বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সিঙ্গাপুরে জটের ধাক্কা চট্টগ্রামে

প্রাইভেট ডিপোর বেসামাল অবস্থা, রফতানিমুখী চালান জমছেই : খালি কন্টেইনার ও ফিডার জাহাজের সঙ্কট ভাড়া বৃদ্ধি, বুকিং সিডিউল এলোমেলো : ইউরোপ-আমেরিকায় গার্মেন্টস পণ্যের অর্ডার বাতিলের মুখ

শফিউল আলম ও রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৬ জুলাই, ২০২১, ১২:০০ এএম

সিঙ্গাপুর বন্দরে কন্টেইনার ও জাহাজের জট অব্যাহত রয়েছে। দীর্ঘদিন জটে থমকে গেছে কলম্বো এবং মালয়েশিয়ার পোর্ট ক্ল্যাং। তিনটি মাদার (ট্রান্সশিপমেন্ট) বন্দরজটে আটকে গেছে বাংলাদেশের প্রায় ৩০ হাজার রফতানি ও আমদানি কন্টেইনার। জটের ব্যাপক ধাক্কা পড়েছে চট্টগ্রামে বন্দর-শিপিং খাত উপ-খাতসমূহের উপর। চীন ও ইউরোপ-আমেরিকার বন্দরসমূহেও বাড়ছে জট। এর সরাসরি বিরূপ প্রভাবে সঙ্কট তৈরি হয়েছে রফতানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পখাতে।
পোর্ট-শিপিং সার্কেলে জানা গেছে, বন্দর-শিপিং কার্যক্রমের উপর নির্ভরশীল বেসরকারি আইসিডি বা ডিপোগুলোতে (অফডক) গার্মেন্টসের রফতানি চালান একের পর এক জমছেই। চট্টগ্রাম বন্দর ও নগরীর আশপাশে ১৯টি প্রাইভেট ডিপোতে গতকাল সোমবার পর্যন্ত রফতানিমুখি ১১ হাজার ৫১৯ ইউনিট কন্টেইনারের বেসামাল জট সৃষ্টি হয়েছে। শত শত কোটি টাকা মূল্যের রফতানি চালানগুলোর প্রায় সবই গার্মেন্টস পণ্যভর্তি।
স্বাভাবিক সময়ে থাকে ৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার রফতানি কন্টেইনার। ডিপো উপচিয়ে শেডে, বাইরে সড়কে ও খোলা জায়গায় সারি সারি কাভার্ড ভ্যান, লরিবাহী গার্মেন্টস পণ্য কন্টেইনারে বোঝাইয়ের (স্টাফিং) অপেক্ষায় পড়ে আছে। তাছাড়া বৃহত্তর ঢাকা, চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানের গার্মেন্টস কারখানা থেকে ডিপোগুলোর উদ্দেশে আরও চালান আসা অব্যাহত রয়েছে।
কিন্তু কবে কীভাবে এই বিপুল পরিমাণ রফতানি চালান কন্টেইনারে বোঝাই এবং জাহাজীকরণ (শিপমেন্ট) করা যাবে, অর্ডার অনুযায়ী গার্মেন্টস পণ্য সিঙ্গাপুরে মাদার জাহাজে তোলা ও সময়মতো ইউরোপ-আমেরিকায় ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে কিনা তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এমনকি অর্ডার বাতিল ও স্টকলট হওয়ার আশঙ্কায় কারখানা মালিকরা চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন।
ডিপোতে জট এবং চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজীকরণে অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে অনেক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। প্রাইভেট ডিপোগুলোতে কাস্টমস প্রক্রিয়া ও কন্টেইনার বোঝাই শেষে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের সিডিউল অনুযায়ী গার্মেন্টসহ শতভাগ রফতানি পণ্যসামগ্রী শিপমেন্ট করা হয়। এখন শিপমেন্টের জট কবে খুলবে সেদিকে তাকিয়ে আছেন কারখানা মালিকরা।
সঙ্কটের বহুমুখী কারণ
মূলত করোনার বৈশ্বিক মহামারী (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে বন্দর-শিপিং খাতের স্বাভাবিক কার্যক্রম ওলটপালট হয়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে স্বাভাবিক পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থা (সাপ্লাই চেইন)। ইউরোপ-আমেরিকায় সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতির কমবেশি উন্নতি হতে না হতেই গতবছরের (২০২০) শেষ ভাগ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানায় নতুন উদ্যমে বাড়তি উৎপাদন, লেনদেন এবং পরিবহন তৎপরতা শুরু হয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ বন্দরে পণ্য পরিবহনের চাপ, চাহিদা ও জাহাজ চলাচলের সøট তথা ব্যস্ততা বেড়েই চলে। এ অবস্থায় গত এপ্রিলে সুয়েজ খালে অচলাবস্থার ব্যাপক প্রভাব পড়ে শিপিং বিশ্বে। আবার চাহিদার তুলনায় কন্টেইনার ও জাহাজের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
বড় ধরনের জাহাজ জট থেকে এখনও বের হতে পারেনি সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার মাদার বন্দর পোর্ট ক্ল্যাং। বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট সিঙ্গাপুরে জাহাজের গড় অবস্থান কাল (টার্ন এরাউন্ড টাইম) এখন দ্বিগুণেরও বেশি। এ কারণে বাংলাদেশের রফতানি ও আমদানি পণ্যবাহী ফিডার জাহাজগুলো সিঙ্গাপুরে মাদার ভেসেলের কানেকশন পেতে বেশি সময় গুণতে হচ্ছে।
এতে করে মেইন লাইন অপারেটর (এমএলও) ও শিপিং কোম্পানিগুলো কনজেশন বা বন্দরজটের কারণে লোকসান দিয়ে জাহাজ পরিচালনায় অনীহা দেখাচ্ছে। আবার অনেকে জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি করেছে যথেচ্ছহারে। বুকিং সিডিউল ঠিক রাখা যাচ্ছে না। এলোমেলো হয়ে পড়েছে বৈশ্বিক শিপিং সেক্টর। আমদানি-রফতানিতে ব্যয় ও সময় অপচয় বেড়ে গেছে। যার মাশুল হিসেবে পণ্যের মূল্যের সাথেই বাড়তি খরচ যোগ হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে বিশেষত সিঙ্গাপুর বন্দরে বাংলাদেশের গার্মেন্টসহ রফতানি পণ্য মাদার ভেসেলে তুলে দেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অপারগতা জানিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন শিপিং লাইনস বুকিং আপাতত বন্ধ রেখেছে। বন্দরে বন্দরে জটে আটকে থাকা কন্টেইনারগুলো খালি হয়ে ফেরত না আসার কারণেও সৃষ্টি হয়েছে আরেক সঙ্কট। জটে আটকে পড়ায় খালি কন্টেইনারের ঘাটতি চলছে। ফিডার জাহাজের অভাবও প্রকট। আগে যেখানে ১২শ’ কন্টেইনার বোঝাই ফিডার জাহাজ ভাড়া হতো, এখন ৬শ’ থেকে ৮শ’ কন্টেইনারবাহী ছোট ফিডার জাহাজও সহজে মিলছে না। তার ওপর গত জানুয়ারি থেকে বেড়ে গেছে কন্টেইনার এবং জাহাজের ভাড়া (ফ্রেইট চার্জ)।
এতে তৈরি পোশাক রফতানি সঙ্কটে পড়েছে জানিয়ে বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, যথাসময়ে রফতানি পণ্য জাহাজীকরণ করা যাচ্ছে না। ট্রাক, কার্ভাড ভ্যানে তৈরি পোশাকের চালান বেসরকারি ডিপোর সামনে, রাস্তায় পড়ে আছে ১০ থেকে ১৫ দিন ধরে। এসব পরিবহন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। আবার ট্রাক, কার্ভাড ভ্যানের সঙ্কটে বন্দরে আসা কাঁচামাল যথাসময়ে কারখানায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। কারখানায় উৎপাদিত পণ্যও জাহাজীকরণের জন্য আনা যাচ্ছে না। কারখানাগুলোতে পণ্যের জট তৈরি হয়েছে।
এ অবস্থায় যথাসময়ে পণ্য না পৌঁছলে অর্ডার বাতিল এবং ক্রেতা কর্তৃক ডিসকাউন্ট আরোপ করা হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো থেকে ব্যাপক অর্ডার আসছে জানিয়ে তিনি বলেন আমরা আশা করছি আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ তৈরি পোশাক রফতানি করোনার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। তবে চলমান সঙ্কটের অবসান না হলে সে সম্ভাবনা হাতছাড়া হয়ে যাবে।
বেসরকারি কন্টেইনার মালিকদের সংগঠন বিকডার সেক্রেটারি মো. রুহুল আমিন বলেন, ১৯টি বেসরকারি অফডকে কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতা ৭৭ হাজার ৭০০ টিইইউস। তবে ধারণ ক্ষমতার ৮৫ শতাংশ ভর্তি হয়ে গেলে স্বাভাবিক কাজে ব্যঘাত ঘটতে শুরু করে। অফডকগুলোতে রফতানি কন্টেইনারসহ মোট কন্টেইনার রয়েছে ৫৩ হাজার ১৭৩ টিইইউস। এ অবস্থায় এসব কন্টেইনার খালাস না হলে অবডকের কাজে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এমন জট নিকট অতীতে দেখা যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, সঙ্কট নিরসনে ইতিমধ্যে শিপিং এজেন্টস ও ফ্রেইট ফরোওয়ার্ডার্সদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসেসিয়েশনের চেয়াম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিপিং খাতে। লোকসান কমাতে অনেক প্রতিষ্ঠান বড় জাহাজের বদলে ছোট জাহাজ পরিচালনা করছে। ফলে জাহাজ এবং কন্টেইনার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। জানা যায় আগে যেখানে সপ্তাহে অন্তত তিনটি মাদার ভেসেলের সিডিউল পাওয়া যেত সেখানে এখন বড়জোর একটি পাওয়া যায়। প্রায় সবকটি শিপিং লাইন সিডিউল বিপর্যয়ে পড়েছে। এই কারণে জার্মানভিত্তিক শিপিং সংস্থা হ্যাপাগ-লয়েড সিঙ্গাপুর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি কন্টেইনার বুকিং এক মাসের জন্য বন্ধের ঘোষণা দেয়।
গত ২৪ জুন থেকে তারা রফতানি কন্টেইনার পরিবহন করলেও আমদানি কন্টেইনারের বুকিং নিচ্ছে না। সংস্থার স্থানীয় এজেন্ট জিবিএক্স লজিস্টিকের অপারেশন মহাব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ জানান আগে বুকিং করা বিপুল সংখ্যক কন্টেইনার সিঙ্গাপুরে জমে থাকায় নতুন বুকিং বন্ধ রাখা হয়েছে। যথাসময়ে পণ্য পৌঁছাতে না পারায় এমন সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে অন্যান্য শিপিং লাইনের বুকিং করা কন্টেইনার জমে আছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসেসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, এশিয়ার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে দীর্ঘদিন থেকে জট চলছে। এই সঙ্কট কাটাতে হলে সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে বড় জাহাজে পণ্য বিদেশে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯০ মিটার দীর্ঘ এবং সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ার সুযোগ আছে। সংশ্লিষ্ট সবাই উদ্যোগী হলে বিকল্প হিসাবে চট্টগ্রাম থেকে বড় জাহাজ চালু করতে অনেক সংস্থা এগিয়ে আসবে। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিএসসিও ভূমিকা রাখতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন