রাজা নেই, শাহী নেই রাজশাহী নাম। হাতিঘোড়া কিছু নেই, আছে শুধু আম। গানে-ছড়ায় এভাবেই রাজশাহীকে তুলে ধরা হয়েছে। রাজা বা শাহী না থাকলেও আম ঠিকই রয়েছে। এর নাম নিয়েও রয়েছে নানান কথা। রাজশাহী শহর পুন্ডুবর্ধনভুক্তি (মহাস্থানগড়) ও বরেন্দ্র অঞ্চলের অর্ন্তগত একটি জনপদ ছিল। বাংলায় মুসলমানদের আগমনকালে এটি মহাকালগড় নামে অভিহিত হতো। তের শতকের শেষের দিকে বাগদাদ থেকে আগত দরবেশ শাহমখদুম (রহ.) মহাকালগড়ের সামান্ত রাজাকে পরাজিত করে এ এলাকা দখল করেন। পদ্মাতীরেই তিনি সাথীদের নিয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচারে নিয়োজিত থাকেন। এই তাপসকে কেন্দ্র করে এখানে লোক সমাগম ও বসতি গড়ে ওঠে। ধারণা করা যায়, হযরত শাহমখদুম (রহ.) এর আগমনের পর থেকেই বর্তমান রাজশাহী শহর এলাকা বুয়ালিয়া নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। বুয়ালিয়া শব্দটি ফরাসি (বু) এবং আরবি আউলিয়া থেকে উৎসারিত, যার অর্থ আউলিয়াদের সুবাস। এই বুয়ালিয়া বা বোয়ালিয়া নামটি ১৭৬৪-৭৬ সালে জেমস রেনেল কর্তৃক প্রণীত বাংলা ভূমি ও নদনদী মানচিত্রে উল্লেখ্য রয়েছে। এখনও সদর থানার নাম বোয়ালিয়া। ইতিহাসবিদদের মতে, মুর্শিদকুলি খানের পূর্বে রাজশাহী নামটির কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, মুর্শিদকুলি খান সংস্কৃতি (রাজ) ও ফরাসি শাহ বা শাহী শব্দ যোগে একটি বিশাল এলাকার নাম করেছিলেন রাজশাহী। এ ধরনের নাম প্রবর্তনের উদাহরণ রয়েছে তার সময়কালে। কারো কারো অভিমত, এই জেলায় রাজা-জমিদারদের সংখ্যাধিক্যের জন্যই নাম হয়েছে রাজশাহী।
শত শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ রাজশাহী অঞ্চল প্রতিনিধিত্ব করছে বাংলার প্রাচীন ইতিহাস সংস্কৃতির এক বিশাল অংশকে। জনপদটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাল, সেন, গুপ্ত, কুষান, সুলতানী, মোঘল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিসহ বৃটিশ আমলের অজস্র ঐতিহাসিক ও প্রত্মতাত্তিক নিদর্শন। এলাকাটি গুপ্ত সস্রাজ্যের অর্ন্তভুক্ত একটি মন্ডলের অধীন ছিল। পরবর্তীকালে এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্মতাত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম আমলের বহু নিদর্শন, স্থাপনা ও দর্শনীয় স্থান রয়েছে। অনেক কীর্তিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেসব স্থানের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া প্রাচীন ইট, মৃতশিল্পের টুকরো জানান দেয় অতীত ইতিহাসের কথা। যেগুলো কোন রকমে কালের সাক্ষী হিসাবে টিকে রয়েছে তার মধ্যে হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সোনা মসজিদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এটি সুলতানী আমলের (১৪৯৩ হতে ১৫১৮) স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। সুলতান হুসেইন শাহ এ মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি ইট দিয়ে তৈরি হলেও বাইরের দেয়ালের পুরোটা এবং ভেতরের খানিকটা পাথর দিয়ে মোড়ানো। পাথরের উপর বৈশিষ্ট্যময় নকশা খোদিত রয়েছে। প্রবেশ পথের উপর দিকে একটা শিলালিপি রয়েছে, যাতে আরবীতে লেখা রয়েছে ইয়া আল্লাহ, ডান দিকে ইয়া হাবিব ও ইয়া রাহিম। ছোট সোনা মসজিদের গম্বুজের সংখ্যা পনেরটি। এর মধ্যে বারোটি অর্ধগোলক আকৃতির আর তিনটি চৌচালা ঘরের মতো। সুলতানী আমলের সব মসজিদে মেয়েদের নামাজ পড়ার জন্য আলাদা স্থান রাখা হতো, যা কিছুটা উঁচু ছিল। ছোট সোনা মসজিদেও এমন আলাদা স্থান দেখা যায়। সোনা মসজিদ নামকরণ প্রসঙ্গে ইতিহাসবেত্তারা জানান, এক সময় এর গম্বুজগুলো সোনা দিয়ে গিল্টি করা ছিল বলে নাম হয় সোনা মসজিদ। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরবর্তীতে তা সংস্কার করা হয়। মসজিদের পাশের ফাঁকা স্থানে স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সৈনিক বীর শ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের কবর রয়েছে। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ মসজিদ পরিদর্শন করে। ছোট সোনা মসজিদের পাঁচশো মিটার দূরে শায়িত রয়েছেন একজন বড় সুফী ও সাধক যার নাম হযরত শাহ নেয়ামত উল্লাহ। মাযারের বাইরের আঙ্গিনায় রয়েছে অনেক কবর। পাশে মসজিদ ও তাহাখানা। লম্বা এক বড় দিঘীর পাড়ে দ্বিতল বিশিষ্ট এই তাহাখানা। অস্তিত্ব অনেকটা বিলীন হলেও এখনো এক নজরে সহজে অনুমান করা যায় এক সময় ভবনটি বেশ দৃষ্টি নন্দন ছিল। সংস্কারের নামে এর গায়ের টেরাকোটাগুলো ঢেকে দিয়েছে পুরাকীর্তি বিভাগ। এ দৃষ্টি নন্দন ভবন, যা তাহাখানা নামে পরিচিত। ইতিহাসবেত্তাদের মতে, ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে স¤্রাট শাজাহানের পুত্র সুলতান শাহ সুজা গৌড় নগরী পরিত্যাক্ত হবার পর নিজের বসবাসের জন্য তৈরি করেছিলেন এ ভবন। ভিন্নমতে, শাহসুজা তার পীর শাহ নেয়ামত উল্লাহর জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন। সাথে তৈরি হয় মসজিদ আর পাশেই রয়েছে নেয়ামত উল্লাহর মাজার।
ছোট সোনা মসজিদের মাইল খানেক দূরে দিঘীর পাড়ে এক সুবিশাল মসজিদের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়, যা দরাসবাড়ি মসজিদ নামে পরিচিত। এখানে পরীক্ষামূলকভাবে খননকালে বড় এক মাদরাসা ভবনের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এটি ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামস উদ্দিন ইউসুফ শাহ নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। কাছেই রয়েছে রাজাবিবি মসজিদ। রয়েছে দৃষ্টিনন্দন খনিয়া দিঘী মসজিদ। চাঁপাইনবাবগঞ্জে শুধু মসজিদ-মাজার-মাদরাসা নয়, আরো অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রাচীন হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের বিরাট নগরীর অস্তিত্ব দেখা যায়। নওদাগ্রামে অনেক উঁচু ঢিবি দেখা যায়, এর মাঝে লুকিয়ে আছে অজানা অনেক ইতিহাস।
রাজশাহীর দরগাপাড়ায় শায়িত আছেন বাংলাদেশের অলিকুল শিরোমনি হযরত শাহ মখদুম (রহ.)। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, রামপুর বোয়ালিয়া (রাজশাহী নামকরণের পূর্বে) মহাকালগড় নামে পরিচিত ছিল, যা ছিল দেও উপাধীধারী তান্ত্রিক রাজার রাজধানী। দেবতাদের কৃপা লাভের জন্য সেখানে নরবলি দেয়া হতো। রাজা ও তার ভাইদের নিষ্ঠুর অত্যাচারে নিষ্পেষিত ছিল মহাকালগড়ের মানুষ। এই সময় বাগদাদ হতে হযরত তুরকান শাহ (রহ.) নামে এক সুফি সাধক কিছু অনুসারীসহ ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। মহাকালগড়ের নিপীড়িত জনগণকে অত্যাচারী রাজার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তার সঙ্গীদের নিয়ে দেও রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শাহাদত বরণ করেন, তিনি দরগাপাড়াতে শায়িত আছেন। ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দের এই ঘটনার রেশধরে তান্ত্রিক দেও রাজাকে শায়েস্তা করতে শাহ মখদুম আব্দুল কুদ্দুস রুপোস তার শিষ্যসহ সমুদ্র পথে নোয়াখালি পৌঁছান। এরপর নদীপথে রাজশাহীর বাঘায় আসেন। সেখান থেকে রামপুর বোয়ালিয়ায় এসে তান্ত্রিক দেও রাজাকে পরাজিত করেন। যুদ্ধে দেও রাজা নিহত হয়। শাহ মখদুম (রহ.) ইসলাম প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৩৩১ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। দরগাপাড়াতে তাকে সমাহিত করা হয়। প্রতিদিন তার মাযারে অসংখ্য ভক্ত আসে।
মুসলিম বিজয়ের পরে এ অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সুফি সাধক, ওলামা-মাশায়েখের আগমন ঘটে। এর মধ্যে শাহ মখদুম (রহ.) এর খ্যাতি ছিল সর্বত্র। সুফি সাধকদের হাত ধরে এ অঞ্চলে গড়ে ওঠে দরগা, মসজিদ-মাদরাসা। ছোট সোনা মসজিদ, দরাসবাড়ি মসজিদ, বাঘা মসজিদ, কুসম্বা মসজিদসহ অসংখ্য মসজিদ ও ইসলাম চর্চার কেন্দ্র, যাদের অনেকগুলো আজো স্বমহিমায় টিকে আছে। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক কিছু কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বাঘা মসজিদ বাংলাদেশের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম। রাজশাহী নগরী থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে সুলতান নশরত শাহ বাঘা নামকস্থানে একটি উচু টিলার উপরে ১৫২৩ খ্রি. দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করেন। সামনে রয়েছে বিশাল আকারের দিঘী। এখানে শায়িত আছেন হযরত মওলানা শাহ মোয়াযযেম উদ-দৌলা ওরফে শাহ দৌলা। অত্যন্ত বুজুর্গ ছিলেন তিনি। চৌদ্দশ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে পশ্চিম দেশ থেকে কজন সঙ্গী নিয়ে পদ্মাতীরে এক গভীর জঙ্গলে আস্তানা গাড়েন। এখানে অবাধ বিচরণ ছিল বাঘ ভাল্লুক অজগরসহ হিংস্র জীব-জন্তুর। বিশেষ করে, বাঘের অভয়ারন্য ছিল। ভয়ে মানুষ ওদিকে যেত না। কালক্রমে শাহ দৌলার কেরামতিতে জঙ্গল সাফ হয়ে ধীরে ধীরে বসতি গড়ে ওঠে। বাঘের আনাগোনা বেশি ছিল বলে এলাকার নাম হয় বাঘা। এই মহান সুফি সাধক ইসলাম প্রচারে ব্রতী হওয়া ছাড়াও ইসরামী শিক্ষাদানের জন্য গড়ে তোলেন বিশাল মাদরাসা। এটি উনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি পর্যন্ত টিকে ছিল। হযরত শাহদৌলার ইন্তেকালের পর তার বড় ছেলে মওলানা আব্দুল হামিদ দানিশমান্দ তার স্থলাভিষিক্ত হন। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মসজিদ চত্বরের উত্তরে শাহ দৌলা তার সঙ্গী, পুত্র দানিশমান্দ ও মাদরাসার অধ্যক্ষ মওলানা শের আলীসহ অনেকের কবর রয়েছে। প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মানুষ আসে মসজিদে নামাজ আদায় ও সুফি সাধকদের মাজার জিয়ারত করতে। বিশাল দিঘীও সবাইকে আকৃষ্ট করে। সম্প্রতি পুরাকৃতি বিভাগ একটি সংগ্রহশালা চালু করেছে।
বাঘার পর পুঠিয়ায় রয়েছে করম আলী শাহ (রহ.)-এর মাযার। তিনি হযরত শাহ মখদুম (রহ.)-এর সঙ্গে বাগদাদ থেকে বাংলায় আসেন। প্রথমে দিল্লী সেখান থেকে নোয়াখালির শ্যামপুর হয়ে বাঘার পাশে বিড়ালদহে এসে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেন। এখানেই জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত ইসলামের প্রচার প্রসারে কাজ করে গেছেন। রাজশাহী ঢাকা মহাসড়কের বিরলদহ নামক স্থানে সবুজ আম্রকাননের মাঝে শায়িত আছেন তিনি। পথ চলতে সবাই সম্মান জানায়। মাযারটি পরিদর্শন ও জেয়ারতের জন্য প্রতিদিন বহু মানুষের আগমন ঘটে।
রাজশাহী নগরী থেকে পঁচিশ মাইল উত্তরে কুসম্বা নামক গ্রামে রয়েছে কুসম্বা নামে এক ছোট্ট মসজিদ, যার ছবি পাঁচ টাকার নোটে দৃশ্যমান। ইটের তৈরি মসজিদটি ভেতর ও বাইরে পাথর দ্বারা মোড়ানো। পাশেই রয়েছে জলাশয়। মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহম্মুদ শাহ গাজির পুত্র সুলতান গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহের আমলে জনৈক সোলায়মান এটি নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে মসজিদটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মসজিদের নির্মাতা সোলায়মানের কথা বলা হলেও রাজশাহীর ইতিবৃত্তের লেখক প্রবীণ শিক্ষাবিদ কলামিস্ট এবনে গোলাম সামাদ তার রাজশাহীর ইতিবৃত্তে বলেছেন, মান্দা থানার এলাকায় নাকি জন্ম হয়েছিল রাজু ওরফে কালা পাহাড়ের। রাজু ছিলেন ভাদুড়ি পরিবারের সন্তান। যে কারণেই হোক, তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কুসম্বা মসজিদে এখনো গ্রামের মেয়েরা কালা পাহাড়ের নামে দুধ ঢেলে মানত করে থাকে। রাজু গৌড়ের আফগান সুলতান দাউদ করনীর সেনাপতি ছিলেন। রাজুর মুসলিম নাম ছিল মুহম্মদ ফমুলি। তিনি বিহারে আকবরের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ হয় তাতে যোগদান করেন এবং যুদ্ধে মারা যান। অনেকে বলেন, এদেশে কেবল নিম্ন বর্ণের মানষুই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ইতহাস এদের বক্তব্য সেভাবে সমর্থন করে না। রাজা গনেশের পুত্র যদু ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ভাদুড়ী ব্রামন রাজুও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, কুসম্বা মসজিদ যিনি বানিয়েছিলেন সেই জমিদার সবরখানও। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার গ্রন্থে সোলায়মান তথা চিলমান মজুমদার সর্ম্পকে জনপ্রবাদভিত্তিক যে কাহিনীর কথা বলা আছে তা খুব তথ্যনির্ভর নয় বলে উল্লেখ করেছেন। সোলায়মান খুব সম্ভব একজন প্রশাসক ছিলেন।
রাজশাহী অঞ্চলে শুধু মুসলিম স্থাপত্য নয়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের অনেক পুরাকীর্তি। বিদ্যোৎসাহী নরপতি ধর্মপাল দেবের নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ স্মৃতিসৌধ সোমপুর বিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার এ অঞ্চলে অবস্থিত। নওগা জেলার বদলগাছি উপজেলায় এটি অবস্থিত। চারিদিকে সমতল ভূমির মধ্যখানে একশো কুড়ি বিঘা জমি জুড়ে রয়েছে এ বিহার। উচ্চতা একত্রিশ মিটার। বহুকাল ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় মাটির নীচে থাকায় স্থানীয়রা একে পাহাড়পুর নামে চিহিৃত করে আসছিল। এটি ৭৭০-৮০১ খ্রি. মধ্যে নির্মিত হয়। এই বিহারটি বহুকাল ধরে জঙ্গলে ঢাকা ছিল। বিচরণক্ষেত্র ছিল চিতা বাঘসহ হিংস্র জীব-জন্তুর। পাহাড়পুর মন্দিরের গায়ে অনেক মূর্তি উৎকীর্ণ পোড়ামাটির ফলক আছে, যেখানে ফুটে উঠেছে সে সময়ের দৈনন্দিন জীবনের বিষয়বস্তু, মন্দিরের গায়ে ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় অনেক লৌকিক বিষয়। স্বল্প পরিসরে এ বৌদ্ধ বিহার সর্ম্পকে আলোচনা সম্ভব নয়। খননের পর এর কিছুটা পরিচ্ছন্ন রূপ প্রকাশ পেয়েছে। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে মিউজিয়াম। প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি পর্যটক এটি পরিদর্শন করে। আর শীতকালে ভিড় জমে পিকনিক পার্টির।
রাজশাহীর পুঠিয়ার পঞ্চরত্ন শিব মন্দির পর্যটকদের কাছে কম আকর্ষণের নয়। বাংলাদেশের বিশালকারের সুউচ্চ ও বহুগুচ্ছ চূড়া বিশিষ্ট শিব মন্দিরগুলোর মধ্যে এই মন্দিরটি স্থাপত্যশৈলীতে অনন্য। রাজা পিতাম্বর সপ্তদশ শতাব্দির প্রথম দিকে পুঠিয়ায় একাধিক সুদৃশ্য ভবন নির্মাণ ও জলাশয় খনন করেন। রানী ভুবনময়ী বিশাল এক জলাশয়ের সামনে ভুবনেশ্বর শিব মন্দির নির্মাণ করেন। এখানকার অন্যান্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে দোল মন্দির, গোবিন্দ মন্দির, শিব মন্দির, গোপাল মন্দির ও জগধাত্রী মন্দির। একই চত্বরে এমন মন্দির কমপ্লেক্স দেশের আর কোথাও গোচর হয় না। অযত্ন অবহেলা আর দখলবাজদের দখলে রাজবাড়ি জলাশয়সহ অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। কিছু অংশ পুরাকীর্তি বিভাগ দখলে নিয়েছে।
রাজশাহী শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার পশ্চিমে পদ্মানদীর তীরে খেতুর নামে এক গ্রামে বৈষ্ণব নরোত্তম ঠাকুরের জন্ম। তিনি বৃন্দবনে গিয়ে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। খেতুরে ফিরে আসেন। ১৫৮২ সালে এখানে চৈতন্য বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে বৈষ্ণব সম্মেলনের মধ্যদিয়ে স্থানটিকে তীর্থ কেন্দ্রে পরিণত করেন। নরোত্তম ঠাকুরের তিরোধান উপলক্ষে আশ্বিন মাসে মেলা বসে। তমাল তলার মন্দিরে প্রতিদিন ভক্ত ও পর্যটকরা আসেন।
রাজশাহী অঞ্চলের কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা নিয়ে কিছু আলোকপাত করা হলো। এর বাইরেও বহু পুরাতাত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নওগার আলতাদিঘা পর্যটকদের টানে। সাপাহারে ধীবর দিঘী নামে পুরানো এক জলাশয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে অখন্ড গ্রানাইট পাথরে তৈরি বিস্ময়কর এক স্তম্ভ। এ স্তম্ভ নিয়ে নানা কথা প্রচলিত রয়েছে। প্রাচীন বরেন্দ্রের ভূমির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তা সম্পূর্ণ নয়। অনেক জিনিস রয়ে গেছে আড়ালে। বিশেষ করে নওদা, দেওপাড়া বিজয়নগর মান্ডৈল, আচিনঘাট বিহারৈল, আমের, ঘাটনগর, ধানোয়া, আগ্রাদ্বিগুন নামকস্থানগুলোয় লুকিয়ে আছে প্রাচীন রহস্য।
রাজশাহীর বড়কুঠি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। সারদা পুলিশ একাডেমি কম দৃষ্টিনন্দন নয়। বরেন্দ্র যাদুঘর ও লাইব্রেরি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্তিক সংগ্রহশালা। বাংলার শিল্পকলার অপূর্ব সমাহারে সমৃদ্ধ সংগ্রহশালাটি। প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী, জ্ঞানাম্বেষী ও পর্যটক ভিড় জমান। এছাড়া আম ও রেশমের দেশ হিসাবে রয়েছে অন্য রকমের খ্যাতি। শুকনো মওসুমে মরা পদ্মার বিশাল বালিচরকে মরুদ্যান বানানোর প্রচেষ্টা আর বর্ষায় ভরা পদ্মার রূপ কাউকে আকর্ষণ না করে পারে না। আমের মওসুমে এলে লাখ লাখ গাছে কোটি কোটি আমের দুলনি স্বাগত জানায় ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে। ফেরার পথে নাটোরের রাজবাড়ির আকর্ষণও কম নয়। মোট কথা, রাজশাহী অঞ্চলের যে সকল প্রত্নসম্পদ ও ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে তা দেশি-বিদেশি ভ্রমণ পিপাসু মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম। নাটোরের বিল হালতি পরিচিতি লাভ করেছে মিনি কক্সবাজার হিসেবে। বর্ষাকালে প্রচুর মানুষ ভিড় জমায় পাটুল ঘাটে। ভেসে বেড়ায় বিশাল বিলে। এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। বাস, ট্রেন, বিমান সব পথেই আসা যাওয়া করা যায়। রয়েছে পর্যটকদের থাকার জন্য সর্বশ্রেণির মানুষের উপযোগী হোটেল, মোটেল ও খাবার রেস্তরাঁ।
লেখক: রাজশাহী ব্যুরো প্রধান, দৈনিক ইনকিলাব
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন