জাতিসংঘের কিছু একটা চিঠি নিয়ে সেনাপ্রধান এবং নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্টকে দিয়ে জরুরি আইন ঘোষণা করাচ্ছেন।
২০০৯ সালে জেনারেল মইন ইউ আহমদের একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির নাম, ‘শান্তির স্বপ্নে : সময়ের স্মৃতি চারণ’। এই বইয়ে মি. আহমদ জরুরি অবস্থা জারির পেছনে রাজনৈতিক অবস্থার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এক সময় ক্ষমতাধর কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি আমার সাথে দেখা করে জানাল, সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে নির্বাচনে সেনাবাহিনী সহায়তা করলে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহারের জন্য তারা জাতিসংঘকে অনুরোধ জানাবে। প্রচ্ছন্ন এ হুমকির পরিণতি অনুধাবন করতে আমার অসুবিধা হলো না। জাতিসংঘের কর্মকান্ডের নিয়ন্ত্রক এসব দেশের অনুরোধ ও মতামত যে জাতিসংঘ অগ্রাহ্য করতে পারবে না তা বলাবাহুল্য। আমি এর পরিণাম চিন্তা করে শিউরে উঠলাম।’
ওপরে এতক্ষণ ধরে যে সব ঘটনাবলী বর্ণনা করা হলো সেসব থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশি হস্তক্ষেপ কত প্রবল ছিল।
তিন
বাংলাদেশের এক দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম, ‘জেনারেল মইনকে বিদায় করেছিলেন প্রণব’। বইয়ের এক স্থানে আছে, ‘ওয়ান ইলেভেনের সময় তিনি কাজ করেছেন। (এখানে তিনি বলতে ভারতের পরলোকগত প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জীকে বোঝানো হয়েছে।) সেই সময় আগরতলা সীমান্তে থাকতেন জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মীর্জা আজম। আলাউদ্দিন নাসিম ও তাদের কাছে শুনেছিলাম, প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার নিয়মিত কথা হতো। প্রণবদা শেখ রেহানাকে আশ্বস্ত করতেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই। তিনি সব দেখছেন। এই পুস্তক রচনার সময় লেখক বিপুলাংশে নির্ভর করেছেন প্রণব মুখার্জী রচিত পুস্তক, ‘দি কোয়ালিশন ইয়ার্স’ গ্রন্থের ওপর। আলাউদ্দিন নাসিম আর শামীম ওসমান বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ করেছিলেন প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে।
কোয়ালিশন ইয়ার্স (১৯৯৬-২০১২) গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, কোনো অবস্থায় জেনারেল মইনকে দিল্লিতে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে তিনি কী ভূমিকা রেখেছিলেন। কোনো পরিস্থিতিতে যোগাযোগ করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে। প্রণব মুখার্জী লিখেছেন, ‘২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমদ ছয় দিনের ভারত সফরে যান। এ সময় প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। আমি (প্রণব) জেনারেল মইনকে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির গুরুত্ব বোঝাই। তিনি এই ভয় পাচ্ছিলেন যে শেখ হাসিনা বের হয়ে আসার পর তাকে চাকরিচ্যুত করতে পারেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব নিই যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেও তাকে বহাল রাখার ব্যাপারে তাকে আশ্বস্থ করি।’
এ ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের সাথে তার আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, আমি খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়ের মুক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের সাক্ষাৎ চাই। তৎকালীন ভারতের জাতীয় উপদেষ্টা এম কে নারায়ণের মাধ্যমে আমার হস্তক্ষেপে আমি সব রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি এবং দেশটির স্থিতিশীল পরিস্থিতি প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছিলাম।
প্রণব মুখার্জী আরো লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা আমাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির মাধ্যমে ভারত তার দাবি পূরণে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনা কারাগারে থাকার সময় কিছু নেতা তাকে পরিত্যাগ করলে আমি তাদের ভর্ৎসনা করে বলি, কেউ যখন এমন বিপদে থাকে তখন তাকে ত্যাগ করা অনৈতিক।’
চার
এখন একটি ঘটনা বলে লেখাটি শেষ করব। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশি হস্তক্ষেপ সম্পর্কিত নয়। তবুও ‘ইনকিলাবের’ পাঠকদের অবগতির জন্য আলোচ্য পুস্তকের একটি অংশ তুলে দিচ্ছি। বইটির লেখক সম্পাদক লিখেছেন, ‘একবার নিউইয়র্কে দীর্ঘ আড্ডায় বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্য পুরুষ সিরাজুল আলম খানকে বলেছিলাম, দাদা আপনি লিখছেন না কেন? কোন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আপনারা নিউক্লিয়াস করলেন? মুজিব বাহিনী করলেন? স্বাধীনতার পর জাসদ করলেন- সব মানুষকে জানাতে হবে। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের দিন আপনি দিল্লিতে ছিলেন। ঢাকায় ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে আপনি একদিনের জন্যও আটক হননি। জরুরি অবস্থা জারির পর বঙ্গবন্ধু আপনাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘সিরাজ, তোকে ওরা বাঁচতে দেবে না, চলে যা।’ আপনি বাংলাদেশ ছাড়লেন। ইতিহাসের এই অজানাগুলো প্লিজ লিখুন। তিনি আমার কথার জবাব দেননি।’
এমনি অনেক কথা, অনেক ঘটনা আছে। যেগুলো আমরা জানি না। ইতিহাসকে সঠিক জায়গায় উপস্থাপনের জন্য যারা এগুলো জানেন, তাদের লেখা উচিত।
journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন