বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইনকিলাব বর্ষ শুরু সংখ্যা

গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে

আলমগীর মহিউদ্দিন | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০২১, ১২:১৩ এএম

একটু চমকেই উঠলাম, একজন পরিচিত ব্যবসায়ী তার গাড়িতে ‘প্রেস’ স্টিকার লাগিয়ে যাচ্ছেন। পরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কোনো সংবাদপত্র বা মাধ্যমে যোগদান করেছেন কি না। তিনি জানালেন, তার ভাগ্নের প্রেসের একটু শেয়ার তিনি কিনেছেন। ভাগ্নে পরামর্শ দিলো, এ স্টিকারটাকে জনগণ ও পুলিশ উভয়েই সম্মান দেয়। তাই সেও এ স্টিকার লাগিয়েছে। তিনিও লাগাচ্ছেন এবং উপকার পাচ্ছেন। শুনে আমার লজ্জাই লাগল। ড্রাইভারকে বললাম, আমাদের গাড়ির স্টিকারটা উঠিয়ে ফেলো। দরকার কী, আমাদের সব কাগজপত্র সঠিক আছে। কয়েক দিন পর পুলিশ গাড়ি থামাল এবং ড্রাইভারের কাছে কাগজপত্র চাইল। কাগজ ফেরত দিতে দিতে বলল, ‘আপনারা একটা প্রেস স্টিকার লাগান না কেন?’ পেছনে বসে কথাটি শুনতে পেয়ে সেই ঘটনা বললাম। তিনি বললেন, আমরা জানি। কিছু কিছু আমরা ডিটেক্টও করেছি। যারা জেনুইন, তাদের কোনো অসুবিধা নেই। যারা অবৈধ, এ কাজ করে, তাদের ধরতে সুবিধা হবে। পরে ভাবলাম, একদা এমন স্টিকার শুধু সাংবাদিকেরা লাগাতেন, বিশেষ কারণে। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায়, যেখানে পুলিশ অপারেশন করে, সেখানে। এমন পরিচিতি কাজে দেয় এবং পুলিশেরও সুবিধা হয়। এখন আইনজীবীরাও স্টিকার লাগাচ্ছেন। হয়তো বা ট্র্যাডিশন অনুসরণ করছেন। এমনটি কেন হচ্ছে? নিজেকেই প্রশ্ন করলাম। একটু পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, এ ঘটনাগুলো প্রায় সবই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের। ঘটনার জটিলতা ও সংখ্যাধিক্য এমন ব্যবস্থা নিতে হয়তো বা বাধ্য করেছে। তবে আইন ভঙ্গকারীরা সবচেয়ে সতর্ক পর্যবেক্ষক এবং তারা তাদের সুবিধার জন্য খুঁটিনাটি সব কিছুই ব্যবহার করে। স্টিকারের ব্যবহার এর মাঝে একটি অনুষঙ্গ। ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি যে এই প্রেস স্টিকার ব্যবহার করছেন, এটা অনৈতিক হলো না? তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘অন্যেরাও তো এটা ব্যবহার করছে। তবুও আমার ভাগ্নের একটা ছাপাখানা আছে। আর আমি তার অংশীদার। তা ছাড়া আমরা ইচ্ছে করলেই একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা কখনো না কখনো বের করতে পারি। এতে অনেক সুবিধা। এমন স্পষ্ট কথায় বিস্মিত হতেই হয়।

সাংবাদিকতা মানুষের কথা বলার জন্য। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের, যাদের দেখার কেউ নেই, পক্ষে বলার কেউ নেই। তাদের সত্যিটুকু তুলে ধরাই সত্যিকারের সাংবাদিকের আনন্দ। এর একটা সুবিধার দিক আছে, তা অবশ্য একজন বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী বা এমন মানুষের পক্ষে বোঝা অবশ্যই সহজ। অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, সাংবাদিকদের যুদ্ধ শুধু একটি বিষয়ে। তা হলো- ‘সত্য প্রকাশ’। ক্ষমতাবান মিথ্যাচারীরা কখনো এটা বরদাশত করতে পারে না। একে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এরা ক্ষমতায় থাকলে এ কর্মকান্ডে রাষ্ট্র রবাহূত জড়িয়ে পড়ে। সত্য স্তব্ধ করার পন্থা বহুমাত্রিক। বর্তমান যুগে এই মাত্রিকতা এত ভয়াবহ যে, সাংবাদিকতা থাকবে কি না তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। সারা বিশ্বেই তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের প্রচন্ড প্রচেষ্টা চলছে। দু’টি বিখ্যাত সংস্থা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের ওপর দৃষ্টি রাখে এবং প্রতি বছর কোন দেশ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটুকু ছাড় দেয় তার স্তর নির্ণয় করে। ফ্রিডম হাউজ ও রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস কয়েক বছর ধরে ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও নরওয়েকে এই ‘র‌্যাংকিংয়ে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রেখেছে। সংবাদমাধ্যম সেখানে সম্পূর্ণ স্বাধীন। সর্বনিম্নে হলো ইরিত্রিয়া। তার আগে তুর্কমেনিস্তান। দু’টি সংস্থাই মন্তব্য করেছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে সর্বাধিক দক্ষিণ এশিয়ায় এবং এই নিম্নমুখী ধস এখনো অব্যাহত। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কেন প্রয়োজন? জবাব দিয়েছেন মার্কিন সংবিধানরচয়িতা থমাস জেফারসন। ÔThe only security of all is in free press " অপর মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক Adlai E Stevenson বলেছেন, “The free press is the mother of all liberties and progress.” অর্থাৎ স্বাধীন সংবাদমাধ্যম মানুষের স্বাধীনতা, উন্নতি এবং সুন্দর জীবন নিশ্চিতকরণের প্রধানতম পথ। ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো তা প্রমাণ করেছে। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের জামাতা ডরষষরধস ঊ ইড়ৎধয বলেছেন, যদি কোনো দেশে সংবাদপত্র স্বাধীন না থাকে, তাহলে জনগণ কোন ধরনের সরকারের অধীনে বাস করছে, তার কোনো অর্থ নেই। কেননা সে তখন শুধুই প্রজা, নাগরিক নয়। প্রজার কোনো অধিকার থাকে না। অর্থাৎ স্বাধীন সংবাদপত্র না থাকলে জনগণের অধিকারও থাকে না। এ জন্যই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এখন অপরিহার্য। নিজের পরিপূর্ণ নিশ্চিত জীবনের জন্য একজন নাগরিকের প্রয়োজন সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা। তার চিন্তা-ভাবনার আদান-প্রদান। নিরঙ্কুশ করতে হলে তাকে সত্য তথ্য অবশ্যই জানতে হবে, যাতে সে সঠিক পথটি বেছে নিতে পারে। ক্ষমতালোভী শাসকেরা এ অবস্থাকে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যখনই দেখা যাবে সব সংবাদমাধ্যম একযোগে নানা অবয়বে ক্ষমতাসীনদের গুণগান করছে, আর সত্য প্রকাশকারী ক্ষুদ্র সংবাদমাধ্যমের অংশকে নানাভাবে নিন্দা করছে বা আন্দোলন করছে, তখনই বুঝতে হবে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ কতখানি প্রচন্ড। আসলে এ অবস্থায় সব চাকচিক্য সত্তে¡ও সাংবাদিকতা দুস্থ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সবাই সাংবাদিকতার সুবিধা সেই ব্যবসায়ীর মতো খুঁজতে ও ব্যবহার করতে চেষ্টা করে। আধুনিক বিশ্বে জনগণের জন্য সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আরো বেশি প্রয়োজন। কারণ, প্রযুক্তি মানুষকে এক নিঃসঙ্গ দ্বীপে স্থাপন করে থাকে। তার কোনো তথ্য বা যোগাযোগের প্রয়োজন শুধু প্রযুক্তিই পূরণ করছে। সে প্রযুক্তি বা যোগাযোগব্যবস্থা যদি স্বাধীন না থাকে বা কোন গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন সে নাগরিক অন্যের ইচ্ছার অধীনে চলে যায়। কারণ, তার পক্ষে তখন সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই নাগরিক তখন সেই তথ্য নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠীর ক্রীড়নকে পরিণত হয়। এর প্রতিচ্ছবি এখন বিশ্বব্যাপী বিরাজমান। তথ্যপ্রযুক্তিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বিশ্বব্যাপী। নতুন নতুন আইন এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। একমাত্র উদ্দেশ্য, প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংবাদমাধ্যম যেন তাদের নির্ধারিত তথ্যের বাইরে কোনো সত্য প্রকাশ করতে না পারে। ফ্রিডম হাউজ এবং রিপোর্টারস উইদাউট ফ্রন্টিয়ার বলেছে, গত এক দশকে সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণের চিত্র সবচেয়ে ভয়াবহ। তৃতীয় বিশ্বে এটা এখন চরমে। এক প্রতিবেদনে তারা দেখিয়েছে, বিশ্বের প্রতি সাতজনের একজন মাত্র স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের দেশে বাস করে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এত নিচু স্তরে আগে কখনোই পৌঁছেনি। বাংলাদেশ সম্পর্কে ফ্রিডম হাউজ বলেছে, যদিও দেশের সংবিধান স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে, কিন্তু নানাবিধ বাধানিষেধ ও আইনের দ্বারা সাংবাদিকেরা আবদ্ধ। তারা সরকারি কর্মচারী ও পুলিশের কর্মকান্ডের বিষয় নিয়ে লিখলে তাদের হয়রানিসহ জেলও হয়। এ ছাড়া সরকারি দলের সমর্থক ও অন্যান্য গোষ্ঠী সাংবাদিকদের নিয়মিত হয়রানি ও আক্রমণ করে। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোকে সরকারি চ্যানেলের খবর প্রচার করতে বাধ্য করা হয়। এমনিভাবে ভারতের বিষয়েও মন্তব্য করেছে। যদিও সে দেশের সংবাদমাধ্যম সাধারণত প্রাণবন্ত, কিন্তু কিছু এলাকায় যেমন কাশ্মির, ছত্তিশগড়, আসাম, মনিপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সংবাদমাধ্যম নানা চাপ ও আক্রমণের সম্মুখীন। সাংবাদিক নির্যাতন, এমনকি হত্যাও সাধারণ বিষয়। সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার অন্যতম প্রধান কারণ, জনগণ যেন সত্য না জানতে পারে এবং তা নিয়ে তাদের মাঝে যোগাযোগ ও মতামত গঠন না হয়। ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদেরা এবং গোষ্ঠী তাই সংবাদমাধ্যমের মালিকানাসহ নানা কৌশলে সংবাদকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। স্বৈরাচারী, গণবিরোধী ও মুনাফালোভীরা সব সময় ক্ষমতারোহণে ব্যস্ত থাকে। তাদের ক্ষমতারোহণে এবং যখন ক্ষমতা লাভ করে তখন সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়। এ জন্য তারা ক্ষমতায় থাকলে সর্বপ্রথম সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা আইন ও ছলনার আশ্রয় নেয়। তাদের আমলে সৎ ও সত্য অনুসন্ধানী সংবাদপত্রের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব। শুধু তাদের সমর্থক সংবাদপত্রই টিকে থাকে। এমন অবস্থা এখন বিশ্বের সর্বত্র বিরাজ করছে। এখানে একটি উদাহরণ দেয়া যায়। ওয়াশিংটন পোস্ট সত্য উদঘাটনকারী একটি বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম হিসেবে পরিচিত। একবার দেখা গেল মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদ পরিবেশনার ব্যাপারে নির্বাচনে প্রত্রিকাটি বিজয়ী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। নির্বাচনে যদিও পশ্চিমা সমর্থন ছিল। একজন গবেষক দেখিয়েছেন, ওয়াশিংটন পোস্ট দেখতে পেল, এ নির্বাচনে বিজয়ীদের অনুসরণ করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে আন্দোলন শুরু হতে চলেছে। এ আন্দোলন সফল হলে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা গোষ্ঠীর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হবে। তার সাথে তেলসম্পদ। তাই পোস্টের এই ভোল পাল্টানো। এ থেকে বলা যায়, স্বাধীন জনকল্যাণকামী সংবাদমাধ্যমকে শুধু শাসক, ক্ষমতালোভীরাই নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না, এ কর্মকান্ডে বহু সেবকও অন্তর্ভুক্ত। কারণ, তারা গোষ্ঠীভুক্ত। নিরপেক্ষ বিষয়োন্মুখ হওয়া তাদের পক্ষে কঠিন। সংবাদপত্র এবং সাংবাদিক উভয়ের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের জন্য এবং জনকল্যাণে একান্ত প্রয়োজন। অনেক কারণের মাঝে একটি কারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, যদি তথ্য স্বাধীনভাবে উপস্থাপন করা না যায় এবং তার ওপর মন্তব্য স্বাধীনভাবে আদান-প্রদান করা না যায়, তাহলে শাসকদের কর্মকান্ডের জবাবদিহিতা কখনোই থাকবে না। পার্লামেন্ট জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হলেও এখন বেশির ভাগ সময়ই গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। শুধু স্বাধীন সংবাদমাধ্যমই তাদের রাস টেনে ধরতে পারে। ফ্রিডম হাউজ ও রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডার একটি বিষয়ে একমত। তা হলো, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যদিও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া কাজ করছে, সেই সাথে স্বার্থবাদীরাও সজাগ ও তৎপর। জেফারসনের কথা ধরে বলা যায়, ‘ফ্রি প্রেসই কেবল দিতে পারে জনগণের সত্যিকারের নিরাপত্তা।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক নয়াদিগন্ত

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন