শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

ঘুমের ওষুধের ভালো-মন্দ

| প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০২১, ১২:০৮ এএম

একুশ শতকে শরীরের রোগ কমেছে, কিন্তু মনের রোগ বেড়েছে। মনের উপদ্রব কেড়ে নিয়েছে আমাদের যত ঘুম। ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষ এখন কম ঘুমায়। গড়ে দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘণ্টা মাত্র। কারণ, ঘুমের সময়টিতে সোশ্যাল মিডিয়া ভাগ বসিয়েছে। পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ লোকেরা দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার কম ঘুমায়। কিন্তু আঠারো থেকে পঁয়ষট্টি বছরের যে কারো প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। কর্মক্ষম অর্ধেকের বেশি লোকদের অভিযোগ - অফিস কিংবা কাজের জায়গায় তারা নিয়মিত ঝিমায়। পৃথিবী ব্যাপী প্রতি চারজনের একজন এখন ইনসমনিয়ার সমস্যায় ভুগছে। আবার তার মধ্যে মেয়েরা পুরুষের তুলনায় নির্ঘুমতায় বেশি ভোগে।

করোনা পেনডেমিকে নির্ঘুমটার সমস্যা অনেক বেড়েছে। ভালো ঘুম ঘুমাতে না পেরে উদ্ভট স্বপ্ন দেখা থেকে শুরু করে দাঁত কিড়মিড়, ঘুমে শ্বাস কষ্ট বেড়ে যাওয়া থেকে ঘুমের সময় কথা বলা, এমনসব সমস্যা নির্ঘুমতার সাথে যুক্ত হয়েছে এবং বেড়ে গেছে।

এই কম ঘুম শরীরকে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত ওজন বাড়া, উচ্চ রক্তচাপ, স্মৃতি ক্ষয় রোগ, ইমিউনিটি কমে যাওয়া, ক্যান্সার, এমনসব রোগের পেছনে কম ঘুম অন্যতম একটি কারণ।

ঘুমের এই খেসারত কাটিয়ে উঠতে লোকে হাত বাড়িয়ে দেয় ঘুমের ওষুধের দিকে।
এই শতাব্দীতে তিনটি মেডিসিনের অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের শরীরের অনেক ক্ষতি করছে। ঘুমের ওষুধ, এন্টিবায়োটিক এবং অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় ভিটামিন সাপ্লিমেন্টস ।

প্রাণীদের মধ্যে বিড়াল আর বাদুড়ের জীবনের দুই তৃতীয়াংশ কেটে যায় ঘুমে। মানুষের জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় যায় ঘুমে। একজন প্রাপ্ত বয়স্কের দৈনিক গড়ে সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমের দরকার। তার চেয়ে কম ঘুমলে শরীরে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ, মোটা হয়ে যাওয়া, মেমোরি কমে যাওয়া, আধুনিক জীবনে এমনসব রোগ এবং সমস্যার অন্যতম কারণ ঘুমের সমস্যা।

ঘুম অনিয়মিতের কারণে অনেক সমস্যা হলেও দৈনন্দিন এমন কিছু সমস্যা এসে যায়, তখন নানা কারণে ঘুম আসে না। তখন চিকিৎসকেরা সাময়িক সময়ের জন্যে ঘুমের ওষুধ খেতে পরামর্শ দেন। কিন্তু আধুনিক জীবনে বেশিভাগ মানুষ ঘুমের সমস্যা চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ না করে নিজেরাই সমাধানের উদ্যোগ নেয়। নিজেরাই স্লিপিং পিল বা সিডাটিভের শরণাপন্ন হয়। পরিণতিকে সাময়িক ঘুমের মুখ দেখলেও পরবর্তী সময়ের জন্যে শরীরের ক্ষতি করে বসে। তাই ঘুমের ওষুধের ভালো মন্দ, ব্যবহারের কারণ, পদ্ধতি, সাইড ইফেক্ট, দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের কুফল, ওষুধের পরিবর্তে বিকল্প পথে ঘুমের সমাধান এমনসব ইস্যু গুলো জানা প্রয়োজন।

ঘুম শরীরের আধা অচেতন একটি প্রক্রিয়া। পুরো চেতন নয়, পুরো অচেতন নয় এবং এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় যাওয়া এবং ফিরে আসার মধ্যবর্তী সময়টুকুই ঘুম।

ঘুম শরীরের একটি গুরুপ্তপূর্ণ কাজ। ঘুমের কাজ শরীরে অন্য কাজগুলোকে রি-চার্জ করা। স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নিয়মিত ঘুম নিয়মিত খাবারের মতোই একটি অংশ। খাবার শরীরের ফুয়েল যোগায়, ঘুম শরীরের ইঞ্জিন ঠিক রাখে।

ঘুম আসার পেছনে দুটো জিনিস কাজ করে। শরীরের একটি ঘড়ি এবং একটি হরমোন। ঘড়িটির নাম হল সার্কাডিয়ান রিদম। হরমোনটির নাম মেলাটোনিন। দেহ-ঘড়িটি ঠিক করে কখন শরীরের বিশ্রামের প্রয়োজন এবং শরীরকে তার সংকেত দেয় মেলাটোনিন রসায়ন পদার্থটি বের করে।

তার মানে এই দেহ ঘড়ি এবং মেলাটোনিনের কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটলে ঘুম সহজে আসে না। ঘুমের এমন সমস্যা সাময়িক। সবার জীবনে ঘুমের এমন কম বেশি ব্যাঘাত ঘটে। দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিন যেমন একই যায় না, তেমনি আমাদের ঘুমের কোয়ালিটি অথবা একই প্রকারে ঘুম আসে না। ঘুমের এই সাময়িক ব্যাঘাত থেকে উদ্ধার পেতে আমরা ¯িøপিং পিল খাই।

১৯৭০ এ প্রথম স্লিপিং পিল ফ্লুরাজিপাম আবিষ্কৃত হয়। তারপর বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ওষুধ বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন। একসময় আলকোহোলকেও ঘুমের ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হতো। উনিশ শতকের দিকে ব্রোমাইড সল্টের লিকুইড সিডাটিভ এবং হিপনোটিক ড্রাগ হিসাবে ব্যবহার করতো। এখন বেশিরভাগ স্লিপিং পিল সিনথেটিক বা ল্যাবে প্রস্তুত করা রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি। বর্তমানে বাজারে প্রায় পঁচিশ ধরনের সিডাটিভ বা ঘুমের ওষুধ আছে। সাথে অনেক ঘুমের মেডিসিনের মধ্যে ঘুমের ওষুধের ইফেক্ট আছে।

ঘুমের বেশিরভাগ ওষুধ মস্তিষ্কের কাজের গতিকে ধীর করে দিয়ে শরীরকে রিলাক্স করে ফেলে, পেশিগুলোকে শিথিল করে ফেলে, মস্তিষ্কের নিউরোনাল এক্টিভিটিতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে শরীরকে ঘুম পাড়ায়। পুরো কাজটাই ঘটে মস্তিষ্কের বা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে। ঘুমের ওষুধগুলো গামা এমাইনো বিউটারিক এসিড বা সংক্ষেপে গাবা নামের নিউরোট্রান্সমিটার উপাদানকে মস্তিষ্কে সিক্রেট করে। আর এই গাবার কাজ হল মস্তিষ্কে স্নায়ুর কাজের গতি কমিয়ে দেয়া। মস্তিষ্কে এমন স্নায়ুবিক কাজের ফ্লো কমে গেলে ঘুম আসতে থাকে।

ফার্মাকোলজির ভাষায় অনেকগুলো টাইপ থাকলেও বাজারে চালু বেশিরভাগ ঘুমের ওষুধকে চার ভাগে ভাগ করা যায় ।
১. বেনজোডায়াজেপিনস। ২. বারবিচুরেটস। ৩. হিপনোটিকস। ৪. ওটিওযেডস।

এর বাহিরে অন্য যেসব ওষুধে ঘুমের ইফেক্ট আছে, যেমন -এন্টিহিস্টামিনস ও এন্টিডিপ্রেসেন্টস। এগুলোর বাহিরে ঘুমের ওষুধের আরও কিছু বিকল্প আছে । যেমন : মেলাটোনিন ও কিছু হারবাল।

ঘুমের সমস্যার বাইরে আরও কিছু কিছু সমস্যার ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ঘুমের ওষুধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন। যেমন : পেনিক এট্যাক কিংবা অতিরিক্ত মাথা ব্যথা, ডিপ্রেশন কিংবা আইবিএস ।

ঘুমের ওষুধের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা আসক্তি এবং নির্ভরশীলতা। এডিকশন এন্ড ডিপেন্ডেন্সি। আর এই দুটো জন্ম দেয় টলারেন্স। কিছুদিন কোন প্রয়োজনে নিয়মিত খেলে প্রথমে তৈরি করে নির্ভরশীলতা। ক্রমশ নির্ভরশীলতার কারণে সিঙ্গেল ডোজের পরিবর্তে মাল্টি ডোজ নিতে থাকে। তখন ছাড়িয়ে আনতে কষ্ট হয়। ওষুধ না খেলে ঘুম আসে না। বাড়তে থাকে ডোজ, তৈরি হয় আসক্তি। আসক্তির মাত্রা বাড়িয়ে দেয় টলারেন্স। তখন ঘুমের চেয়ে ঘুমের ওষুধের উপর নির্ভরশীলতা, সহনশীলতা এবং আসক্তি শরীরকে অলস করে দেয়, মস্তিষ্কের স্মৃতি শক্তির ক্ষয় করে, দীর্ঘ ব্যবহারে ডিমেনশিয়া দেখা দেয়, শরীরে ওজন বেড়ে গিয়ে কার্ডিও সমস্যা বাড়ে এবং ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে। দীর্ঘদিন ঘুমের ওষুধের ব্যবহার মানসিক অনেক সমস্যাকে কমানোর পরিবর্তে আরও বাড়িয়ে দেয়।

দুইদিন ঠিক মতো না ঘুমানোর পর মস্তিষ্কে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয়, এলকোহল পানে একই সমস্যা গুলো দেখা দেয়। এলকোহল পানে যেমন ব্রেইনের ফোকাসিং ক্ষমতা কমে যায়, জাজমেন্টে সমস্যা হয়, তেমনি ঘুমের ওষুধে আসক্তি হলে মস্তিষ্কের স্থিরতা কমে যায়। মস্তিষ্কের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। যদিও ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পর লোকে নিজেকে সুস্থির ভাবে। আদতে মস্তিস্কের স্নায়ু কাজে যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটে।

তাই উপদেশ হলঃ
১) চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন প্রকার ঘুমের ওষুধ খাবেন না।
২) একনাগাড়ে দু সপ্তাহের বেশি ঘুমের ওষুধ খাবেন না।
৩) সবসময় কম শক্তিশালী ডোজটি দিয়ে শুরু করবেন।
৪) অন্য কোন রোগের কারণে ঘুমের সমস্যা হলে ঘুমের ওষুধের চেয়ে আগে অন্য সমস্যাটি সমাধান করুন।
৫) ঘুমের ওষুধ অনেক ওষুধের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করবেন - আপনার নেয়া অন্য কোন মেডিসিনের উপর ঘুমের ওষুধের কোন প্রভাব আছে কিনা।
৬) এলকোহল এবং ঘুমের ওষুধ একসাথে কখনো খাবেন না।

ডা. অপূর্ব চৌধুরী
ইমেইল: opurbo.chowdhury@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন