প্রাচীনকালে উপমহাদেশে সংবাদপত্র ছিল না, থাকার কথাও নয়। কিন্তু সংবাদ ও ধ্যান-ধারণার আদান-প্রদান ব্যতিত সমাজ চলতে পারে না। সুতরাং, বুঝতেই হয় সংবাদপত্র না থাকলেও সংবাদের আদান-প্রদান ছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দির ভারতীয় কূটনৈতিক দার্শনিক কৌটিল্য তার অর্থশাস্র গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সে কালে সমাজে বার্তাজীবী নামে একটি সম্প্রদায় ছিল: তারা সংবাদ আদান-প্রদান করত।’ এছাড়াও পর্যটক, ধর্ম প্রচারক ও ধর্মগুরুরা সংবাদ ও ধ্যান-ধারণার বিকাশ ও বিস্তারে সহায়ক হতেন।
মধ্যযুগ মুসলিম শাসনামল, ত্রয়োদশ শতাব্দির একেবারে গোড়ায় তুর্কি সুলতানগণ ভারত জয় করে শাসন করতে থাকেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুর্কিরা নানাবিধ উন্নত ব্যবস্থার প্রবর্তন করে: সংবাদ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে তারা ‘পেপিরাসে’ হাতে লেখা সংবাদপত্র প্রকাশ করতে থাকেন। পেপিরাস আমদানি করা হতো মিশর থেকে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে যারা দিল্লিতে সংবাদ পাঠাত তাদের বলা হতো ‘ওয়াকিয়া নবীস’ ও ‘খুবিয়া নবীস। মন্ত্রী মর্যাদার কর্মকর্তাগণ খবরগুলি যাচাই-বাছাই করে ফার্সি ভাষায় হাতে লিখে নিতেন। নির্দিষ্ট সময় পর সেগুলি দরবারের স্তম্ভে সেঁটে দেয়া হতো এবং অমাত্যদের মধ্যে বণ্টন করা হতো। তুর্কিদের হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা মুঘলদের হাতে যায়, তখনও হাতে লেখা ‘আখবার’ শুধু চালুই থাকেনি, নানাভাবে উন্নত হয়; মুঘল শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত এই চর্চা চালু থাকে। দিল্লিতে ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলে হাতে লেখা পেপিরাস সংবাদপত্রের যুগের অবসান হয়। সে সময় প্রাপ্ত সংবাদপত্রগুলি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ লন্ডনে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দেয়। সেগুলি এখনো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মেশিনে মুদ্রিত সংবাদপত্রের যুগ শুরু হয়। উপমহাদেশে প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র প্রকাশ করেন জেমস্ অগাস্টাস হিকি ‘বেঙ্গল গেজেট’ শিরোনামে, সংক্ষেপে একে বলা হতো হিকি’র গেজেট। সাহসী ও সত্যবাদী এই সাংবাদিককে কারাবরণ করতে হয়, জরিমানা দিতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে জবরদস্তি করে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ইতিহাস থেকে হিকিকে মুছে ফেলা যায়নি, ভারতে আধুনিক সাংবাদিকতার বীজ বপন করে যান তিনি।
১৭৮০ সালে হিকির গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে উপমহাদেশে আধুনিক ও মুদ্রিত সংবাদপত্র প্রকাশের যে ধারা শুরু হয়, সেটি নানা জনের হাত ধরে ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে, হয়েছে আধুনিকতর। বিশেষ করে খ্রিস্টান মিশনারীরা এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। শ্রীরামপুর মিশন থেকে ১৮১৮ সালে প্রথম বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। মিশনারীদের সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল মূলত ধর্মপ্রচার। ১৭৮০-১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে সংবাদপত্রগুলি মূলত কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় রাজধানী এবং শিল্প-সাহিত্য ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। বর্তমানে বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত ভূ-খন্ডটি তখন ছিল বঙ্গ প্রদেশের একটি অনুন্নত অংশ, যেখানে সাক্ষরতার হার ছিল অতি অল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল দুর্বল আর মুদ্রণের সুযোগ ছিল অনুপস্থিত। সে কারণেই পূর্ব বাংলায় সংবাদপত্র প্রকাশ শুরু হয়েছিল কিছুট দেরীতে। এ অঞ্চলে ১৮৪৭ সালে প্রথম প্রেস স্থাপন করা হয়েছিল রংপুরে। গুরুচরণ রায় সেই প্রেস থেকে প্রকাশ করেছিলেন, সাপ্তাহিক ‘রংপুর বার্তাবহ’। এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কুন্ডির জমিদার কালীচরণ রায় চৌধুরী। পত্রিকাটি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। আর ঢাকায় প্রথম প্রেস স্থাপিত হয়েছিল ১৮৪৮ সালে। ঢাকার প্রথম ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা নিউজ আলেকজান্ডার ফর্বেসের সম্পাদনায় বের হয় ১৮৫৬ সালে। পত্রিকাটি ১৩ বছর চালু ছিল। ১৮৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গ থেকে সাপ্তাহিক রংপুর দিকপ্রকাশ বের করেছিলেন জমিদার শম্ভুচরণ রায়চৌধুরী। সে সময় ঢাকা থেকে কবিতা কুসুমাবলী, মনপঞ্জিকা এবং বাংলা সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হয়। ঢাকার প্রথম বাংলা সংবাদপত্র সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ (১৮৬১) বের হয় বাবুবাজারের ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’ থেকে, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায়। এটি চলে ১০০ বছর। ১৮৬২ সালে রামচন্দ্র ভৌমিকের সম্পাদনায় বাংলা সাপ্তাহিক ঢাকাবার্তা প্রকাশিকা প্রকাশিত হয়। এটি অল্প কিছু দিন টিকে ছিল। ১৮৬৩ সালের জুলাই মাসে বাংলা সাপ্তাহিক ঢাকা দর্পণ প্রকাশিত হয় কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্রের সম্পাদনায়। ১৮৬৩ সালে কুষ্টিয়া থেকে কাঙাল হরিনাথ বের করেন গ্রামবার্তা প্রকাশিকা।
১৮৬৫ সালে গিরিশ্চন্দ্র রায় চৌধুরী ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক বিজ্ঞাপনী। একই বছর হরিশ্চন্দ্র মিত্রের সম্পাদনায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক হিন্দু হিতৈষীনি। এটি ১৮৮০ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। ১৮৬৮ সালে যশোর থেকে সাপ্তাহিক অমৃতবাজার পত্রিকা প্রকাশ করেন শিশির কুমার ঘোষ। ১২৭৬ বঙ্গাব্দে বরিশাল থেকে প্রথম পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বরিশাল বার্তাবহ নামের পত্রিকাটি ঠিক কতদিন টিকে ছিলে সেটি জানা যায়নি। ১৮৭১ সালে ঢাকা থেকে কালীনারায়ন রায় সম্পাদিত ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা ইস্ট ও কালীপ্রসন্ন ঘোষ সম্পাদিত শুভাষিনী প্রকাশিত হয়। একই বছর হিতকারী, সমাজ দর্পণ, দেশ হিতৈষীনি প্রকাশিত হয়। ১৮৭৪ সালে বরিশাল বানারীপাড়া থেকে শ্বেতপ্রকাশ, ১৮৭৫ সালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে সুহৃদ, নাটোর থেকে রাজশাহী সমাচার প্রকাশিত হয়। একই বছর ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক ঢাকা দর্শক প্রকাশিত হয়। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ইংরেজি অর্ধ-সাপ্তাহিক বেঙ্গল টাইমস।
১৯০০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় জাগরণ ও ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক তৎপরতার বছরগুলিতে বাংলাদেশ অঞ্চলে সংবাদপত্র শিল্প বিকাশের ভিত্তি প্রস্তুত হয়। এ সময়ে প্রকাশিত অধিকাংশই ছিল মতামতধর্মী, যেগুলির উপজীব্য ছিল সাহিত্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমস্যা, সংস্কার এবং ধর্ম। পূর্ববাংলার প্রথম দৈনিক পত্রিকা ছিল চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত জ্যোতি। এর প্রকাশ শুরু হয় ১৯২১ সালের ৫ আগস্ট। এরপর ১৯২৯-এ চালু হয় দৈনিক, ১৯৩০-এ দৈনিক রাষ্ট্রবার্তা, ১৯৩৬-এ দৈনিক আযান এবং ১৯৪৬-এ দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান।
ভারত বিভাগের পর পূর্ববাংলায় প্রথম যে দৈনিকের আবির্ভাব ঘটে তার নাম ছিল পয়গাম (সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী)। এটি ১৯৪৭ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। একই সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশনা শুরু করে জিন্দেগী নামক অর্ধ-সাপ্তাহিক। বাংলা সাপ্তাহিক খাদেম, ইনসাফ, আলোড়ন, ফরিয়াদ, কাফেলা, পাক্ষিক তাকবির, মাসিক সীমান্ত ইত্যাদি এ সময় প্রকাশিত হয়। মওলানা আকরম খাঁর কলকাতা-ভিত্তিক দৈনিক আজাদ-ও ঢাকাতে স্থানান্তরিত হয় এবং ১৯৪৮ সাল থেকে প্রকাশনা শুরু করে। একই বছর সিলেট থেকে সাপ্তাহিক নওবেলাল, কুমিল্লা থেকে সাপ্তাহিক তৌহিদ, পাক্ষিক নতুন আলো, ঢাকা থেকে পাক্ষিক নওরোজ প্রকাশিত হয়। ১৯৪৯ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় দ্য পাকিস্তান অবজারভার (স্বাধীনতার পর এটির নাম হয় বাংলাদেশ অবজারভার)। আরও দুটি সংবাদপত্র দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ যথাক্রমে ১৯৪৯ ও ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়। এগুলি এখনও বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে শীর্ষস্থানে আছে। পরবর্তী প্রকাশনাগুলির মধ্যে ছিল দৈনিক পাকিস্তান (পরে দৈনিক বাংলা), পূর্বদেশ এবং দ্য মর্নিং নিউজ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদপত্র পাকিস্তানিদের টার্গেটে পরিণত হয়। যুদ্ধের শুরুতে ২৫ মার্চের অপারেশনে পাকিস্তান বাহিনীর মর্টারের গোলায় তিনটি দৈনিক পত্রিকার প্রেস ও অফিস ধ্বংস হয়ে যায়। এগুলি হলো দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও দ্য পিপল। তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েও বিভিন্ন স্থান থেকে নতুন নতুন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যেমন বরিশাল থেকে অর্ধ সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, ত্রিপুরা থেকে সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, মুজিবনগর থেকে সাপ্তাহিক জয় বাংলা, ময়মনসিংহ থেকে সাপ্তাহিক জাগ্রত বাংলা, চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক ইসলামাবাদ, কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক স্বদেশ, কলকাতা থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কর্তৃক প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক নতুন বাংলা, বরিশাল থেকে বিপ্লবী বাংলাদেশ, ঢাকার নওয়াবগঞ্জ থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক মুক্তি, ঢাকা থেকে পাক্ষিক অগ্নিবাণ, মুজিবনগর থেকে সাপ্তাহিক মায়ের ডাক, মাসিক বাংলার মুখ, ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক স্বাধীন বাংলা ইত্যাদি।
লেখক: সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন