ইসলাম আগমনের পূর্বে এই পৃথিবী ছিল জুলুম, অত্যাচার, হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, মাদক ও সংঘাতেপূর্ণ এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী। কোথাও শান্তি ও নিরাপত্তার কোনো ছোঁয়া ছিল না। শান্তির পরশ পেতে মানুষ উদগ্রীব ছিল। এমন সময় আল্লাহ তায়ালা মানব মুক্তির দূত হিসেবে নবী করিম (সা.)কে আসমানি গ্রন্থ দিয়ে ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণ করলেন। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ মানবজাতির হেদায়াতগ্রন্থ। মানুষের করণীয়-বর্জনীয় সবকিছুই শরিয়তে বর্ণিত আছে। পৃথিবীকে শান্তিবান্ধব বসবাসযোগ্য করতে আল্লাহ তায়ালা নবী করিম (সা.)কে জাহেলি যুগের যাবতীয় আবর্জনা নিশ্চিহৃ করার আদেশ দিলেন। ঘোষণা করলেন, ‘তবে কি তারা জাহেলি যুগের ফয়সালা লাভ করতে চায়? যারা নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে, তাদের জন্য আল্লাহ অপেক্ষা উত্তম ফয়সালা দানকারী কে হতে পারে?’ (সুরা মায়েদা: ৫০)। আল্লাহর আদেশেই নবী (সা.) ইসলামপূর্ব অন্ধকার যুগের ইসলামবিরোধী সব রীতি-নীতি বাতিল করেছিলেন।
ইসলামপূর্ব যুগের কর্মকান্ডের ব্যাপারে ইসলাম দুই প্রকার অবস্থান গ্রহণ করেছে। কিছু রীতি ছিল মনগড়া ও অযৌক্তিক, জুলুম ও অনাচারের উপর প্রতিষ্ঠিত। ফলে যৌক্তিকভাবেই নবী (সা.) সেসব রীতি নিষিদ্ধ করেছেন। পক্ষান্তরে কতক রীতি-নীতি ছিল ন্যায়সঙ্গত ও মানবতার সমর্থক, সেগুলির প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন।
কিছু জাহেলি নীতি, যেগুলো ইসলাম পরিপূর্ণ বাতিল করেছে।
ক. সর্বপ্রকার শিকর ও কুফুরি কর্মকান্ড। আল্লাহ ব্যতীত অপর কাউকে ইবাদতযোগ্য ধারণা করা। জাহেলি যুগের মানুষেরা সর্বস্তরে অসংখ্য জীব-জড়কে ইবাদতযোগ্যে বলে আকিদা পোষণা করত। যদিও এই আকিদা সরাসরি কুফুর। কিন্তু প্রথা হিসেবে জনরণ্যে এসব কুফুরি আকিদা বিস্তার লাভ করেছিল। আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের ঘোষণা করে নবী (সা.) জাহেলি যুগের এসব ভ্রান্ত আকিদা বাতিল সাব্যস্ত করেছিলেন।
খ. জাহেলি যুগের মানুষেরা তারকারাজির নিকট বৃষ্টি প্রার্থণা করত। এই প্রথা ব্যাপকভাবে চালু ছিল। অথচ বিষয়টি বড় প্রকারের শিরক। এতে আল্লাহর স্থানে তারকাকে বসিয়ে দেয়া হয়। তারকাকে সৃষ্টিকর্তা ও দাতা হিসেবে মান্য করা হয়। অথচ বৃষ্টি দেয়া, না দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তায়ালারই। ফলে নবী (সা.) এই প্রথা ও মনোভাবকে বাতিল বলে ঘোষণা করেন।
গ. বংশ কৌলিন্য, রূপ-সৌন্দর্য ও গোঁড়া অহমিকা প্রদর্শন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘নিজ গৃহে অবস্থান কর, সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না, যেমন প্রাচীন জাহেলি যুগে প্রদর্শন করা হত’। (সুরা আহজাব: ৩৩) ‘কাফেররা যখন তাদের অন্তরে অহমিকাকে স্থান দিল- যা ছিল জাহেলি যুগের অহমিকা’। (সুরা ফাতহ: ২৬) আয়াত অবতীর্ণ হলে নবী (সা.) এসব কঠোরভাবে নিষেধ করেন।
ঘ. বংশে অপবাদ এবং মৃত ব্যক্তির জন্য কৃত্রিম কান্নাকাটি করা। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের ভেতর দুটি বিষয় এমন রয়েছে, যার মাধ্যমে মানুষেরা কুফুরে জড়িয়ে যায়। কারো বংশ সম্পর্কে অপবাদ আরোপ এবং মৃত ব্যক্তির জন্য কৃত্রিম কান্নাকাটি করা।’ হাদিস ব্যাখ্যাকারগণ লিখেছেন, এখানে কুফুরিতে জড়িয়ে যাওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য, এ স্বভাবদুটি ইসলামপূর্ব যুগের এবং কুফুরি প্রথা। ইসলামে বংশ সংরক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মৃত ব্যক্তির জন্য কান্নাকাটি করাও ইসলামে পরিপূর্ণ নিষিদ্ধ।
ঙ. জাহেলি যুগে গোত্রপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতি ছিল ন্যায়-অন্যায় প্রশ্নের উর্ধ্বে। স্বীয় গোত্রের লোকেরা অপরাধ করলেও তারা অপরাধী স্বজনের পক্ষাবলম্বন করত। এটাকেই ইসলাম ‘সাম্প্রদায়িক চরমপন্থা’ রূপে সাব্যস্ত করেছে। নবী (সা.) যেকোনো প্রকারের অন্যায় বংশপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতিকে শক্ত হাতে প্রতিহত করেছেন। বলেছেন, ‘হে মুসলমান সম্প্রদায়! আমি তোমাদের মাঝে জীবিত থাকাবস্থায় তোমরা জাহেলি যুগের আচরণ করছ?’ (ফাতহুল কাদির: ১/৫৪৮)
চ. কিছু বর্বর রীতি। যেমন: অচ্ছুৎ মনে করে কন্যাসন্তান জীবন্ত কবর দেয়া। অভাবের আশংকায় সন্তান জন্মদান না করা। ধোঁকাপূর্ণ লটারি ইত্যাদি। ইসলাম এসব সমূলে উৎখাত করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দারিদ্রের কারণে তোমরা নিজ সন্তানদেরকে হত্যা করো না।’ (সুরা আনআম: ১৫১)
ছ. জাহেলি কিছু দন্ডবিধি। যেমন: জাহেলি যুগে ক্ষমতাবানরা দূর্বলের উপর দ্বিগুণ দন্ড আরোপ করত, পক্ষান্তরে নিজেরা দূর্বলদেরকে দিত সামান্য। শক্তিশালীদের একজনের বিনিময়ে দূর্বলদের দশজনকে হত্যা করা হত, কিন্তু দূর্বলদের একজনের বিনিময়ে সবলদের একজনকেই হত্যা করা হত।
জ. জাহেলি যুগে ইলার (স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর সাথে সঙ্গম না করার শপথ) মেয়াদ ছিল এক-দুই বছর। ইসলাম এসে ইলার মেয়াদ ঘোষণা করে চার মাস। এরপর স্বামী স্ত্রীকে হয় বিবাহ করে কাফফরা দিবে। না হয় বাদশাহ তাকে তালাক বা ফায় দিতে বাধ্য করবে।
ঝ. চক্রাবৃদ্ধি হারে জাহেলি যুগের সুদখোররা সুধ খেত। ইসলাম এসে সর্বপ্রকার সুদকে নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ বিক্রিকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম।’ (সুরা বাকারা: ২৭৫)
ঞ. জাহেলি যুগে কুরাইশ ও তাদের সমমনা ‘হুমুস’রা নিজেদের মর্যাদা প্রদর্শন করতে হজের মৌসুমে মুজদালিফায় অবস্থান করত। আর অন্যদেরকে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে বাধ্য করত, মুজদালিফায় আসতে দিত না। ইসলাম এসে সবাইকে আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের নির্দেশ দিয়ে জাহেলি অন্যায় প্রথা বাতিল করে দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা সেই স্থান (সবাই একসাথে আরাফার ময়দানে অবস্থান করে সেখান) থেকেই রওয়ানা হবে, যেখান থেকে অন্যান্যরা রওয়ানা হয়।’ (সুরা বাকারা: ১৯৯)
উপরোক্ত বিষয়গুলিসহ জাহেলি যুগের আরো অনেক রীতি রয়েছে, লোকেরা যত উপকার আর কল্যাণ বর্ণনা করুক না কেন, শরিয়ত ও মানবস্বভাববিরোধী হওয়ার কারণে ইসলাম এসব নীতিসমূহকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। যেমন: মদপান, ব্যভিচার, চুরি। জুয়া, ধোঁকা ও জ্যোতিষবিদ্যা ইত্যাদি। এসব ইসলামে হারাম।
পাশাপাশি জাহেলি যুগের কিছু বিষয়কে ইসলাম গ্রহণ করেছে। মানুষকে এসবের উপর আমল করতে আহবান করেছে। যেমন: দয়া করা, দূর্বলের উপকার করা, মানবসেবা করা, ন্যায়ের পক্ষে বীরত্ব প্রদর্শন, রক্তপণ ইত্যাদি। ইসলাম আগমনের পূর্ব থেকে চলে আসা এসব কর্মকান্ডকে ইসলাম পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে।
লেখক: খতিব, আল মক্কা জামে মসজিদ হরপাড়া, শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন