আমাদের দেশেও হাতেগুণা কয়েটি মাদরাসায় এ পদ্ধতি গ্রহণ হয়েছে বলে আমরা জানি। এতে তারাও বেশ সুফল পাচ্ছে বলে আমাদের কাছে খবর আছে। আম্মাজান আয়েশা রা. হতে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে হঠকারী ও কঠোর আচরণকারীরুপে প্রেরণ করেননি, তিনি আমাকে কোমল ও সহজ আচরণকারী শিক্ষকরুপে প্রেরণ করেছেন। [মুসলিম, হাদীস: ১৪৭৮] উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম গাযালী রহ. বলেন, এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শিক্ষার্থীর ভুলগুলো যথাসম্ভব কোমলতা ও উদারতার সাথে সংশোধন করতে হবে এবং দয়া ও করুণার পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ধমক ভর্ৎসনার পথ এড়িয়ে চলতে হবে। [আররাসূলুল মুআল্লিম, পৃষ্ঠা: ১১] খতীবে বাগদাদী ইমাম আবু বকর আহমাদ ইবনে আলী রহ. ‘আল ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ’ নামক কিতাবে উস্তাদের আদব সম্পর্কিত আলোচনায় বলেন, ‘উস্তাদের উচিত, ভুলকারীর ভুলগুলো কোমল ও নরম ভাষায় বলে দেওয়া, কঠোর আচরণ ও রুক্ষ ভাষার মাধ্যমে নয়।’ [আল ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ: ২/২৮৪] খতীবে বাগাদাদী রহ. তাঁর এ বক্তবের স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরুপ অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে একটি হাদীস হলো, সাহাবী হযরত মুআবিয়া ইবনে হাকাম রা. বর্ণনা করেন, ‘একদিন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের পিছনে নামায আদায় করছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি নামাযের মধ্যে হাঁচি দিলো। [এবং আল হামদুলিল্লাহ বললো] প্রতি উত্তরে আমি জোরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বললাম। এটা শুনে মুসল্লাীগণ আমার দিকে তাকাতে লাগল। এ অবস্থা দেখে আমি বলে উঠলাম আপনাদের কি হয়েছে? আপনারা আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? তখন তারা তাদের উরুতে হাত চাপড়িয়ে আমাকে শান্ত ও চুপ থাকতে ইঙ্গিত করল। আমি চুপ হয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাম ফিরেয়ে নাময শেষ করলেন। আমার মা বাবা তাঁর উপর উৎসর্গ হোক। তার মতো এত উত্তম ও সুন্দর শিক্ষাদানকারী কোনো শিক্ষক তাঁর পূর্বেও কাউকে দেখিনি। তাঁর পরেও দেখিনি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে না প্রহার করলেন, না তিরস্কার করলেন, না ধমক দিলেন; তিনি বললেন, আমাদের এই নামায মানুষের কথাবার্তার উপযোগী নয়। অর্থাৎ নামাযে এ ধরনের কথা বলা যায় না; বরং নামায তো হলো, তাসবীহ, তাকবীর ও তেলাওয়াতে কুরআন।’ [মুসলিম, হাদীস: ৫৩৭; আবু দাউদ, হাদীস: ৯৩০] আল্লামা নববী রহ. শিক্ষকের আদাব সংক্রান্ত দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন, ‘শিক্ষকের উচিৎ, তার ছাত্রের সাথে কোমল ও নরম ব্যবহার করা, তার প্রতি সদয় হওয়া। তার কোনো ভুল হলে বা অসৌজন্যমূলক আচরণ প্রকাশ পেলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের বেলায়।’ তিনিও এ বিষয়ে অকেনগুলো হাদীস উল্লেখ করেছেন। একটি হাদীস হলো, সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রা.বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় মানুষ তোমাদের অনুসারী হবে। বিশে^র বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন তোমাদের নিকট দীন শিখতে আসবে। তারা আসলে তোমরা তাদের হিতাকাঙ্খী হবে এবং তাদের সদুপদেশ দিবে। [তিরমিযী, হাদীস: ২৬৫০; ইবনে মাজা, হাদীস: ২৪৯; আততিবয়ান:৫৬-৫৭] আমরা এমন দাবি করছি না যে, শিক্ষায়-দীক্ষায় কেবল আদর-সোহাগ ও কোমল আচরেণর দ্বারাই ষোলআনা সুফল পাওয়া যাবে। কারণ শয়তানের প্ররোচনা, পরিবেশ-পরিস্থিতি, প্রবৃত্তির তাড়না ইত্যাদির কারণে শিক্ষার্থী বিপথগামী হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কঠোরতা বা শাস্তিদানের প্রয়োজন হতে পারে। তবে শাস্তিদান বলতে যে কেবলই বেত্রাঘাতকে বুঝায় তা কিন্তু নয়। স্থান-কাল-পাত্রভেদে তা বিভিন্ন রকম হতে পারে। কারও সংশোধনের জন্য একটু চোখ রাঙানি বা সামান্য ধমকেই কাজ হয় আবার কারও জন্য প্রয়োজন হয় বেত্রাঘাত বা শারিরিক পীড়ন। কখন কার জন্য কোনটা প্রয়োজন তা বিবেচনায় না রাখলে উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। সাধারণ রীতি অনুযায়ী শুরুটা হওয়া দরকার লঘু শাস্তির দ্বারাই। বুঝানোতে কাজ না হলে চোখ রাঙানো বা ধমক প্রাথমিক ব্যবস্থা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিরষ্কারও ফলদায়ক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম কখনও সখনও এই ঔষধ সেবন করেছেন। কাউকে শোধরানোর একটি উত্তম ব্যবস্থা হলো কথা বন্ধ করে দেওয়া। শিক্ষক ও অভিভাবকের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও প্রেম-ভালবাসা যদি হৃদয় থেকে উধাও না হয়ে থাকে, তাহলে এ ব্যবস্থা কাজে আসবেই। অভিজ্ঞতা তাই বলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের জীবন চরিতে এই ঔষধ প্রয়োগের কথা পাওয়া যায়। তাবুক যুদ্ধে অংশ গ্রহণের ব্যাপারে কাব ইবনে মালিক রা., মুরারা ইবনে রবীআ রা. ও হেলাল ইবনে উমাইয়া রা. গড়িমসি করেছিলেন। তাঁদের ব্যাপারে এই কথা বন্ধের শাস্তিই প্রয়োগ করেছিলেন। এই ব্যবস্থা যাদুর মতো কাজ করেছিল। এই পরশমণির ঘর্ষণে তাঁরা পরিণত হয়েছিলেন খাঁটি সোনায়। যার বিস্তারিত বিবরণ কারও অজানা থাকার কথা নয়। যা হোক শিক্ষা-দীক্ষায় কথা বন্ধের শাস্তি একটি কর্যকরী ও ফলপ্রসু ব্যবস্থা। তবে এ ব্যাপারেও সতর্কতার দরকার আছে। সবকিছুই সীমার ভিতর রাখা উচিত। কথা বন্ধের পর সতর্ক পর্যবেক্ষণ জরুরী। কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তাও লক্ষ্য রাখতে হবে। বেশি কষতে গিয়ে রশিই যেন ছিঁড়ে না যায়, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। সর্বশেষ ব্যবস্থা হলো শারীরিক শাস্তি। সবচেয়ে বেশি সতর্কতা এ ক্ষেত্রেই দরকার। প্রথমেই বিবেচনা করতে হবে অপরাধটি শারীরিক শাস্তির উপযুক্ত কি না। বয়স বিচারও এ ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। শিশুসূলভ আচরণগুলো মাত্রারিক্ত না হলে শাস্তির আওতায় না আনায় বাঞ্চনীয়। এমনিতেই হৈহল্লা করা, ছোটাছুটি করা, খেলাধুলায় মেতে উঠা ইত্যাদি শিশুদের স্বভাবজাত বিষয়। শিশুর দেহ-মন বিকাশের জন্য এগুলোরও প্রয়োজন আছে। তাই বাড়াবড়ি পর্যায়ের না হলে শাস্তি দেওয়া তো নয়ই; বরং সর্বক্ষণ আবদ্ধ না রেখে নির্দিষ্ট সময়ে এগুলোরও সুযোগ দেওয়া উচিত। সারকথা শৈশবের স্বাভাবিক প্রবণতাগুলোকে উদার দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। নতুবা হিতে বিপরীত হতে পারে। শাস্তিদানের উপযুক্ত হলেও বয়স বিচার জরুরী। কারণ ১৫/১৬ বছরের বালকের যে শাস্তি হবে ৮/১০ শিশুর সে শাস্তি হবে না। শারীরিক শাস্তিদানকালে আত্মনিয়ন্ত্রন অপরিহার্য। রাগ দমন করে ঠান্ডা মাথায় শাস্তি দেওয়া উচিত। নতুবা সীমা লঙ্গনের আশঙ্কাই প্রবল। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা শিক্ষাদান কর, সহজ ও কোমল আচরণ কর; কঠোর আচরণ করো না। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। এ কথা তিনবার বললেন। [আহমাদ, হাদীস: ২৫৫৬, ২১৩৬; মুসনাদে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস: ২৫৮৮৮; মুসনাদে বাযযার, হাদীস: ১৫২, ১৫৩; মুসনাদে আবূ দাউদ তায়ালিসী, হাদীস: ২৬০৮; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস: ২৪৫] অন্য বর্ণনায় আছে- ‘তোমরা শিক্ষাদন কর এবং সহজ ও কোমল আচরণ কর’ এ কথা তিনবার বলেছেন। [আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস: ১৩২০] মার দেওয়ার ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন চেহারায় না লাগে। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা এসেছে। গায়ে যেন লাল-কালো দাগ না পড়ে যায় সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। লাঠি খুব মোটা ও ভারী হওয়াও উচিত নয়। আবার বেদম পেটাতে থাকাও বৈধ নয়। মোটামুটি কষ্ট পায় ও ভবিষ্যতের জন্য সর্তক হয়ে যায় এ পরিমাণ মারই যথেষ্ট। মারের আগে নিজেকেও বিচার করে দেখতে হবে, কেবলই গোস্বার কারণে মারা হচ্ছে, নাকি ইসলাহ ও সংশোধনের জন্য। কেবলই গোস্বার কারণে মারা হলে তা জায়িয হবে না। তাই মারার পূর্বে আত্মনিয়ন্ত্রন করে নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নিবে। অর্থাৎ শুধু ইসলাহ ও সংশোধনের জন্যই মারবে। খালিস নিয়তে মাত্রাজ্ঞানের সাথে প্রহার করলে তা অবশ্যই সুফল বয়ে আনবে। পক্ষান্তরে মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেললে লাভের পরিবর্তে ক্ষতির পাল্লাই ভারী হয়ে উঠবে। দুনিয়া-আখিরাত উভয় জাহানেই তা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে বৈ কি। রাষ্ট্রের পক্ষ হতে এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ কড়া বার্তা দেওয়া আছে। শিক্ষার্থীকে প্রহারের কারণে অনেক শিক্ষককে জেল-হাজতও খাটতে হয়েছে বলে পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। তাই এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা উচিত। এ দিকে এটা হুকুকুল ইবাদের অন্তর্ভুক্ত। তাই পরকালে এর জন্য জবাবাদিহি করতে হবে। এ ব্যাপারে মুফতী শফী রহ. বলেন, শিশুদেরকে প্রহার করা খুবই ভয়াবহ। অন্যান্য গুনাহ তো তওবার মাধ্যমে মাফ হতে পারে। কিন্তু শিশুদের উপর বাড়াবাড়ি হলে তার ক্ষমা পাওয়া খুবই জটিল। কারণ এটা হচ্ছে বান্দার হক। আর বান্দার হক শুধু তওবার দ্বারা মাফ হয় না। যে পর্যন্ত না যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে মাফ না করে। এ দিকে যার উপর বাড়াবাড়ি করা হয়েছে সে নাবালেগ। নাবালেগের ক্ষমা শরীআতের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এ জন্য এ অপরাধের মাফ পাওয়া খুবই জাটিল। তাই শিশুদেরকে প্রহার করা এবং তাদের সাথে দুব্যবহার করার ব্যাপারে সাবধান হওয়া উচিত। [ইসলাহী মাজালিস, মুফতী তাকী উসমানী] প্রকাশ থাকে যে, হালে শারীরিক শাস্তির ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর বাড়াবাড়ি হচ্ছে। অনেকেই মনে করে শারীরিক শাস্তি বা লাঠি ব্যবহার কিছুতেই উচিত নয়। এটা নিতান্তই ভুল ধারণা। প্রয়োজনস্থলে বেত ব্যবহার না করাও এক ধরনের শিথিলতা। এতে অন্যায়কারী প্রশ্রয় পায় এবং বেআদব ও স্পর্ধিত হয়ে উঠে। বস্তুত কোনোও ধরনের প্রান্তিকতা কল্যাণকর নয়। তাই বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির পথ পরিহার করে আমাদের হাটতে হবে মধ্য পন্থায়।
লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস ও মুফতী জামিয়া মিফতাহুল উলুম, নেত্রকোনা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন