পূর্বকালে এক বাদশাহ ছিল। তার দরবারে ছিল এক যাদুকর। সে বৃদ্ধ হয়ে গেলে বাদশাহকে বলল: আমি তো এখন বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি এবং আমার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। সুতরাং আমাকে এমন একটা ছেলে দিন যাকে আমি ভালোভাবে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিতে পারি।
তারপর সে একটি মেধাবী বালককে যাদুবিদ্যা শেখাতে শুরু করে। বালকটি তার শিক্ষাগুরুর বাড়ী যাওয়ার পথে এক সাধকের আস্তানার পাশ দিয়ে যেতো। সুফীসাধকও ঐ আস্তানায় বসে কখনো ইবাদাত করতেন, আবার কখনো জনগণের উদ্দেশ্যে ওয়াজ নসীহত করতেন। বালকটিও পথের পাশে দাঁড়িয়ে ইবাদাতের পদ্ধতি দেখতে, আবার কখনো ওয়ায নসীহত শুনতো। এ কারণে যাদুকরের কাছেও সে মার খেতো এবং বাড়ীতে মা-বাবার কাছেও মার খেতো। কারণ যাদুকরের কাছে যেমন দেরীতে পৌঁছতো তেমনি বাড়ীতেও দেরী করে ফিরতো। একদিন সে সাধকের কাছে তার এ দুরাবস্থার কথা বর্ণনা করলো। সাধক তাকে বলে দিলেন, যাদুকর দেরীর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলবে যে, মা দেরী করে বাড়ী থেকে আসতে দিয়েছেন, কাজ ছিল। আবার মায়ের কাছে গিয়ে বলবে যে, গুরুজী দেরী করে ছুটি দিয়েছেন।
এমনিভাবে এ বালক একদিকে যাদুবিদ্যা এবং অন্যদিকে ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষা করতে লাগলো। একদিন সে দেখলো যে, তার চলার পথে এক বিরাট বিস্ময় কিম্ভুত কিমাকার জানোয়ার পড়ে আছে। পথে লোক চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এ পাশ থেকে ওপাশে এবং ওপাশ থেকে এপাশে যাওয়া আসা করা যাচ্ছে না। সবাই উদ্বিগ্ন ও বিব্রতাবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। বালকটি মনে মনে চিন্তা করল যে, একটা বেশ সুযোগ পাওয়া গেছে। দেখা যাক, আল্লাহর কাছে সাধকের ধর্ম অধিক পছন্দনীয় না যাদুকরের ধর্ম। এটা চিন্তা করে সে একটা পাথর তুলে জানোয়ারটির প্রতি এই বলে নিক্ষেপ করল: ‘হে আল্লাহ আপনার কাছে যদি যাদুকরের ধর্মের চেয়ে সাধকের ধর্ম অধিক পছন্দনীয় হয়ে থাকে তবে এ পাথরের আঘাতে জানোয়ারটিকে মেরে ফেলুন। এতে করে জনসাধারণ এর অপকার থেকে রক্ষা পাবে।’ পাথর নিক্ষেপের পরপরই ওর আঘাতে জানোয়ারটি মরে গেল। সুতরাং লোক চলাচল স্বাভাবিক হয়ে গেল। আল্লাহ প্রেমিক সাধক এ খবর শুনে তার ঐ বালক শিষ্যকে বললেন: হে প্রিয় বৎস! তুমি আমার চেয়ে উত্তম। এবার আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তোমাকে নানাভাবে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। সেসব পরীক্ষা সম্মুখীন হলে আমার সম্বন্ধে কারো কাছে কিছু প্রকাশ করবে না।
অতপর বালকটির কাছে নানা প্রয়োজনে লোকজন আসতে শুরু করলো। তার দো‘আর বরকতে জন্মান্ধ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে লাগলো। কুষ্ঠ রোগী আরোগ্য লাভ করতে থাকলো এবং এছাড়া আরও নানা দুরারোগ্য ব্যাধি ভালো হতে লাগলো। বাদশাহ’র এক অন্ধমন্ত্রী এ খবর শুনে বহু মূল্যবান উপহার উপঢৌকনসহ বালকটির নিকট হাজির হয়ে বলল: যদি তুমি আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পার তবে এসবই তোমাকে আমি দিয়ে দিবো। বালকটি একথা শুনে বলল: দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়ার শক্তি আমার নেই। একমাত্র আমার প্রতিপালক আল্লাহই তা পারেন। আপনি যদি তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন তাহলে আমি তাঁর নিকট দো‘আ করতে পারি। মন্ত্রী অঙ্গীকার করলে বালক তার জন্যে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলো। এতে মন্ত্রী তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে পেলেন। অতঃপর মন্ত্রী বাদশাহ’র দরবারে গিয়ে যথারীতি কাজ করতে শুরু করল। তার চক্ষু ভালো হয়ে গেছে দেখে বাদশাহ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল: আপনার দৃষ্টিশক্তি কে দিলো? মন্ত্রী উত্তরে বলল: আমার প্রভু। বাদশাহ বলল: হ্যাঁ, অর্থাৎ আমি। মন্ত্রী বলল: আপনি কেন হবেন? বরং আমার এবং আপনার প্রভু লা শারীক আল্লাহ রাব্বল আলামীন আমার চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার এ কথা শুনে বাদশাহ বলল: তাহলে আমি ছাড়াও আপনার কোনো প্রভু আছে না কি? মন্ত্রী জবাব দিল: হ্যাঁ, অবশ্যই। তিনি আমার এবং আপনার উভয়েরই প্রভু ও প্রতিপালক। বাদশাহ তখন মন্ত্রীকে নানা প্রকার উৎপীড়ন এবং শান্তি দিতে শুরু করল এবং জিজ্ঞেস করল: এ শিক্ষা আপনাকে কে দিয়েছে? মন্ত্রী তখন ঐ বালকের কথা বলে ফেলল এবং জানালো যে, তিনি তার কাছে ইসলাম গ্রহণ করেছে। বাদশাহ তখন বালকটিকে ডেকে পাঠিয়ে বলল: তুমি তো দেখছি যাদুবিদ্যায় খুবই পারদর্শিতা অর্জন করেছ যে, অন্ধদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিচ্ছ এবং দুরারোগ্য রোগীদের আরোগ্য দান করছো? বালক উত্তরে বলল: এটা ভুল কথা। আমি কাউকেও সুস্থ করতে পারি না, যাদুও পারে না। সুস্থতা দান একমাত্র আল্লাহই করে থাকেন। বাদশাহ বলল: অর্থাৎ আমি। কারণ সবকিছুই তো আমিই করে থাকি। বালক বলল: না, না, এটা কখনই নয়। বাদশাহ বলল: তাহলে কি তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে প্রভু বলে স্বীকার কর? বালক উত্তরে বলল: হ্যাঁ, আমার এবং আপনার প্রভু আল্লাহ ছাড়া কেউ নয়। বাদশাহ তখন বালককে নানা প্রকার শান্তি দিতে শুরু করল। বালকটি অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত সাধক সাহেবের নাম বলে দিল। বাদশাহ সাধককে বলল; তুমি এ ধর্মত্যাগ কর। সাধক অস্বীকার করলেন। তখন বাদশাহ তাকে করাত দ্বারা ফেড়ে দু’টুকরা করে দিল। এরপর বাদশাহ বালকটিকে বলল: তুমি সাধকের প্রদর্শিত ধর্মবিশ্বাস পরিত্যাগ কর। বালক অস্বীকৃতি জানাল। বাদশাহ তখন তার কযেকজন সৈন্যকে নির্দেশ দিল: এ বালককে তোমরা অমুক পাহাড়ের চূড়ার উপর নিয়ে যাও। অতঃপর তাকে সাধকের প্রদর্শিত ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে দিতে বল। যদি মেনে নেয় তবে তো ভালো কথা।
অন্যথায় তাকে সেখান হতে গড়িয়ে নিচে ফেলে দাও। সৈন্যরা বাদশাহ’র নির্দেশমত বালকটিকে পর্বত চূড়ায় নিয়ে গেল এবং তাকে তার ধর্ম ত্যাগ করতে বলল। বালক অস্বীকার করলে তারা তাকে ঐ পর্বত চূড়া হতে ফেলে দিতে উদ্যত হলো। তখন বালক আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করল: হে আল্লাহ! যেভাবেই হোক আপনি আমাকে রক্ষা করুণ! এ প্রার্থনার সাথে সাথেই পাহাড়ে কম্পন শুরু হয়ে গেল এবং ঐ সৈন্যরা গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। বালকটিকে আল্লাহ রক্ষা করলেন সে তখন আনন্দ চিত্তে ঐ যালিম বাদশাহ’র নিকট পৌঁছল। বাদশাহ বিস্মিতভাবে তাকে জিজ্ঞেস করল: ব্যাপার কী? আমার সৈন্যরা কোথায়? বালকটি জবাবে বলল: আমার আল্লাহ আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন এবং তাদেরকে ধ্বংস করেছেন। বাদশাহ তখন অন্য কযেকজন সৈন্যকে ডেকে বলল: নৌকায় বসিয়ে তাকে সমুদ্রে নিয়ে যাও, তারপর তাকে সমুদ্রগর্ভে নিক্ষেপ করে এসো। সৈন্যরা বালককে নিযে চলল এবং সমুদ্রের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে নৌকা থেকে ফেলে দিতে উদ্যত হলো। বালক সেখানেও মহান আল্লাহর নিকট ঐ একই প্রার্থনা জানালো। সাথে সাথে সমুদ্রে ভীষণ ঢেউ উঠলো এবং সমস্ত নৈস্য সমুদ্রে নিমজ্জিত হলো। বালক নিরাপদে তীরে উঠলো এবং বাদশাহ’র দরবারে হাজির হয়ে বলল: আমার আল্লাহ আমাকে আপনার সেনাবাহিনীর কবল থেকে রক্ষা করেছেন। হে বাদশাহ! আপনি যতই বুদ্ধি খাটান না কেন, আমাকে হত্যা করতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, আমি যে পদ্ধতি বলি সেভাবে চেষ্টা করলে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাবে। বাদশাহ বলল: কী করতে হবে? বালক উত্তরে বলল: সকল মানুষকে একটি ময়দানে সমবেত করুন। তারপর খেজুর কান্ডের মাথায় শূল উঠিয়ে দিন। অতঃপর আমার তুণ হতে একটি তীর বের করে আমার প্রতি সেই তীর নিক্ষেপ করার সময় এই বাক্যটি পাঠ করুন: “বিসমিল্লাহি রব্বি হা-যাল গুলাম”
“আল্লাহর নামে এই তীর নিক্ষেপ করছি; যিনি এই বালকের প্রতিপালক।” তাহলে সেই তীর আমার দেহে বিদ্ধ হবে এবং আমি মারা যাব। বাদশাহ তাই করলো। তীর বালকের কানপট্টিতে বিদ্ধ হলো এবং সেখানে হাত চাপা দিলো ও শাহাদাত বরণ করলো। সে শহীদ হওয়ার সাথে সমবেত জনতা ধর্মকে সত্য বলে বিশ্বাস করলো। সবাই সমবেত কণ্ঠেধ্বনি তুললো: আমরা এই বালকের প্রতিপালকের উপর ঈমান আনলাম। এ অবস্থা দেখে বাদশাহ সভাষদবর্গ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল এবং বাদশাহকে বলল: আমরা তো এই বালকের ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারলাম না, সব মানুষই তার ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করলো! আমরা তার ধর্মের প্রসার লাভের আশংকা তাকে হত্যা করলাম, অথচ হিতে বিপরীত ঘটলো। আমরা যা আশংকা করছিলাম তাই ঘটে গেল। সবাই যে মুসলিম হয়ে গেল! এখন কী করা যায়?
বাদশাহ তখন তার অনুচরবর্গকে নির্দেশ দিল: সকল মহল্লায় ও রাস্তায় রাস্তায় বড় বড় খন্দক খনন করো এবং ওগুলোতে জ্বালানিকাষ্ঠ ভর্তি করে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দাও। যারা ধর্ম ত্যাগ করবে তাদেরকে বাদ দিয়ে এই ধর্মে বিশ্বাসী সকলকে এই অগ্নিকুÐে নিক্ষেপ করো। বাদশাহ’র এ আদেশ যথাযথভাবে পালিত হলো। মুসলিমদের সবাই অসীম ধৈর্য্যের পরিচয় দিল এবং আল্লাহর নাম নিয়ে আগুনে ঝাপিয়ে পড়তে লাগল। একজন নারী কোলে শিশু নিয়ে একটি খন্দকের প্রতি ঝুকে তাকিয়ে দেখছিল। হঠাৎ ঐ অবলা শিশুর মুখে ভাষা ফুটে উঠলো। সে বলল: মা! কী করছেন? আপনি সত্যের ওপর রয়েছেন। সুতরাং ধৈর্য্যের সাথে নিশ্চিন্তে অগ্নিকুন্ডে ঝাপিযে পড়ুন।
যুবক শহীদকে দাফন করা হলো। ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর খিলাফতের সময় তার কবর থেকে তাকে বের করা হয়েছিল। তখন দেখা যায় যে, তার আঙ্গুলী তার কান পট্টিতে লাগানো আছে যে অবস্থাতেই তিনি শহীদ হয়েছিলেন।
অতঃপর বাদশাহও মারা গেল। এ ঘটনা জনগণের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল করে দিল যে, আবদুল্লাহর ধর্ম সত্য। ফলে নাজরানের অধিবাসীরা সবাই মুসলিম হয়ে গেল এবং ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালামের সত্য দীনে বিশ্বাস স্থাপন করল। ঐ সময় ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালামে ধর্মই ছিল সত্য ধর্ম হিসেবে স্বীকৃত। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনও নবী হিসেবে পৃথিবীতে আগমন করেননি। কিছুকাল পর তাদের মধ্যে বিদ‘আতের প্রসার ঘটে এবং সত্য দীনের প্রদীপ নির্বাপিত হয়। নাজরানের খ্রিষ্টান ধর্ম প্রসারের এটাও ছিল একটা কারণ। এক সময় যুনুওযাস নামক এক ইয়াহূদী সৈন্যদল নিয়ে সেই খ্রিষ্টানদের ওপর আক্রমণ করে এবং তাদের ওপর জয়যুক্ত হয়। সে তখন নাজরানবাসী খ্রিস্টানদের বলে: তোমরা ইয়াহূদী ধর্ম গ্রহণ কর, অন্যথায় তোমাদেরকে হত্যা করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন