শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বাড়ছে নৃশংসতা

রাজধানীতে এক মাসে ১৮ খুন সামাজিক-পারিবারিক-অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে অপরাধ বাড়ছে : অধ্যাপক ড. সালমা বেগম

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৪ জুন, ২০২১, ১২:০০ এএম

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দিন দিন বেড়েই চলছে ভয়ঙ্কর অপরাধ। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটানো হচ্ছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। দুর্বৃত্তের পাশাপাশি আপনজনরাও ঘটাচ্ছে অবিশ্বাস্য খুন-খারাবি। এমনকি এসব খুনের ঘটনার সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও জড়িত রয়েছেন। এছাড়াও স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে, মা খুন করছে সন্তানকে, ভাই খুন করছে ভাইকে, পিতা খুন করছে পুত্রকে। শুধু তাই নয়, এসব ঘটনায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের ঝনঝনানিও দেখা গেছে। খুনের পর পৈশাচিক কায়দায় লাশকে টুকরো টুকরোও করা হচ্ছে। আর কখনো কখনো গুলি করেও হত্যা করা হচ্ছে। বর্তমানে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। তাই সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্বই অধিকাংশ খুনের নেপথ্য কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রশ্ন হচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ এত নিষ্ঠুর হচ্ছে কেন?

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দিনের পর দিন অপরাধীদের মানসিকতা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে কাজ করছে রাজনৈতিক ও পারিবারিক প্রতিহিংসা। এছাড়াও ক্ষমতার লোভ, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়া, সম্পত্তির লোভ, হিংসা-প্রতিহিংসা, সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিক স্খলনের কারণে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণে নৃশংসতার চিত্র ফুটে ওঠে।

ডিএমপির তথ্যমতে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারের জারি করা বিধিনিষেধের মধ্যেই গত এক মাসে রাজধানীতে ১৮ খুন ও ৩৭ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের মে পর্যন্ত সারা দেশে ২৫৫ শিশু খুন হয়েছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ১০৭টি। খুন হওয়া শিশুর মধ্যে ৬০ জনের বয়স ছয় বছরের নিচে এবং সাত থেকে ১২ বছরের মধ্যে ৬৭ শিশু।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালমা বেগম ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের উচ্চাবিলাসী আচরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা ও পারিবারিবক শিক্ষার অভাবে অপরাধ দিন দিন বাড়ছে। এ বিষয়টিও খুব গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্র ও মহামারি মানুষের আচরণও এ জন্য দায়ী। দায়িত্বশীল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করলে সমাজে এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, দিন দিন সামাজিক মূলবোধ কমে যাচ্ছে। এ জন্য অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও দিন দিন মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। তাই কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

সর্বশেষ গতকাল কুষ্টিয়ায় দিনদুপুরে গুলি করে স্ত্রী ও সৎ ছেলেসহ তিন জনকে হত্যা করা হয় পৈশাচিকভাবে। আর ওই হত্যার অভিযোগ উঠেছে সৌমেন রায় নামে পুলিশের এক এএসআইয়ের বিরুদ্ধে। নিহতরা হলেনÑ কুমারখালী উপজেলার সাওতা গ্রামের বাসিন্দা মেজবার খানের ছেলে বিকাশকর্মী শাকিল খান, আসমা খাতুন এবং শিশু রবিন। নিহত শিশু রবিন আসমা খাতুনের ছেলে। তবে পুলিশ শাকিলের সঙ্গে নিহত আসমার সম্পর্কের বিষয়টি জানাতে পারেনি।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে আসমার মা হাসিনা খাতুন বলেন, গতকাল সকালে সৌমেন স্ত্রী-সন্তানকে খুলনায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। পরে এ হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পারেন তারা। শাকিল বিষয়ে তার ভাষ্য, তার মেয়ের সঙ্গে শাকিল ফোনে কথা বলতেন। নিহত আসমার কিশোর ভাই হাসান জানায়, তার বোনের আগে দুটি বিয়ে হয়েছিল। ভাগ্নে রবিন বোনের দ্বিতীয় স্বামীর সন্তান। পাঁচ বছর আগে এএসআই সৌমেনের সঙ্গে বোনের বিয়ে হয়। কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গুলির ঘটনা জানার পর আমরা এলাকায় আসি। তিনজনকে গুলি করা হয়েছে। যে গুলি করেছিল তাকে আমরা আটক করেছি।
শুধু কুষ্টিয়ার ওই ঘটনাই নয়, গত শনিবার আগারগাঁওয়ে সংসদ সচিবালয় কোয়ার্টার থেকে নুসরাত জাহান নামে এক নারীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নুসরাতের স্বামী মামুন মিল্লাত পলাতক। জানা গেছে, মামুন মিল্লাত নিজেকে ৩৮তম বিসিএস এর নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয়ে নুসরাতকে বিয়ে করেন। পরে নুসরাত জানতে পারেন, মামুন পুলিশ কর্মকর্তা নন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চলছিল।

তেজগাঁও বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ২০১৯ সালে মামুন মিল্লাতকে বিয়ে করেন নুসরাত। স্বামী-স্ত্রী আগারগাঁওয়ের সংসদ সচিবালয়ের বি দুই নম্বর কোয়ার্টারে সাবলেট থাকতেন। মামুন মিল্লাত নিজেকে ৩৮তম বিসিএস এর নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে নুসরাতকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু পরে নুসরাত জানতে পারেন, মামুন পুলিশ কর্মকর্তা নন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো।

এছাড়াও গত ১ জুন রাজধানীর মহাখালী থেকে ময়না মিয়া নামের এক ব্যক্তির হাত-পা ও মাথাবিহীন দেহ উদ্ধার করা হয়। পরে এ ঘটনায় তার প্রথম স্ত্রী ফাতেমা খাতুনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর তার দেখানো জায়গা থেকে ময়না মিয়ার বিচ্ছিন্ন মাথা উদ্ধার করা হয়।

ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে ফাতেমা জানিয়েছেন, দাম্পত্য কলহের জেরে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে স্বামীকে অচেতন করে হত্যার পর তিনি লাশ ছয় টুকরো করে আলাদা আলাদা জায়গায় ফেলেন। বাসা থেকে তিনি একা লাশ সরাতে পারবেন না বুঝতে পেরে ধারালো ছুরি দিয়ে ছয় টুকরো করেন তিনি। তাছাড়া আলাদা আলাদা জায়গায় খণ্ডিত অংশ ফেলে দিলে লাশ শনাক্ত করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হবে না বলেও ধারণা ছিল তার।

এছাড়াও গত ১৬ মে রাজধানীর পল্লবীতে শাহীন উদ্দিন নামে এক যুবককে কুপিয়ে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। জমিসংক্রান্ত পূর্বশত্রুতার জেরে তাকে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। এ ঘটনায় সাবেক এমপি আউয়ালসহ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ৩১ মে রাজধানীর কলাবাগান থেকে গ্রিনলাইফ হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. কাজী সাবিরা রহমান লিপির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, তাকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। ২০ মে দক্ষিণখানে মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে পোশাককর্মী আজহারুলের সাত টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়।

এর আগে ৪ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুরে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কলহের জেরে স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ সাত টুকরো করেন জুয়েল আহমেদ। ২৭ মে রংপুরের মিঠাপুকুরে প্রতিবেশীর ঘরের মেঝে খুঁড়ে রহিমা খাতুন নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। আত্মীয় এক যুবক মেয়েটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে মাটিতে পুঁতে রাখে বলে জানা যায়। একই দিন দিনাজপুরের পার্বতীপুরে পাঁচ বছরের শিশু হাসিকে গলা টিপে হত্যার পর স্বজনদের লাশ উদ্ধার করতে বলেন মা রত্না বেগম। ২১ মে বরিশালে সবুজ নামে এক শিশুকে হত্যা করে লাশ খালে ফেলে দেয়া হয়। ১৬ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজ নিজের গলায় আঘাত করে মারা যান। এ ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তিন বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রকে এলএসডি নামের মাদকসহ গ্রেফতার করে পুলিশ।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ইনকিলাবকে বলেন, এ ধরনের অপরাধ অতীতেও ঘটেছে। কিন্তু এসব প্রকাশ্যে আসতো না। তবে বর্তমানে এ ধরনের অপরাধ হলেও খুব দ্রুত প্রকাশ পাচ্ছে। তবে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে বর্তমানে এ ধরনের অপরাধ কিছুটা বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা প্রতিরোধ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সামাজিকভাবে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। তা হলে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (12)
Anup Deb Ornob ১৪ জুন, ২০২১, ১:০৮ এএম says : 0
বাংলাদেশের মানুষের জন্য একাডেমিক পড়ালেখা বাদ দিয়ে মনুষ্যত্বের শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন। আজ আমাদের দেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে, শুধু পিছিয়ে আছে মানুষগুলো।
Total Reply(0)
Azizur Rahman Tareq ১৪ জুন, ২০২১, ১:০৯ এএম says : 0
কি এক অসভ্য বর্বরতার মধ্যদিয়ে দেশ প্রবাহমান । নিরীহ এবং ভাল মানুষগুলো কোন না কোনভাবে হত্যা, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে । এই ঘটনার খোজ নিলে জানা যাবে বর্বরগুলো কোনও বর্বরের ছত্রছায়ায় আছে
Total Reply(0)
Mohammad Yeasin ১৪ জুন, ২০২১, ১:০৯ এএম says : 0
যে দেশে দলের দোহাই দিয়ে সঠিক বিচার হয় না, যে দেশে খুনি মাফিয়ারা নির্ভয় ঘুরে বেড়ায়, সে দেশে এ ধরনের খুন হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার,
Total Reply(0)
Ekram Hasan ১৪ জুন, ২০২১, ১:১০ এএম says : 0
এটাই বর্তমান বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। দেশের আইন ব্যবস্থার কতটুকু অবনতি হলে, সিনেমার স্টাইলে দিনে দুপুরে হত্যা করা হয়
Total Reply(0)
Sajib Hossain Joy ১৪ জুন, ২০২১, ১:১০ এএম says : 0
এর জন্য দায়ী বিচারহীনতা, শুধু ভীন্ন মতাদর্শী ও হুজরদের বেলায়ই দ্রুত বিচার কার্যক্রম হতে দেখি এমনকি তাদের জামিনও দেয়া হয়না অপরদিকে এমন গুরতর খুনি অপরাধীরা যদিও ধরা পরে ৬ মাস বাদে আবার বেড়িয়ে যায় এবং বীরদর্পে চলাফেরা করে,,, এমনটাই দেখে আসছি
Total Reply(0)
Tahmina Papry ১৪ জুন, ২০২১, ১:১০ এএম says : 0
মানুষের নৈতিক সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ কতোটা তলানিতে নামলে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটতে পারে!?
Total Reply(0)
Md Salahuddin Ahmed Nir ১৪ জুন, ২০২১, ১:১১ এএম says : 0
আমরা যে কতটুকু অনিরাপদ তা এসব ঘটনা থেকে বুঝা যায়।তবুও উপর মহলের টনক নড়বে না। স্বাধীন দেশে পরাধীন আমরা।
Total Reply(0)
Rahman Chowdhury ১৪ জুন, ২০২১, ১:১১ এএম says : 0
আজ আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি দেশের প্রশাসনিক কাঠামো একধম ভেঙে পড়েছে !
Total Reply(0)
Shahidul Islam ১৪ জুন, ২০২১, ১:১১ এএম says : 0
একটা দেশের জনগণ তার দেশের সরকারের কাছে সর্বাগ্রে যে জিনিসটা পাওয়ার হকদার,সেটা হচ্ছে তাদের জান এবং মালের নিরাপত্তা। কোন সরকার যদি এটা করতে অক্ষম হয়,তবে সেই দেশে সরকার আছে বলে আমরা বিশ্বাস করতে পারিনা।
Total Reply(0)
MD Forid Hossain ১৪ জুন, ২০২১, ১:১২ এএম says : 0
নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং সুশাসন শব্দগগুলোর অর্থ আজও বুঝলাম না।
Total Reply(0)
মোঃ+দুলাল+মিয়া ১৪ জুন, ২০২১, ৯:০৮ এএম says : 0
আজ অসহায় আমি ।
Total Reply(0)
Moinuddin ১৪ জুন, ২০২১, ৯:২৯ এএম says : 0
ইনসানিয়াত বা মানবতা ভিত্তিক রাষ্ট্র সমাজ ব্যবস্থা হলে সমগ্র দেশের সমগ্র বিশ্বের সবাই সত্য পাবে, সুবিচার পাবে, মানবতা পাবে, তাদের নিজস্য অধিকার পাবে,স্বাধীনতা পাবে, সুন্দর ভাবে বাচার নিশ্চয়তা পাবে। কেহ আর আতংকে থাকবে না, যে যে সম্প্রদায়ের হোক না কেন সে তার অধিকার আদায়ের পূর্ণ স্বাধ পাবে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন