পলাশী যুদ্ধ ইতিহাসে মোড় পরিবর্তনকারী একটি ঘটনা। প্রথমত, এই যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী পরাজিত হওয়ার কারণে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা কার্যত পরাধীন হয়ে গিয়েছিল। যদিও এই যুদ্ধের একটি তাৎক্ষণিক ফল মীর জাফর আলী খানের নবাব হওয়া, কিন্তু নবাব হিসেবে তার কোনো নির্বাহী কর্তৃত্ব ছিল না। তিনি পরিণত হয়েছিলেন ক্লাইভ-জগৎ শেঠ গংয়ের ক্রীড়নকে। দ্বিতীয়ত, এই যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি একে একে ভারতের বাকি অংশ দখল করে নিয়ে বিরাট এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিল। অর্থাৎ এই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে কেবল পরাধীনতার নাগ-পাশে আবদ্ধ করেছিল তাই নয়, ভারতের বাকি অংশের পরাধীনতার দ্বারও উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয়ের মূলে ছিল ইংরেজ বণিক এবং জগৎ শেঠ, উর্মিচাদ, রায় দুর্লভ, রাজ বল্লভ প্রমুখ দেশীয় বণিকদের গভীর ষড়যন্ত্র। মীরজাফর ছিলেন তাদের শিখন্ডী মাত্র। এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনি আদৌ অবহিত ছিলেন না। নবাবী লাভই ছিল তার উদ্দেশ্য। কিন্তু পরে যখন তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, তিনি একটা পাতানো ফাঁদে পা রেখেছেন এবং বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাবী শাসনের অবসান অবশ্যম্ভাবী, তখন আসলে তার করার আর কিছুই ছিল না। শুধু তিনি নন, আরও অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, দেশ প্রকৃতপক্ষে পরাধীন হয়ে গেছে।
স্বভাবতই তখন স্বাধীনতার ব্যাপারে সচেতনতা জাগ্রত হয়েছিল বরং প্রধানত মুসলমানেরা পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু করেছিল। এই প্রস্তুতি পর্বে তারা লক্ষ করেছিল, দেশে হিন্দু সম্পদায়ের নেতৃবৃন্দ ও বিত্তবান লোকেরা। (এরা প্রধানত ছিল বর্ণহিন্দু) স্বাধীনতার ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নয়। বরং কোম্পানি শাসনকেই তারা স্বাগত জানাচ্ছে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বৃহত্তর হিন্দু স¤প্রদায় বৃটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ায় হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। তার মতে, এ-দেশে ব্রিটিশ শাসনের অর্থই ছিল হিন্দুর ছয়শ বছরের মুসলিম পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি। তাদের শান্তি ও সমৃদ্ধি, সম্পত্তি রক্ষা ও স্বাধীন ধর্মচারণের গ্যারান্টি। অর্থাৎ হিন্দুরা নবাবের পরাজয় তথা ইংরেজদের বিজয়কে নিজেদের বিজয় বলে মনে করেছিল।
মুসলমান শাসনের অবসানকে তারা পরাধীনতার অবসান বলে ধরে নিয়েছিল। তাই স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে কোনো উদ্যোগ নেয়া কিংবা মুসলমানদের উদ্যোগে সহযোগিতাদানের কোনো উৎসাহ তারা বোধ করেনি। বরঞ্চ তারা সর্বোতভাবে বহিরাগত শক্তিকে সাহায্য ও সমর্থন যুগিয়েছিল। ইংরেজদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে দাঁড়িয়ে মুসলমান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। বিনিময়ে ইংরেজদের উচ্ছিষ্ট ও সন্তুষ্টি লাভ করেছিল। তবে ব্যতিক্রম যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। তবে ব্যতিক্রম ব্যতিক্রম হিসেবেই বিবেচিত। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, হিন্দু ছাড়াও আর একটি জাতিগোষ্ঠির লোক ইংরেজ শাসনকে স্বাগত জানিয়েছিল। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ধর্মীয় জাতি পরিচয়ে তারা ছিল শিখ।
(দুই)
উপরের সাময়িক আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট হলো যে আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তিমূলে যেমন রয়েছে ইসলামী চেতনাবোধ, তেমনি আমাদের স্বাধীনতার রক্ষা কবচেরও মুখ্য উপাদান হচ্ছে ইসলাম। কার্যত মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা করতে হয়েছিল এবং ভারত থেকে ইংরেজ শাসন অবসানের শেষ লগ্ন পর্যন্ত একটানা তারা এই সংগ্রাম পরিচালনা করেছিল। তাদের যুগপৎ ইংরেজ ও হিন্দু-শিখ অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই সুদীর্ঘ ইতিহাসের প্রথম পর্ব ছিল সশস্ত্র এবং তার কালসীমা ছিল ১৯৫৭ থেকে ১৮৫৭ সালের মহাবিপ্লব পর্যন্ত।
ক. হল ওয়েলের মতে, ১৭৫৮ সালেই মীরজাফর ইংরেজ বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। ইংরেজ দমনে তিনি ডাচদের সাহায্য কামনা করেছিলেন। স্থির হয়েছিল, ডাচরা বাটাভিয়া থেকে সৈন্য পাঠাবে এবং সেই সৈন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু আদৌ চূড়ার ডাচ ঘাঁটির কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে মীর জাফরের বা তার প্রতিনিধির এ ধরনের কোনো সলা-পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত হয়েছিল কিনা তার কোনো বিবরণ আর কোনো লেখায় পাওয়া যায় না। এ কারণে অনেক ঐতিহাসিকই এ ঘটনাকে স্বীকার করতে চান না। তবে মীর জাফরের সেই সময়কার নাজুক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে তার পক্ষে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণের বাস্তবতাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। উল্লেখ করা যেতে পারে, তখন নবাবের বাহিনীতে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। তাছাড়া সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহও সংঘটিত হয়েছিল। সম্ভবত ঐ বছরই দিল্লীর সম্রাট শাহ আলমের বিহার আক্রমণ তার এ উদ্যোগে বাধা সৃষ্টি করেছিল এবং পরবর্তীতেও তিনি আর ঐ উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ পাননি।
খ. ১৭৬০ সালে মীর জাফরের জামাতা মীর কাশেম তার বদলে নবাবী লাভ করেন। মীর কাশেমের নবাবী লাভে ইংরেজদের একটা বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। তাদের ধারণা ছিল, মীর কাশেম মীর জাফর অপেক্ষা তাদের বেশি অনুগত থাকবে। কিন্তু আসলে মীর কাশেম ছিলেন স্বাধীনতার এক অমিততেজা সৈনিক। ইংরেজদের সাথে তার সখ্য ছিল লোক দেখানো। তিনি পরিষ্কার উপলব্ধি করেছিলেন যে, ইংরেজদের এখনই দমন না করতে পারলে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা যাবে না। প্রথমদিকে মেদিনীপুর, ঢাকা, রামগড় প্রভৃতি এলাকায় বিদ্রোহ এবং সম্রাট শাহ আলমের দ্বিতীয়বার বাংলা আক্রমণের প্রস্তুতি তাকে কিছুটা বিচলিত করলেও অচিরেই তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছিলেন। বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনে সৈন্যদের আধুনিক যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং বাহিনীকে আরো সুগঠিত করেছিলেন। তার এই রণ প্রস্তুতিই ইংরেজ বাহিনীর পাটনা আক্রমণের মূল কারণ। এরপরই ইংরেজ ও মীর কাশেমের বাহিনীর মধ্যে আরো কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এর মধ্যে বক্সারের যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এই যুদ্ধের আগে তিনি দিল্লীর সম্রাট শাহ আলম ও অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার সাথে চুক্তিতে উপনীত হয়েছিলেন। এই তিন পক্ষের সম্মিলিত বাহিনী বক্সারে ইংরেজ বাহিনীর মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই যুদ্ধেও মীর কাশেমের পরাজয় হয়েছিল। ইতিমধ্যে মীর জাফর ইংরেজদের বদান্যতায় দ্বিতীয়বার নবাবী লাভ করেন। পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন অংশে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংগঠিত করার কাজে মীর কাশেম নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন এবং শেষ পর্যন্ত উদরী রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশেমের পরাজয় ইতিহাসে আরো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার পরাজয় ছিল সেই সময়কার ইংরেজের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের পরাজয়। পলাশী যুদ্ধে ইংরেজরা বাংলায় প্রভুত্ব স্থাপনের যে সূচনা করেছিল বক্সারের যুদ্ধে সেই প্রভুত্ব হয়েছিল আরো সুসংহত। এই সাথে ভারত বিজয়ের সুযোগও বেড়ে গিয়েছিল। বক্সারের যুদ্ধ ছিল স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের একটা শক্তিশালী প্রয়াস।
গ. ১৭৬৩ সালে বাংলায় এক অভূতপূর্ব বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল। এই বিপ্লবের উদ্গাতা ছিলেন মজনুশাহ। ইতিহাসে তার এ বিপ্লবকে ‘ফকির বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তার মাদারী স¤প্রদায়ভুক্ত ফকিররা বাংলা থেকে বিহার পর্যন্ত বিপ্লবের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া এই বিপ্লবে নবাব সিরাজদ্দৌলাহর সৈন্যবাহিনীর বিতাড়িত সৈনিকরাও অংশগ্রহণ করেছিল। ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত এ বিপ্লব অব্যাহত ছিল। ফকির সেনাদল ১৭৬৩ সালে প্রথম ঢাকার সদরঘাট ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করে তাদের অগ্রাভিযানের সূচনা করেছিল। এই আক্রমণে কুঠির বণিকরা বুড়িগঙ্গা দিয়ে নৌকাযোগে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল। ১৭৬৬ সালে কুচবিহারের দিনহাটায় ফকির এবং সেই সাথে সন্ন্যাসীদের একটি মিলিত বাহিনী বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল ইংরেজ সেনাদল। ১৭৬৭ সালে বিহারের সাংরেসি জেলায় দু’টি যুদ্ধে ফকির বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়েছিল ব্রিটিশ ফৌজ। অনুরূপভাবে ফকির বাহিনী ১৭৬৯ সালে নেপাল সীমান্তের মোরাং অঞ্চলে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে নির্মূল করে দিয়েছিল ইংরেজদের এক বিশাল বাহিনী। ১৭৭২-৭৩ সালের দিকে রংপুরে ফকির বাহিনীর তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ সময় ফকির বাহিনী ইংরেজদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা ছাড়াও ইংরেজদের কুঠি ও জমিদারদের গোলা লুট করে নিরন্ন দরিদ্র মানুষের প্রাণ রক্ষায় এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। ১৭৭২ সালে ফকির বাহিনী রংপুরে যে হামলা চালিয়েছিল তাতে অংশ নিয়েছিল ৫০ হাজার ফকির সেনা। এই সময়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলে ফকির বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। মধুপুর ও ভাওয়ালের জঙ্গলে ছিল এদের আস্তানা। এরা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, জমিদাররা এদের খাজনা দিতে বাধ্য হয়েছিল। এছাড়া খুলনা, যশোর, ২৪ পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলেও ফকির বাহিনীর অভিযান বিস্তার লাভ করেছিল। মোট কথা, সমগ্র বাংলাদেশ ও বিহার ফকিরদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়েছিল। ১৭৮৬ সালে ফকির বিপ্লববের মহানায়ক মজনু শাহ ইন্তেকাল করলে এই বিপ্লবী তৎপরতায় ভাটার টান নেমে আসে, যদিও তার অনুসারীরা ১৮০০ সাল পর্যন্ত বিপ্লবের এই ঝান্ডা উডডীন রেখেছিলেন।
ঘ. ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মহীশুরের রাজা হায়দার আলী ও তার পুত্র টিপু সুলতানের অবদান ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। মহীশুরে হায়দার আলীর ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধিতে শংকিত হয়ে ১৭৬৬ সালে ইংরেজ, মারাঠা ও নিজামের বাহিনী একযোগে হায়দার আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। এই সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকা হায়দার আলীর বাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তিনি কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করে আত্মরক্ষা করেছিলেন। প্রথম তিনি অর্থের বিনিময়ে মারাঠাদের বশীভূত করেছিলেন এবং নিজামকে ইংরেজ মৈত্রীজোট থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। অতঃপর নিজামকে সাথে নিয়ে ইংরেজ বাহিনীর মোকাবিলা করেছিলেন ১৭৬৭ সালে। এই যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন এবং নিজাম পুনরায় ইংরেজ পক্ষে যোগদান করেছিলেন। পরে আর একবার মারাঠা-নিজাম ও হায়দার আলীর মৈত্রী গড়ে উঠেছিল এবং তাদের এই মিত্র বাহিনী আর্কটের যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। ১৭৮০ সালে হায়দার আলীর মৃত্যু হয় এবং তার সুযোগ্য পুত্র টিপু সুলতান রাজা হন। তিনিও তার পিতার মত ইংরেজবিরোধী সংগ্রাম ও যুদ্ধ আমৃত্যু অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৭৮৯ সালে টিপু সুলতান ইংরেজদের মিত্র রাজ্য ত্রিবাংকুর আক্রমণ করলে কর্নওয়ালিস মারাঠা ও নিজামের সাথে মৈত্রী সূত্রে আবদ্ধ হয়ে টিপুর বিরুদ্ধে স্বয়ং যুদ্ধে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। চতুর্থ মহীশুর যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধে (১৭৯০) শেষ পর্যন্ত টিপুর পরাজয় ও মৃত্যু হয়। পরে মারাঠা, নিজাম ও ইংরেজ-এই তিন পক্ষ মহীশুর রাজ্য নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়।
ঙ. আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটা বিরাট অধ্যায় জুড়ে আছে জিহাদ-আন্দোলন। সীমান্ত প্রদেশে মুসলমানদের ও শিখদের নির্যাতন এবং মুসলিম সমাজে নানারকম শিরক-বিদ’আতের বিস্তার সর্বোপরি ইংরেজ আগ্রাসন জিহাদ-আন্দোলন সংগঠনে প্রধান প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী। তার মৃত্যুর পর তারই পুত্র শাহ আবদুল আযীয দেহলবী আন্দোলনের একটি মজবুত ভিত্তি দাঁড় করিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য শিষ্য রায় বেরেলীর সৈয়দ আহমদ শহীদ সমগ্র ভারতে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ব্যাপকভাবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করে জিহাদের জন্য মুসলমানদের সংগঠিত করেছিলেন। এই বাংলাদেশের ও প্রায় এমন কোনো এলাকা ছিল না যেখানে জিহাদ আন্দোলনের বাণী না পৌঁছেছিল। বাংলার হাজার হাজার মানুষ জিহাদ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। জিহাদ আন্দোলনের কয়েকজন শীর্ষ নেতাও ছিলেন বাংলাদেশের। ইংরেজদের সাজানো মোকাদ্দমার নথিপত্র অনুযায়ী জিহাদ ঘোষিত হয়েছিল ১৮২৬ সালের ডিসম্বর। ১৮৩১ সালে বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহমদ শাহাদত বরণ করার আগ পর্যন্ত মুজাহিদ বাহিনী বহু যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। বালাকোট যুদ্ধের পর আরও কিছুদিন মুজাহিদদের তৎপরতা অব্যাহত ছিল। মুজাহিদরা ভারতের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এলাকাভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সিপাহী বিপ্লব সংগঠন এই মুজাহিদ নেতৃবৃন্দের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকজন জিহাদী নেতা সিপাহী বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
চ. জিহাদ আন্দোলনের সমকালেই বাংলাদেশে ফরায়েজী আন্দোলন নামে আরেকটি আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন হাজী শরীয়তউল্লাহ। প্রথমদিকে এ আন্দোলন ধর্মীয় ভাবধারা ও সংস্কারধর্মী হলেও পরবর্তীতে তা রাজনৈতিক রূপ লাভ করেছিল। ১৮২০ সালে এ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সংস্কারের বাণী পৌঁছানোর পাশাপাশি জমিদার, মহাজন ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষের গণপ্রতিরোধ। হাজী শরীয়তউল্লাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এ দেশ শত্রু কবলিত রাষ্ট্র। ইংরেজ ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অবৈধভাবে দেশ শাসন করছে। সুতরাং, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে দেশ স্বাধীন করা জনগণের একটি বৈধ অধিকার এবং এটি দেশবাসীর একটি পবিত্র দায়িত্ব।’ তিনি আরও ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘সমস্ত সম্পদ ও যমীর মালিকানা আল্লাহর।... যমীর ওপর মালিক সেজে কর ধার্য করাও সম্পূর্ণ অবৈধ।’ তার এই বৈপ্লবিক ঘোষণা সারাদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। হাজী শরীয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র মুহসিন উদ্দীন আহমদ দুদু মিয়া এ আন্দোলনের ঝান্ডা সিপাহী বিপ্লব পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মহাবিপ্লব শুরুর পরপরই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। এ সময় তার শরীর ভেঙ্গে গিয়েছিল। তিনি ১৮৬২ সালে ইন্তেকাল করেন।
ছ. ১৮৩১ সালে বাংলাদেশের ২৪ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরে এক বিরাট কৃষক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর। তিনি ছিলেন হাজী শরীয়তউল্লাহর সমসাময়িক। জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি এক বিরাট বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন এবং যুগপৎভাবে জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি নারিকেল বাড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন। এই কেল্লা থেকেই তিনি তার বাহিনী পরিচালনা করতেন। সংশ্লিষ্ট এলাকায় তার ক্ষমতা, প্রতাপ, সুনাম ও জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়েছিল যে, তিনি একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং এলাকার জনগণ তাকে বাদশাহ বলে অভিহিত করতেন। ১৮৩১ সালেই বিখ্যাত বাঁশের কেল্লার যুদ্ধে তিনি শাহাদত বরণ করেন এবং ধীরে ধীরে তার সূচিত জিহাদ স্তিমিত হয়ে যায়।
জ. পলাশী যুদ্ধের পর থেকে সিপাহী বিপ্লব পর্যন্ত আরও বহু সংগ্রাম, আন্দোলন ও লড়াই বিভিন্ন এলাকায় হয়েছিল। এ সবের কয়েকটিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ত্রিপুরায় স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শমসের গাজী, স›দ্বীপের বিপ্লবী আবু তোরাব, নোয়াখালীর লবণ চাষীদের নেতা নওয়াব আলী, রংপুরের কৃষক অভ্যুত্থানের নায়ক নূর উদ্দীন, বরিশালের সুবান্দিয়া বিপ্লবের সংগঠক বোলাকী শাহ। মোটকথা, মুসলমানদের শতাব্দীব্যাপী বিপ্লব, অভ্যুত্থান, আন্দোলন ও লড়াই ১৮৫৭ সালের বিপ্লবকে সম্ভব করে তুলেছিল এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বিপ্লবের বাণী সর্বত্র পৌঁছে দিতে অসাধারণ ভূমিকা ও অবদান রেখেছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অসাধারণ তাৎপর্যময় একটি ঘটনা। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে এটা ছিল প্রথম সর্বভারতীয় প্রচেষ্টা। এ প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর ফলে স্বাধীনতা সংগ্রাম জাতীয় স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এক নতুন ধারা ও প্রক্রিয়ার মধ্যে পরিণতির পথে অগ্রসর হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের ব্যর্থতা আরও একটা মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। বিপ্লব ব্যর্থ না হলে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটতো, একশ’ বছরের পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত হয়ে পুনরায় স্বাধীন-সার্বভৌম ভারতের অভ্যুদয় ঘটতো। এটাও চিহ্নিত হতো একটা বিরাট পট-পরিবর্তন হিসেবে। কিন্তু, বিপ্লব সফল না হলেও আরেক ধরনের বিরাট পটপরিবর্তন ঘটলো। এই পরিবর্তন পরবর্তীকালের স্বাধীনতা সংগ্রাম, আন্দোলন, রাজনীতি ও ঘটনাপ্রবাহের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। ১৮৫৭ সালের পর যে পরিবর্তনগুলো দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে উঠলো তার মধ্যে কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসন ক্ষমতা ব্রিটিশ রাজের হাতে চলে যাওয়া, হিন্দু জাতীয় চেতনার উত্থান এবং এর মুসলমানদের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ থেকে সরে আসার প্রেক্ষাপটে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের স্ব-সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপমহাদেশের পরবর্তী ইতিহাস এই পরিবর্তনগুলোর ওপর ভিত্তি করেই আবর্তিত ও গঠিত হয়েছে।
১৮৫৭ সালের পূর্ববর্তী একশ’ বছর ভারতীয় মুসলমানেরা স্বাধীনতা পুনঃরুদ্ধারের জন্যে যে সশস্ত্র লড়াই পরিচালনা করেছে তার পটভূমিতেই সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হয় সে কথা পা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সিপাহী বিপ্লবের সংগঠকও ছিল মুসলমানরা। ফলে স্বাভাবিক কারণেই বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের উপর অবর্ণনীয় নিপীড়ন ও নির্যাতন নেমে আসে। মুসলমান পরিচয়ই অপরাধের কারণ বলে বিবেচনা লাভ করে। হাজার হাজার মুসলমান সংগ্রামীকে হত্যা করা হয়, হাজার হাজার মুসলমানকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং বিচারের নামে প্রহসন করে তাদের দ্বীপান্তর বা বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। মুসলমানদের সম্পদ-সম্পত্তি লুণ্ঠন করা হয়। এই নিপীড়ন-নির্যাতনের কারণে অনেকে বনে-জঙ্গলে ও বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর আগে ১৭৬৩ সালে কোম্পানির দেওয়ানী গ্রহণ, ১৭৮৩ সালে দশসালা ও ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন, ১৮৩৭ সালে ফার্সির বদলে অফিস-আদালতে ইংরেজি ভাষার প্রচলন, ১৮৪৭ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট জারি ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিকভাবে মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করে নিম্নতম স্থানে নামিয়ে আনা হয়। সিপাহী বিপ্লবের পর যা বাকি ছিল, তা করা হয় অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক। মুসলমানরা যাতে আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা হয়। এই পর্যায়ে ভারতের শাসন কর্তৃত্ব হস্তান্তরিত হয়ে যায় ব্রিটিশ রাজের হাতে। এই হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে প্রথমত, কোম্পানিকে গণহত্যা, নিপীড়ন ও শোষণের অপরাধ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। দ্বিতীয়ত, ভারতে ইংরেজ অধিকারকে আরো পাকাপোক্ত ও মজবুত করা হয়।
(তিন)
সিপাহী বিপ্লবের পর মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয় কোন পর্যায়ে নেমে এসেছিল তার বিবরণ বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। সে বর্ণনা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি অমানবিক। --- মুসলিম জাতি ও সমাজ এক চরম প্রান্তিক অবস্থানে নেমে আচে। এই সম্পূর্ণ বৈরী অবস্থান ও পরিবেশে মুসলমানদের রক্ষা করা ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যবোধ জাগ্রত করার জন্য পরবর্তীতে কয়েকজন শিক্ষিত মুসলমান এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে নওয়াব আবদুল লতিফ, স্যার সৈয়দ আহমদ, সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মুসলমানদের আত্মমর্যাদা ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এরা তিনজন কয়েকটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এর মধ্যে নওয়াব আবদুল লতিফের ‘ক্যালকাটা মোহামেডান লিটারারী সোসাইটি’ (১৮৬৩), স্যার সৈয়দ আহমদের ‘গাজীপুর ট্রান্সলেশন সোসাইটি’ (১৮৬৪) পরে যা ‘আলিগড় সায়েন্টিফিক সোসাইটি’, তারও পরে যা ‘আলীগড় এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ’ নাম পরিগ্রহ করে এবং সৈয়দ আমীর আলীর ‘সেন্ট্রাল মোহামেডান এসোসিয়েশন’ (১৮৭৭) উল্লেখযােগ্য। ১৮৮৩ সালে এই তিনজন কোলকাতায় মিলিত হয়ে একটি কর্মকান্ডও গ্রহণ করেন। মুসলমানদের পক্ষে তারা বেশ কিছু দাবিদাওয়া সরকারের কাছে উপস্থাপন করেন, যা সরকার মেনে নেয়। এভাবেই ধীরে ধীরে নানা কার্যক্রম ও প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানদের একটি দল গড়ে ওঠে, যারা পরবর্তীতে জাতীয় জাগরণের বিস্তার ও প্রসারে ঐতিহাসিক অবদান রাখেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী জাগরণে বাবু বুদ্বিজীবী সমাজ, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও সাময়িকপত্রসমূহ বিরাট ভূমিকা পালন করে। এর প্রেক্ষাপটে শিক্ষিত মুসলমানরাও প্রায় একই উদ্দেশ্যে সাহিত্য চর্চা, সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র প্রকাশে এগিয়ে আসে এবং তারাও মুসলমান সমাজের মধ্যে একটা জাগরণের সূচনা করতে সমর্থ হয়। যারা এসব ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা ও অবদান রাখেন। তাদের মধ্যে মীর মোশাররফ হোসেন, ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, মুনশী মেহেরুল্লাহ, কায়কোবাদ, মোজাম্মেল হক, নজরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান প্রমুখ এবং সুধাকর ও মিহির গ্রুপের লেখকবৃন্দের নাম স্মরণ করা যেতে পারে। আরো স্মরণ করা যেতে পারে, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা আকরম খাঁ প্রমুখের কথাও। তবে মুসলমানদের সাহিত্য-সাংবাদিকতা এককভাবে ছিল মুসলমানদের জাগরণ ধর্মী। হিন্দুবিদ্বেষ তাদের মধ্যে ছিল না। এদের অনেকেই কেন, প্রায় সকলেই ছিলেন সমন্বয়ধর্মী। ক্ষেত্র বিশেষ তাদের বাধ্য হয়ে হিন্দুদের বিদ্বেষের জবাব দিতে হয়েছে মাত্র।
সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, সিপাহী বিপ্লবের পর যে পরিস্থিতি ও রাজনীতি শুরু হয় তারই পটভূমিতে নব্য হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের আবির্ভাব ঘটে। এর পাশাপাশি মুসলিম জাতীয়তাবাদীরাও সক্রিয় হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদ দুটি ধারাই বিভক্ত হয়ে যায়। গত শতাব্দীতে এই দুই জাতীয়তাবদী রাজনীতির ধারা বিকাশ ও পরিণতি লাভ করে। হিন্দু জাতীয়তাবাদ যেহেতু ইংরেজ তোষণ ও মুসলিমবিদ্বেষে পুষ্টি অর্জন করেছে, সুতরাং হিন্দু রাজনীতি বরাবরই মুসলিম স্বার্থের প্রতিপক্ষ হিসাবে কাজ করেছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগ ছিল মুসলমানদের দাবি ও স্বার্থের অনুক‚লে। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের স্বার্থ ছিল এই বঙ্গ বিভাগের মধ্যে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই মুসলমানরা এই বিভাগ সমর্থন করে। অন্যদিকে হিন্দুরা এর বিরোধিতায় আন্দোলনে নেমে পড়ে। কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গ রদে গোটা ভারতে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। এই সঙ্গে স্বদেশী ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনেও হিন্দুরা অবতীর্ণ হয়। কংগ্রেসী, স্বদেশী ও সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। ব্রিটিশ রাজ্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বঙ্গভঙ্গ রদ করা। যে ইংরেজদের অনুগত ও সহযোগী হিসাবে এতদিন তারা পরিচিত ছিল, ইংরেজের প্রতি সন্তুষ্টিচিত্ত ও কৃতজ্ঞ ছিল, সেই তারাই মুসলিমবিদ্বেষ ও কায়েমী স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় ও আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠে। মুসলমানদের জন্য এর ফল হয়েছিল নেতিবাচক। শাসক শ্রেণি এই আন্দোলনের মুখে নতিস্বীকার করে ১৯১১ সালে এক ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ রদ করে। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ভাগ্যোন্নয়ন ও অধিকার ভোগের যে সম্ভাবনা জাগ্রত হয়েছিল তার এভাবেই মৃত্যু ঘটে। বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে মুসলমানদের বিশেষত মুসলিম নেতৃবৃন্দের আশা ভঙ্গ হয়। নেতৃবৃন্দ আগেই সম্ভবত এ ধরনের আশংকা করেন যে, হিন্দুদের আন্দোলনের মুখে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যেতে পারে। এ কারণেই তারা মুসলমানদের জন্য পৃথক একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই অনুভবেরই ফল ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। ১৯০৬ সালে ঢাকায় এই রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণই ছিল এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে মুসলমানদের আশা ভঙ্গ হয় এবং তাদের উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এ কারণে তাদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভ ও সঞ্চারিত হয়, যার প্রকাশ ঘটে নেতৃবৃন্দের প্রতিবাদের মধ্যে। তাই বিক্ষুব্ধ মুসলমানদের শান্ত করার জন্য ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন বড় লাট ঢাকায় আসেন এবং ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেন। এতেও হিন্দু নেতৃবৃন্দ প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়ান। তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং যাতে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হয় তার জন্য পুনরায় আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি প্রদান করেন। এই নৈরাশ্যজনক পটভূমিতে ১৯১২ সালে মুসলিম লীগের পঞ্চম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলিকাতায়। সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে নওয়াব সলিমুল্লাহ মুসলমানদের শিক্ষা উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, ব্যবস্থাপক সভা ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে পৃথক নির্বাচন, চাকরিতে মুসলমানদের সংখ্যা সাম্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি দাবি জানান। এই সময় মুসলিম নেতাদের প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ করা। এ জন্য তারা প্রদেশগুলোর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন কেন্দ্রে ন্যূনতম ক্ষমতা এবং ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ও মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশগুলোতে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার দাবি জানাতে থাকেন। পক্ষান্তরে কংগ্রেস ও তার নেতৃবৃন্দ এসব দাবির বিরোধিতায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। কংগ্রেসে অনেক মুসলিম নেতা ছিলেন। তারা হিন্দু-মুসলিম মিলন ও ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষে সমভাবে উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কারণে তাদের প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এই পর্যায়ে তাদের অনেকের মধ্যে এই ধারণার জন্ম হয় যে, কংগ্রেস কখনই মুসলমানদের স্বার্থে আসবে না। ফলে তারা কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। যারা এভাবে মুসলিম লীগে যোগদান করেন তাদের মধ্যে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ অন্যতম। তিনি ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন। তিনি কংগ্রেসে হিন্দু-মুসলমান মিলনের অগ্রদূত হিসাবে পরিচিত ছিলেন। মুসলিম নেতৃবৃন্দ ভারতের শাসনতন্ত্রে মুসলমানদের রক্ষাকবচের ব্যাপারে সর্বদাই একটা মীমাংসায় আসতে প্রস্তুত ছিলেন। তাদের চেষ্টায় ১৯১৬ সালে লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা লক্ষ্মৌ চুক্তি নামে খ্যাত। লক্ষ্মৌ চুক্তিতে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস ভারতের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে, আইন পরিষদগুলোতে মুসলিমদের সংরক্ষিত আসনসহ স্বতন্ত্র নির্বাচন স্বীকৃত হয়। এই চুক্তির ফলে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমানের সম্মেলন ঘটে। লেখাফত ও অসহযোগ আন্দোলন এই চুক্তির প্রেক্ষাপটেই হয়। কিন্তু ১৯২৮ সাল নেহেরু কমিটির রিপোর্টে লক্ষ্মৌ চুক্তির বিষয়বস্তু অস্বীকৃত হলে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ভীত ধসে পড়ে। ওদিকে ১৯২৩ সালে জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলায় মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচন এবং শতকরা ৫৫ ভাগ চাকরি মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে যে চুক্তি বাংলার হিন্দু ও মুসলমান নেতৃবৃন্দের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় তা বেঙ্গল প্যাক্ট নামে পরিচিত, তাও মানতে কংগ্রেস অস্বীকতি জানায়। ফলে শেষ টোপ হিসাবে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯২৯ সালে কলিকাতায় একটি সর্বদলীয় সম্মেলন আহবান করেন। সম্মেলনে নেহরু রিপোর্টের কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব তিনি পেশ করেন, যা ঐতিহাসিক ১৪ দফা নামে পরিচিত। হিন্দু নেতৃবৃন্দ এই সংশোধনী মানতে অস্বীকৃতি জানান। ১৯৩০ সালে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা এবং কংগ্রেসের হাতে দেশের কর্তৃত্ব প্রদানের দাবি জানায়। এই বছরেই স্যার মুহম্মদ ইকবাল প্রথমবারের মতো ভারতে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি উত্থাপন করেন। অতঃপর ১৯৩৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক মুসলিম লীগের এক সম্মেলনে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ তার বহুল আলোচিত ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ পেশ করেন এবং বলেন: উপমহাদেশের মুসলমানরা একটি পৃথক জাতি। তাদের ধর্ম, সমাজ, কৃষ্টি সবই পৃথক। কাজেই, তাদের বাসভূমিও হবে পৃথক। এক রাষ্ট্র-কাঠামোর আওতায় হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান যে অসম্ভব, এ ধারণা হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যেই যখন প্রবল হয়ে উঠে, তখন অর্থাৎ ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি দাবি করে যে প্রস্তাব পেশ করেন, তা লাহোর প্রস্তাব নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। ঐ প্রস্তাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহ নিয়ে পৃথক পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এরপরও ইতিহাসে আমরা দেখি, ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগ ও তার নেতৃবৃন্দ অবিভক্ত ভারতের পক্ষে সমর্থন জ্ঞাপন করে গেছেন। ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান পেশ করা হয়। ঐ প্ল্যানে পৃথক পৃথক তিনটি ইউনিট গঠনের মাধ্যমে ভারতকে অবিভক্ত রাখার কথা বলা হয়। মুসলিম লীগ এ প্ল্যান সমর্থন করে কংগ্রেসও প্রথমে সমর্থন করে। কিন্তু পরে কংগ্রেস সভাপতি জওহর লাল নেহরু এমন এক বক্তব্য রাখেন, যাতে প্রতীয়মান হয়, প্ল্যানের ওপর থেকে কংগ্রেস তার পূর্ব সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। মুসলিম লীগ এরপর ঐ বছর ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করে। এইদিন কলিকাতায় হিন্দু স্বার্থচক্রের প্ররোচনা ও মদদে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ফলে হিন্দু ও মুসলমানের পৃথক পৃথক আবাসভূমি নির্ধারণ করে দেয়ার বিষয়টি অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটেই ব্রিটিশ রাজ ভারত ছেড়ে যাওয়ার সুবাদে ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন মোতাবেক ঐ বছরের আগস্ট মাসে পাকিস্তান ও ভারত নামের দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের অংশ হিসাবে তাই পূর্ব বঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) স্বাধীনতা লাভ করে।
(চার)
১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ১৯০ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আন্দোলনে সর্বোপরি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে পূর্ববঙ্গের মানুষ। কিন্তু পরিতাপের করা বিষয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের এই অংশের মানুষ শুরু থেকেই পশ্চিমা শাসক শ্রেণির বৈরী আচরণের সম্মুখীন হয়। প্রথমেই আঘাত আসে ভাষার ওপর, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ অংশের মানুষের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের বিভিন্নমুখী উপকরণ। উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার শাসক শ্রেণির জিদ এ অংশের মানুষের মধ্যে নতুন করে আত্ম আবিষ্কারের দ্বার উন্মোচিত করে। ১৯৪৮ সালেই এখানে শুরু হয়ে যায় ভাষার জন্য সংগ্রাম। এই সংগ্রামেরই একপর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য রক্ত ঝরে ঢাকার রাজপথে। মুক্তির জন্য শুরু হয় সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়। এর আগেই আওয়ামী মুসলিম লীগ নামের একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা হয় (১৯৪৯)। এই সংগঠন সরকারের অন্যায় আচরণ ও পদক্ষেপের বিরোধিতায় এবং এ অঞ্চলের মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণে তার ভূমিকাকে নিয়োজিত করে।
১৯৫৪ সালে শাসকগোষ্ঠি সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি ও কৃষক-শ্রমিক পার্টি একটি জোট গঠন করে, যার নাম যুক্তফ্রন্ট হিসাবে স্বীকৃত। যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার একটি নির্বাচনী অঙ্গীকার ঘোষণা করে, যার মধ্যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ও লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদানে অঙ্গীকার করা হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠারও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন